
গায়ের সমস্ত শক্তি একত্র করে একদম ঘাড় বরাবর কোপটা বসিয়ে দিয়েছি।একবার নয়, পরপর তিন-চারবার কোপ দিতে হয়েছে।ফিনকি দিয়ে বের হয়ে আসা রক্তগুলো আমার লাল শাড়ীটাকে আরো লাল করে দিলো।হাত দুটো রক্তে ভিজে লাল টকটকে দেখাচ্ছে। আবছা আলোয় মনে হচ্ছে মেহেদী রাঙ্গানো হাত।একদম সেই বিয়ের দিনটির মত!কত স্বপ্ন নিয়েই না হাতদুটো রাঙ্গিয়েছিলাম সেদিন।আজ আবারো রাঙ্গালাম,তবে আজ আর চোখে স্বপ্ন নেই,আছে শুধু হতাশা আর প্রতিশোধের জ্বালা!
কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি ওকে খুন করতে চাইনি।আমিতো নিজেকে মানিয়েই নিয়েছিলাম।যেদিন প্রথম এই বাড়ীতে পা রেখেছি সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত এই অন্ধকার প্রকোষ্ঠের বন্দী জীবনকেই নিজের নিয়তি ভেবে আপন করে নিয়েছি।আমার হৃদয়টা হাহাকার করতো একটু আলোর মুখ দেখার জন্য।কিন্তু আমি তাকে প্রশ্রয় দেইনি মোটেও,শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছি।এই বাড়ীর আভিজাত্যের যাতাকলে চাপা পড়ে নিষ্পেষিত হয়েছে আমার অস্তিত্ব!শুধু একবার নয়, বহুবার!!নেশাখোর স্বামীর দিনরাত পাশবিক নির্যাতন আর মনহীন সহবাসে আমি যে ভীষন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম!তাও আমি কিছু বলিনি, চুপটি করে থেকেছি।
এরই মাঝে একদিন বুঝতে পারলাম আমি মা হতে চলেছি।কি ভীষন সুখের ছিলো সেই অনুভূতি আমি বলে বুঝাতে পারবোনা!দিনরাত আমার জঠরে বাড়তে থাকা আমার ছোট্টমনিটার সাথে কত যে কথা বলতাম, কত যে গান শুনাতাম!মেঘেদের গান, জ্যোৎস্নার গান, আরো কত কি।দুজনে মিলে উপভোগ করতাম নিস্তব্ধতার অপুর্ব সঙ্গীত।কিন্তু হিংসুটে ওরা আমার এই সুখটুকুও সহ্য করলো না।জন্মের আগেই ছিনিয়ে নিলো তাকে আমার কাছ থেকে।
তাই আজ আর পারলাম না চুপ থাকতে।খুনটা করেই ফেল্লাম।সেই সাথে খুন করলাম আমার আমিকে।আমার পুরনো আমিত্বকে খুঁজে পেতে এ অনেক দরকারী ছিলো যে, কি করবো বলুন??
শাড়ীতে রক্তের দাগ নিয়েই বের হয়ে পড়লাম রাস্তায়।অন্ধকারে খুব একটা বুঝা যাচ্ছিলো না।এলোমেলোভাবে হাটছি, হাটতে হাটতে কখন যে একটা গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম টেরই পেলাম না।সামনে বিশাল এক নদী।কোথা থেকে যেন একটা ছমছম হাওয়া এসে আমার চুলগুলোকে ঊড়িয়ে দিলো।আমি পাত্তা দিলাম না। ভীষন হালকা লাগছে আজ নিজেকে আবার কান্নাও আসছে।কেন???
নদীর জলে জ্যোস্নার আলো চিকচিক করছিলো।হঠাৎই আমার মনে হল কে যেন মা মা করে ডাকছে আমায়!গভীর জলের ভেতর থেকে ভেসে আসছে শব্দটা।যেন এর গভীরেই আমার জগত।অদ্ভুত এক শিহরণ ছেয়ে গেলো আমার শরীরে!পাপহীন তাপহীন অবগাহনের অমোঘ ব্যাকুলতা আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো দূরে বহুদূরে!!!
কতক্ষন এভাবে ছিলাম জানিনা, সম্বিত ফিরে পেতেই হাটা শুরু করলাম।রিক্সায় উঠেই মাকে ফোন দিলাম
-হ্যালো মা!
-হ্যা বল। তুই এতদিন পর?কেমন আছিস??
-ভালো। আমি আজ বাসায় আসছি মা।এক্টা খুন করে ফেললাম, ভীষন ক্লান্ত লাগছে, ক্ষুধাও পেয়েছে অনেক। আচ্ছা মা বাসায় কি শিং মাছে??
-কি যা তা বলছিস?? পাগলী মেয়ে!!
-আচ্ছা শোন আজ শিং মাছের ঝোল রান্না করতো,অনেকদিন খাইনা,খুব খেতে ইচ্ছে করছে।
-আচ্ছা।
-আচ্ছা আরেকটা কথা, নারিকেল তেল এনে রেখো।মাথায় দিবো। মাথাটা গরম হয়ে আছে।তোমার ঐসব কদুর তেল ফেল আমার ভালো লাগে না।তুমি ভালো করে দিয়ে দিবে,তুমি তেল দিতে দিতে আমি তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়বো। আমি আজ ভীষন ক্লান্ত মা!!
-আচ্ছা আনিয়ে রাখবো।আগে তো তুই আয়।
-আচ্ছা রাখি মা।
আমার রিক্সা এগিয়ে চলছে।আর জ্যোস্নারা গলে গলে পড়ছে আমার গায়ে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১০ ভোর ৬:৪৩