মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র - আগুনের পরশমণি
_________________________________________
সবাই কি ঘরে ফিরতে পারে ? না, সবাই মুক্তিযুদ্ধ শেষে ঘরে ফিরতে পারেনি। স্বাধীনতার নেশায় অনেকেই হারিয়ে গেছেন যুদ্ধের ভেতর । আবার যারা এসেছেন তাদের অনেকেই এসে দেখতে পাননি প্রিয়জনের মুখ । যুদ্ধ বড় অদ্ভুত, স্বাধীনতার জন্যে কতকিছু যে কেড়ে নেয় , তা সময়ের স্রোতের মানুষ জানে । তবুও অদ্ভুত স্বপ্নে বিভোর এ মানুষেরা স্বাধীনতা খোঁজে , তার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে । মৃত্যু এখানে বেঁচে থাকার আরেক নাম , আর এটাই মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ ।
সময়টা ১৯৭১ ,জলের মত রক্ত গড়াচ্ছে দেশের প্রতি জায়াগায় ।একটু বাঁচার জন্য শহরের মানুষ আশ্রয় নিচ্ছে গ্রামে , কিন্তু সেখানেও রেহাই নেই । চারপাশে হানাদার বাহিনী যেন মুখিয়ে আছে বাঙালি নিধনযজ্ঞে । ছেলে- বুড়ো , মহিলা- পুরুষ কেউই যুদ্ধের কালো ছোবল থেকে রেহাই পাচ্ছেনা । মানুষের জীবন যেন পশুর জীবনের চেয়েও কম দামি হয়ে পরেছে আর এই রকম মুহূর্তেই দেশের আপামর জনতা নামে দেশকে মুক্ত করতে । বিশেষ করে দেশকে স্বাধীন করতে তরুণ সমাজ অস্ত্র নিয়ে নামে । সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়ে মুক্তিকামী বীর মুক্তিযোদ্ধারা । গ্রামে ,শহরে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় । আর শহরে এই যুদ্ধ রুপ নেয় গেরিলা আকারে । আর শহরের গেরিলাযুদ্ধের বাস্তব রূপটাই রুপালী পর্দার ফ্রেমে তুলে ধরার এক প্রানান্তর চেষ্টা দেখিয়েছেন "আগুনের পরশমনি" ছবির মাধ্যমে জনপ্রিয় লেখক ও পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ ।
দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় , শহরের তরুণরা খণ্ড খণ্ডভাবে নেমে পড়েছে গেরিলা যুদ্ধে । বদি সেই রকমই এক গেরিলা যোদ্ধা ।দেশমাতৃকার টানে মা এবং বোনকে ঘরে রেখে সেও শামিল হয় মহান মুক্তিযুদ্ধে । চলতে থাকে তার বন্ধুদের নিয়ে তার গেরিলা অপারেশন । কখনও খণ্ড খণ্ডভাবে সাফল্য আবার কখনও আড়ালে চলে যাওয়া । এভাবেই চলতে থাকে তাদের ঢাকার গেরিলা যুদ্ধ । কখনও হানাদার বাহিনীর কাছে গেরিলা যুদ্ধার ধরা খাওয়া এবং নির্মম অত্যাচারের স্বীকার হওয়া তবু দমে যায়না মুক্তিযুদ্ধারা । পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শক্তি হ্রাসের জন্যে বরং তারা ঝাপিয়ে পড়ে এবং অবিশ্রান্তভাবে চালিয়ে যায় তাদের গেরিলা অপারেশন । কিন্তু বদির বাহিনীর লোকেরা এক অপারেশনে অনেকেই মারা যায় ,আবার কেউ ধরা পড়ে ,আর বদি আহত অবস্থায় ফেরে তার গোপন আশ্রয়স্থলে । অসম্ভব যন্ত্রনায় সে ভুগতে থাকে কিন্তু বদি কি দেখতে পারবে স্বাধীন দেশের নতুন সূর্য , সেকি বাঁচবে ? সেকি নিতে পারবে স্বাধীন দেশে বেঁচে থেকে শ্বাস । এইরকম যুদ্ধের কাহিনী নিয়ে "আগুনের পরশমণি'র ছবির গল্প।
