'আপনারা তো ইসলাম নিয়ে ব্যবসা করেন। আপনাদের মধ্যে কোনো এলেম নাই। কর্মীদের ভেতরে-ভেতরে জিহাদ করার কথা বলেন আর নিজেরা ক্ষমতায় যাওয়ার ধান্ধা করেন। আমি আজ জঙ্গি নেতা আর আপনারা সাধু সেজেছেন, না? এমন কিছু কি আছে, যা আপনাদের কথা ছাড়া করেছি?'
নিষিদ্ধ ঘোষিত জামা'আতুল মুজাহিদীনের (জেএমবির) আমির সাইদুর রহমান জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে উদ্দেশ করে এভাবেই এক চোট নিলেন মঙ্গলবার রাতে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদের সময়। ওই রাতে ছিল তাঁদের দ্বিতীয় দফা মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ। মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে জামায়াতের তিন শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী, মুজাহিদ, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ছাড়াও জেএমবির সাইদুরকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলায় তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। অন্য এক কর্মকর্তা জানান, এর আগে জেএমবির আমির সাইদুর ও জামায়াত নেতাদের কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্যই তাঁদের মুখোমুখি করা হচ্ছে।
জঙ্গি তৎপরতা ছাড়াও সম্প্রতি দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি চেষ্টার সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে গোয়েন্দাদের হাতে_এসবও যাচাই-বাছাই চলছে।
জিজ্ঞাসাবাদকারীদের একটি সূত্র জানায়, এ দফায় রিমান্ডে সাইদুরকে বেশ উৎফুল্ল দেখায়। তিনি জোর গলায় বলছেন, একটি কথাও মিথ্যা বলব না। জেলখানা থেকে আসার আগে চুল-দাড়িতে মেহেদিও মেখে এসেছেন তিনি।
মঙ্গলবার বিকেলে কারাগার থেকে তাঁকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে এনে সন্ধ্যার পর কিছুক্ষণের জন্য নিজামী ও মুজাহিদের মুখোমুখি করা হয়। দ্বিতীয় দফা ওই রাতেই ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত তাঁকে তিন জামায়াত নেতার মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ চলে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, এ সময় জিজ্ঞাসাবাদ করার কোনো প্রয়োজনই হয়নি। তাঁরা নিজেরাই কথাকাটাকাটি করে অজানা অনেক তথ্য দিয়েছেন। তবে সাইদুরের ক্ষোভ বেশি মুজাহিদের প্রতি। তাঁদের প্রথম দেখা হওয়ার সময় সাইদুর নিজ থেকেই হাত বাড়িয়ে জামায়াতের তিন নেতার সঙ্গে করমর্দন করেন। নিজামী ও সাঈদী করমর্দন করলেও মুজাহিদ অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলেন।
সূত্র মতে, সাইদুর জামায়াতের তিন নেতাকে দেখা মাত্রই নানা কথা বলতে শুরু করেন। একপর্যায়ে মুজাহিদ বলেন, 'সাইদুর সাহেব, এসব কী বলতে শুরু করেছেন?' উত্তরে সাইদুর বলেন, 'কেন, ভুলে গেছেন, ১৯৯১ সালে জামায়াত অফিসের দোতলায় কী বলেছিলেন আপনি?' মুজাহিদ বলেন, 'আপনার সঙ্গে আমার সর্বশেষ কবে দেখা হয়েছে তাই তো খেয়াল নাই।' সাইদুর বলেন, 'ওই যে সময় আপনি বলেছিলেন, একাত্তরে জামায়াতের কাজের মধ্যে সমন্বয় ছিল না। সমন্বয় থাকলে আজ জামায়াতের ওপর কেউ মাথাচাড়া দিতে পারত না। '৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের কাজকর্মগুলোও ঠিকভাবে সম্পন্ন হয়নি।' এ সময় মুজাহিদ ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, 'এসব কোনো আলাপ হয়নি আপনার সঙ্গে।' সাইদুর বলেন, 'খেয়াল করার চেষ্টা করেন, সব মনে করতে পারবেন। ওই দিন আপনি আমাকে কমলা দিয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন।' এ সময় মুজাহিদ মাথা নিচু করে থাকেন।