ছবির নির্মাণশৈলী , কাহিনীর আবর্তন, ছবির লোকেশন নির্বাচন সবই এক কথায় চমৎকার । মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা অপারেশনগুলো কেমন ছিল তা আমরা যারা যুদ্ধ দেখিনি তাদের কাছে এই ছবি দেখলে সহজেই অনুমেয় হবে ।এক কথায় শহরের মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত এই ছবি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে নিঃসন্দেহে এক দারুণ মাইলফলক ছবি । আর সুন্দর উপস্থাপনের মাধ্যমে দর্শকদের হৃদয়ও দখল করে নিয়েছে এই ছবি ।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের মানুষ কি রকম অবস্থায় ছিল , কি ঘটেছিল সেই সময়ে আমাদের দেশের মানুষগুলোর জীবনে আর কিভাবে দেশমাতৃকার টানে তারা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল তার এক চলমান দৃশ্য ফুটে উঠেছে এই ছবির মাধ্যমে । মানুষের বেঁচে থাকার আকুতি , ঘৃণিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার সব উঠে এসেছে এক এক করে ছবির এক দৃশ্যায়নের মাধ্যমে ।এ যেন তখনকার সময়ে মানুষের জীবনের এক মুক্তিযুদ্ধ ।
জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ এর লেখা অবলম্বনে তিনি নিজেই ছবিটি পরিচালনা করেন । এটি ওনার প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নির্মিত চলচ্চিত্র । ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৯৫ সালে । এতে অভিনয় করেছেন-আসাদুজ্জামান নূর, বিপাশা হায়াত, আবুল হায়াত ,ডলি জহুর সহ আরো অনেকে।খুবই অল্প বাজেটের তৈরি একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র কিন্তু তাতে যে মুন্সিয়ানা দেখানো হয়েছে তা অনায়াসে প্রশংসার দাবি রাখে । ভাবনা অনেক বড় একটা বিষয় , চিন্তাগুলোকে অনেক পরিস্ফুটিত করে তুলে । যুদ্ধের সময়ের একটা গল্প যে মানুষকে কতটা জীবন্ত সময়ের কাছে নিয়ে যায় তারই এক জ্বলন্ত প্রমাণ "আগুনের পরশমণি" ।
___________________________________________
মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত চলচ্চিত্রঃ একাত্তরের যীশু
_______________________________________
অঝোরে কাঁদছে গির্জার কেয়ারটেকার ডেসমন্ড । সেই কান্না ছাপিয়ে যাচ্ছে ছোট্ট জেলেপল্লী কুমারগঞ্জের আকাশ-বাতাস । কিন্তু সেই কান্নাতো পৌঁছায়না কোন মানুষের কাছে । ছোট্ট এ জেলেদের গ্রামে ডেসমন্ড ব্যতীত এখন আর কোন মানুষ নেই, বেশিরভাগই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে । আর যারা কিছুক্ষণ আগেও তার সঙ্গে ছিল, তাদের কেউই এখন বেঁচে নেই । বেঁচে থাকা মানেতো এক অদ্ভুত আলেয়ার পেছনে ছুটা, নিজের মাটিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় হন্যে হয়ে জীবনকে খোঁজা । আর সেই সুন্দর জীবনটা পাওয়ার স্বপ্নে মানুষকে জীবনটাই বিলিয়ে দিতে হয় । মরে গিয়েও মানুষ বেঁচে থাকে, নিজের স্বপ্ন, ভালোবাসা-দেশপ্রেম বেঁচে থাকে অন্যের মাঝে। স্বাধীনতার লাল সূর্য সবাই দেখে যেতে পারেনা, কিন্তু সেই স্বাধীনতার পেছনে মানুষ ছুটে চলে, সেই স্বাধীনতার স্বাদ পেতে চায় । আর তাই মানুষ ভয় পায়না সেই স্বাধীনতার জন্যে উৎসর্গ করতে নিজের জীবন । ‘একাত্তরের যীশু’ চলচ্চিত্র আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জেগে ওঠার গল্প । একটা দেশ একটা স্বাধীনতার জন্যে মানুষের মনের আকুতি ফুটে উঠেছে এ চলচ্চিত্রজুড়ে । মানুষ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভাবে শেষ মুহূর্তে হয়ত সে ঠিক ঠিক বেঁচে যাবে । কিন্তু যুদ্ধের সময় সবার কী আর ঘরে ফেরা হয়? স্বাধীনতার মূল্য অনেক, আর সেই স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগের স্বপ্নে বিভোর মানুষগুলোর কাউকে না কাউকেতো মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেই হয়, করতে হয় ত্যাগ স্বীকার ।
ছোট্ট জেলেপল্লী কুমারগঞ্জের বেশিরভাগ মানুষ খ্রিস্টান । তাদের প্রধান পেশা মাছ ধরে হাটে বিক্রি করা । সেই গ্রামে একটা গির্জা আছে । প্রতি রোববার সকালে গির্জার কেয়ারটেকার ডেসমন্ডের ঘণ্টা বাজানোর শব্দে গ্রামের মানুষ সেখানে ভীড় জমাতেন । গীর্জার ফাদার তাদেরকে যীশুর গল্প শোনাতেন বাইবেল থেকে । অবসর সময়ে ডেসমন্ড ক্রুশ বানাতেন আর তাতে রঙ মাখাতেন। ছিমছাম এই পল্লীর মানুষ নিভৃতেই জীবন-যাপন করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দেশজুড়ে একসময় যুদ্ধের দামামা বেজে উঠে । সেই যুদ্ধের হাওয়া এসে লাগে কুমারগঞ্জেও। শহর থেকে মানুষ আসতে শুরু করে দলে দলে । ক্ষুধার্ত–অসুস্থ মানুষগুলোকে সেবা দেয়ার জন্যে এগিয়ে আসে গ্রামের মাস্টার ও তার ছাত্ররা । গ্রামের মানুষের সহযোগিতায় তাদের জন্যে তাঁবু টানানো হয় । মাস্টার গির্জার ফাদারের কাছে যান, যেন শরণার্থী মানুষদের চিকিৎসায় সাহায্য করেন গির্জার সিস্টাররা । কিন্তু চিন্তায় পড়ে যান গির্জার ফাদার । কিন্তু ফাদার যুদ্ধে জড়াতে চান না তার গির্জাকে । তাই দ্বিধায় পড়ে যান। কিন্তু মানবতার কাছে হার মানলেন ফাদার। মানুষের সেবা করা মানে ঈশ্বরের সেবা করা । তিনি আহত মানুষের আর্তচিৎকার শুনে তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসলেন । গ্রামের মানুষ, কেয়ারটেকার ডেসমন্ড এবং সিস্টাররা চিকিৎসা এবং যাবতীয় সহযোগিতা করলেন শহর ছেড়ে আসা সেই মানুষদের । পরেরদিন আবার ছুটে চলার গল্প শুরু হয় । ভারতে আশ্রয়ের খোঁজে উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়ে যেতে থাকে শহর ছেড়ে আসা সেই অসহায় মানুষগুলো । নিজের দেশ, ভিটে-মাটি, প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে তারা পড়ি জমায় অচেনা এক দেশে, অজানা ভবিষ্যতের দিকে। শুধুমাত্র বেঁচে থাকার আশায়। সবাই চলে গেলেও একটি বাচ্চা মেয়ে থেকে যায়। মেয়েটি কিছুই বলেনা, শুধু দেখে যায়। গির্জার কেয়ারটেকার ডেসমন্ড বুঝতে পারে ছোট মেয়েটি কথা বলতে পারেনা ।
যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে, ডেসমন্ডকে ফাদার তাদের সঙ্গে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে যেতে বলে। কিন্তু ডেসমন্ড তার মাতৃভূমি ছেড়ে যেতে চায়না। ফাদার তার গির্জার সিস্টারদের নিয়ে চলে যান । পরে রয় একা ডেসবন্ড । চল্লিশটি বছর যে গির্জায় জীবন কাটিয়েছেন এক মুহূর্তের জন্যও কি তাকে ছাড়া যায়! হানাদাররা গ্রামে গ্রামে আক্রমণ করছে, চারপাশে মরছে মানুষ । ডেসমন্ড বেঁচে থাকে। গির্জায় নিয়ম করে মোমবাতি জ্বালায়, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে। আকাশের পানে চেয়ে ডেসমন্ড ঈশ্বরেকে বলে -’আমি আকাশের পানে চাহিলাম, কখন আসিবে সাহায্য।’ মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে তাড়া করতে করতে একদিন গির্জায় হানাদার বাহিনী আসে । মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকে । কিন্তু এক সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সব গোলাবারুদ শেষ হয়ে যায় । একে একে সবাই ধরা পরতে থাকে। হানাদাররা কেয়ারটেকার ডেসমন্ডকে এই মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে । কিন্তু তাদেরকে চিনতে অপারগতা প্রকাশ করে ডেসমন্ড। ডেসমন্ডের সামনে একে একে সবাইকে ক্রুশবিদ্ধ করে গির্জার মাঠে টানিয়ে দেয়া হয় । অথচ এতদিন এই মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ডেসমন্ড আশ্রয় দিয়েছিল । চরম এক অনুশোচনাবোধ ও পাপবোধে ভুগতে থাকে ডেসমন্ড । চোখের সামনে দেখতে থাকে এতদিনের পরিচিত মুখগুলোর করুণ পরিণতি । সময় যেন থমকে যায়, চারপাশে নিস্তব্ধতা । স্বাধীনতার এত মূল্য !!!
শাহরিয়ার কবিরের উপন্যাস অবলম্বনে ‘একাত্তরের যীশু’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। চলচ্চিত্রে গির্জার ফাদার চরিত্রে অভিনয় করেছেন পীযূষ বন্দোপাধ্যায়, গির্জার কেয়ারটেকার ডেসমন্ডের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন হুমায়ুন ফরীদি। তাদের অসাধারণ সাবলীল অভিনয় দক্ষতা চলচ্চিত্রটিকে দিয়েছে গভীর প্রাণ । ক্রুশবিদ্ধ তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের আকুতি যখন ডেসমন্ডের মনকে যখন স্পর্শ করে যায় ,তখন সৃষ্টি হয় গভীর এক আত্মউপলব্ধির পরাজয় । ডেসমন্ড আজ যেন পরাজিত সময়ের কাছে । চলচ্চিত্রের অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন জহির উদ্দিন পিয়াল, আবুল খায়ের, কামাল বায়েজিদ, শহীদুজ্জামান সেলিম, শতদল বড়ুয়া বিলু, সাইফুদ্দিন আহমেদ দুলাল, ইউসুফ খসরুসহ আরও অনেকে । ফ্রেমে মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্যায়ন নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন বেবী ইসলাম । একশো মিনিট দৈর্ঘ্যের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এ চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছে অনুপম চিত্রয়ন ট্রাস্ট । ছবিটিতে সুর সৃষ্টির দায়িত্ব পালন করেছেন শিমুল ইউসুফ।
চলচ্চিত্র মানুষকে অনেক গভীরে নিয়ে যায় । জীবনের দুঃখবোধগুলো দারুণভাবে স্পর্শ করে । সমূলে টান দেয় অনুভূতির শেকড়ে । ‘একাত্তরের যীশু’ চলচ্চিত্রটি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের চিত্রকেই তুলে ধরেছে সেলুলয়েডে । একটা যুদ্ধে কত মানুষ প্রাণ হারায়, কত মানুষ হারিয়ে ফেলে আপনজনকে, মানুষের জীবন কতটা বিপন্ন হয় একাত্তরের যীশু তারই একটি প্রতিচ্ছবি। একটা গ্রামকে কেন্দ্র করেই ‘একাত্তরের যীশু’ চলচ্চিত্র তুলে এনেছে আমাদের স্বাধীনতার গল্প, আত্মত্যাগের গল্প। সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের একখণ্ড চমৎকার দৃশ্যায়ন । অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংলাপ, রূপসজ্জা সবকিছুই প্রাণ খুঁজেছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের । এ ছবির প্রতিটি মূহুর্ত অনেক বেশি জীবন্ত । একেকটি মূহূর্ত যেন ছুঁয়ে গেছে গভীরের মর্মবেদনা। যুদ্ধের কথকতা, যুদ্ধের সময়ের মানুষের বাস্তবতা । চমৎকার এক সার্থকতা দেখিয়েছেন ‘একাত্তরের যীশু’ চলচ্চিত্র নির্মাণে পরিচালক নাসিরউদ্দিন ইউসুফ ।
চলচ্চিত্রটির সংলাপ লেখার জন্য সেলিম আর দীন ১৯৯৩ সালে শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৯৩ সালে এডিনবার্গ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, ১৯৯৪ সালে ব্রিসবেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এবং ১৯৯৪ সালে লন্ডন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করে ও পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হয়।
___________________________________________________________
মুক্তিযুদ্ধের ভেতরের গল্পঃ শ্যামল ছায়া
________________________________
মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত হুমায়ুন আহমেদের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র “শ্যামল ছায়া” । তার নিজের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে বাংলাদেশের এই জনপ্রিয় সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার হুমায়ুন আহমেদ ২০০৪ সালে নির্মাণ করেন “শ্যামল ছায়া” চলচ্চিত্রটি । যেখানে চলচ্চিত্রের ভাষায় তিনি তুলে ধরেছেন ১৯৭১ সালের কিছু মুক্তিকামী মানুষের কথা ও চেতনা , তাদের মর্মস্পর্শী জীবনকাহিনী, তাদের আনন্দ-বেদনা,হাসি-কান্না , দুঃখবোধ এবং আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস । চলচ্চিত্রটি ২০০৬ সালে "সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র" বিভাগে একাডেমি পুরস্কার এর জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল ।
সময়টা ১৯৭১ সাল , ২৫শে মার্চের কালরাত্রিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বর্বর পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর । গুলির সাথে লাশ পড়ছে চারিদিকে। দিগ্বিদিক মানুষ ছুটছে একটা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে । কিন্তু কোথাও একটা নিরাপদ আশ্রয়ের দেখা নেই । আজ এখানেতো মানুষ কাল আরেক জায়গায় । ঠিকানাবিহীন এক গন্তব্যের উদ্দ্যেশে ছুটে চলছে বৃদ্ধ থেকে শুরু করে মহিলা ,শিশু , যুবক , তরুণ সকলে । শুধু খোঁজ একটা নিরাপদ আশ্রয় আর বেঁচে থাকা । অপরদিকে আরেকদল মুক্তিকামী লোক নেমেছে নিজেদের মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে ।তার জন্যে হাতে তুলে নিয়েছে তারা অস্ত্র । সেই মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধাদের দলে আছে কৃষক,শ্রমিক, ছাত্র , সাধারণ মানুষ । কিন্তু স্বাধীনতার স্বাদ কি পাবে এই মানুষগুলো ? যেখানে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হানাদার বাহিনী । তবুও মুক্তিকামী সেই মানুষগুলোর অদম্য আশা স্বাধীনতার স্বপ্নকে সত্য করতে ।