মুজাহিদ সাইদুরকে উদ্দেশ করে আরো বলেন, 'আপনাকে তো জামায়াত থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। আপনার সঙ্গে আলাপ করব কেন?' সাইদুর তখন ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, 'আবার মিথ্যা কথা বলছেন! আমাকে বহিষ্কার করেছেন এরকম কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারবেন আপনারা? আমার ছেলে শামীম জেএমবির বোমা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পরও তো আপনাদের সবার সঙ্গে দেখা করেছি। তখন আপনারা সবাই মিলে আমাকে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে বলেছিলেন।' সাইদুর বলেন, 'আপনারা আমাকে জঙ্গি বলেন আবার যোগাযোগ করে সাহায্য চান। আপনাদের মতো আমি না। আমার ধর্ম আছে। আমি এক ধর্মে বিশ্বাস করি। আমি জেএমবির দায়িত্ব নেওয়ার পর একটি ঘটনাও ঘটতে দিইনি। আপনারা তো ক্ষমতার জন্য সব কিছু্ই করেন। নারী নেতৃত্ব হারামের কথা বলেন, আবার ক্ষমতা পেতে নারীর পায়ের নিচে বসে থাকেন। এসবের জন্য আপনাদের জবাবদিহি করতে হবে।'
এ সময় জিজ্ঞাসাবাদকারীরা সাইদুরকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, 'আপনার সব রাগ তো দেখি মুজাহিদ সাহেবের ওপর। এর কারণ কী? সাইদুর বলেন, 'সব নষ্টের মূলে তো উনি।' জিজ্ঞাসাবাদকারীরা বলেন, নিজামী সাহেব তো তাহলে ভালো। সাইদুর দাবি করেন, 'ওনাদের সবাই এক রকম। কেউ একটু কথা বেশি বলেন, কেউ কম।' সাইদুর বলতে থাকেন, 'দুই দিন আগে কোর্ট হাজতে নিজামী সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। এ সময় তো নিজামী সাহেব আমার কাছে দোয়া চেয়ে বলেছিলেন, আপনি কি আসলেই পুলিশকে এসব বলছেন?'
দীর্ঘক্ষণ নীরবে পাশে বসে থাকা নিজামী নীরব থাকলেও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাইদুরের এসব কথা শুনে মুখ খোলেন। সাইদুরকে উদ্দেশ করে বলেন, 'এসব কী বলছেন আপনি? তখন সাইদুর আরেক দফা সাঈদীর ওপর ক্ষেপে যান। বলেন, 'আপনি বড় ওয়াজ করনেওয়ালা হয়েছেন। আপনার মধ্যে কোনো এলেম আছে নাকি! আপনার পেশাই হচ্ছে ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করা। আপনি খুলনার জাকির সাহেবের ব্যাগ টেনে টেনে এখন বড় ওয়াজ করনেওয়ালা হয়েছেন, টাকা কামিয়েছেন। এটা কি কেউ ভুলে গেছে মনে করেন?' এসব শুনে সাঈদী আর কথা বাড়াননি।
এ সময় জিজ্ঞাসাবাদকারীদের মধ্যে একজন সাঈদীর ওয়াজ করনেওয়ালা হওয়ার কাহিনী জানতে চান সাইদুরের কাছে। সাইদুর বলেন, 'সাঈদী সাহেবের কাজ ছিল খুলনার জাকির সাহেবের ব্যাগ-পোটলা টানা। জাকির সাহেব কোথাও গেলে সাঈদী ব্যাগ নিয়ে আগেই সেখানে পেঁৗছে যেতেন। কিংবা কোনো সময় জাকির সাহেবের মঞ্চে উঠতে দেরি হলে সাঈদী আগে মঞ্চে উঠে যেতেন। তিনি শ্রোতাদের কিছুক্ষণের জন্য শান্ত রাখতে ওয়াজ করতেন কিংবা জাকির সাহেব চা বা খাবার খেতে গেলে সেই ফাঁকে সাঈদী ওয়াজ করতেন। এভাবেই সাঈদী সাবেহ বড় ওয়াজ করনেওয়ালা হয়ে গেছেন। পরে জাকির সাহেবেরও সঙ্গে সাঈদী বেইমানি করেছেন। আসলে গলার জোরে এ পর্যন্ত আসা আর কী। সাইদুর দাবি করেন, সাঈদী অনেক সময় ওয়াজের মধ্যেও মিথ্যা কথা বলেন। উদাহরণ দিতে গিয়ে হাজারো মিথ্যা উপমা হাজির করেন।
সুত্র: দৈনিক কালের কন্ঠ