একদল মানুষ ছুটে চলছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে । নৌকায় করে তারা যাচ্ছে মুক্তাঞ্চলের খোঁজে । এক ঠিকানাবিহীন গন্তব্যে তাদের ছোটা , যেখানে তারা কিছুক্ষণ পরও বেঁচে থাকবে কিনা তার অনিশ্চিত সম্ভাবনা । তবু মানুষগুলো নৌকায় করে যাচ্ছে যুদ্ধময় সময়টা পাড়ি দিয়ে । তারা খুঁজছে একটু মুক্তির আলো , যেখানে একদণ্ড নিঃশ্বাস নিতে পারবে তারা প্রাণভরে । হিন্দু-মুসলমান বিভিন্ন ধর্মের মানুষ একই নৌকার যাত্রী । সবার চোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন , মুক্তির আশা । কিন্তু ভিটেমাটি ছেড়ে যাওয়া মানুষগুলোও সম্মুখীন হয় হানাদারদের কবলে । আবার সেই নৌকাতেই যাত্রী হয়ে আসে একদল মুক্তিযোদ্ধা । যাদের একটাই অঙ্গীকার । যেকোন মূল্যে তারা তাদের জন্মভূমিকে শত্রুমুক্ত করবে । আর তার জন্যে তারা গায়েন দলের বেশ ধরে । একসময় সেই নৌকার সাধারণ মানুষগুলোও জড়িয়ে যায় এই গায়েন মুক্তিযোদ্ধা দলের সাথে যুদ্ধে । যেখানে যুদ্ধের ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল মানুষগুলো , সেখানে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে সেই নিরীহ মানুষগুলোর কেউ কেউ নিজের জীবন উৎসর্গ করতে এগিয়ে আসে । আসলে মুক্তিযুদ্ধ যেমন একটা স্বাধীন দেশ দিয়েছিল আমাদের , ঠিক তেমনি কেড়ে নিয়েছে অনেক মানুষের প্রাণ ।
চলচ্চিত্রে সেই নৌকা কিংবা নৌকার মানুষগুলোর মাধ্যমে যেন মুক্তিযুদ্ধের এক প্রতীকী দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে । যেখানে কাল , ধর্ম , মানুষের চিন্তা সবকিছু এক কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে । যেখানে মানুষগুলো ভিন্ন ধর্মের হয়েও একই আত্নার হয়ে গেছে । যেন অনেকদিনের পরিচিত কোন আত্নীয় । যেখানে মৌলোভী রিয়াজও প্রতিবাদী হয়ে উঠে। আর হিন্দু রমণী জড়িয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের সাথে । ১১০ মিনিটের এই চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের পরিবেশ , সময়কে তুলে ধরে দারুণভাবে ফ্রেমে বন্দী করেছেন ছবির পরিচালক হুমায়ুন আহমেদ । যুদ্ধের করুণতম মর্মস্পর্শী সময়েকে যেন দারুণভাবে জানান দিয়েছে ছবির প্রতিটি মুহূর্ত ।
চলচ্চিত্রটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন- হুমায়ুন ফরীদি,রিয়াজ, শাওন ,শিমুল ,স্বাধীন খসরু, সৈয়দ আখতার আলী, তানিয়া আহমেদ, আহমেদ রুবেল, এজাজুল ইসলাম,শামীমা নাজনীন,জেসমিন পারভেজ । চিত্রগ্রহনে ছিলেন- আনোয়ার হোসেন, সঙ্গীত পরিচালনা করেন মাকসুদ জামিল মিন্টু । ছবির প্রযোজনায় ছিল – ইমপ্রেস টেলিফিল্ম ।
বিজয়ের শুভেচ্ছা বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ২৫ টি চলচ্চিত্র ডাউনলোড লিংক ! ! ! !
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:০২