এনিমেশন শিল্পের উদ্ভাবক ওয়াল্ট ডিজনি’র হাত ধরেই এনিমেশন আজকের এই অবস্থানে এসে পৌঁছিয়েছে । তার হাতে তৈরি বিখ্যাত ‘মিকি মাউস’,’পিনোকি’ ‘ডোনাল্ড ডাক’ এর মত এনিমেটেড কার্টুন ফিল্ম দিয়েই এনিমেশন কার্টুন ফিল্মে র শুরু । তিনি ১৯২৯ সালে 'মিকি মাউস' কার্টুন চরিত্রের সৃষ্টি করেন ।তার দীর্ঘ সাধনাই মিকি মাউসকে জীবন্ত চরিত্র দান করে নির্মাণ করেন কার্টুন চলচ্চিত্র।আর এভাবেই মূলত এনিমেশন এর যাত্রা শুরু হয়।
এনিমেশন শব্দটি লাতিন শব্দ ‘এনিমা’ থেকে এসেছে।এর অর্থ হল- ‘সোল’ বা আত্মা। পর্দায় কোন একটি জড় বস্তু বা চরিত্রকে চলমান কোন চিত্রে জীবন বা রূপদান দেওয়াকে এনিমেশন বলা হয়। আর এই জীবন দানের কাজটি যারা করে থাকে তাদের এনিমেটর বলা হয়।
এনিমেশনের ধরণ
এনিমেশন বেশ কয়েক ধরণের আছে । টু-ডি সেল এনিমেশন , থ্রি-ডি সিজিআই এনিমেশন, থ্রি-ডি মোশন ক্যাপচার এনিমেশন,ভিজুয়াল এফেক্টস, ক্লে এনিমেশন প্রভৃতি ধরণের এনিমেশন।
টু-ডি সেল এনিমেশন :
সবচেয়ে পুরনো ধরনের পদ্ধতির এনিমেশন এটি। যে বস্তু বা চরিত্রের এনিমেশন করা হবে তার সকল প্রকার ধাপের পরপর অনেকগুলো ছবি আঁকা শেষ করে তাকে সেলুলয়েডের মাধ্যমে এই পদ্ধতিতে কাজে লাগিয়ে পরিবর্তিত রূপ দেওয়া হয়।‘মিকিমাউস’ এই পদ্ধতিতে কাজে লাগিয়ে পরিচালিত হত।
থ্রি-ডি সিজিআই এনিমেশন :
এটি সফটওয়্যার নির্ভর এনিমশেন পদ্ধতি।এতে প্রথমে বিভিন্ন রকমের বাঁকানো রেখার সাহায্যে প্রথমে কোন একটি ছবির কিছু অংশ (কম্পিউটার জেনারেটর ইমেজারি) দিয়ে আঁকতে হবে।এরপর ছবিটিকে ওই সফটওয়্যারের সাহায্যে ত্রিমাত্রিক এনিমেশন রূপ দেওয়া হয়।বিখ্যাত পিক্সার স্টুডিও’র ‘আপ’ ও ‘টয় স্টোরি’ -এর মতো হলিউডের বিখ্যাত এনিমেশন ফিল্মলগুলো এই পদ্ধতিতেই তৈরি করা হয়েছে।
থ্রি-ডি মোশন ক্যাপচার এনিমেশন:
অনেক সময় ত্রিমাত্রিক বস্তু বা চরিত্র তৈরি করে তাকে এনিমেট করতে এই পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়। কোন একজন ব্যক্তির গায়ে একটি সেন্সর লাগিয়ে তার নড়াচড়াকে কম্পিউটারের সাহায্যে ওই ত্রিমাত্রিক বস্তু বা চরিত্রের নড়াচড়ার কাজে লাগানো হয়।‘জনপ্রিয় ছবি ‘লর্ড অব দ্য রিংস’ সিরিজে ‘গোলাম’ চরিত্রটিকে এই পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়েছিল ও তাকে এভাবেই পরিচালিত করা হয়েছিল। হলিউডের জনপ্রিয় ছবি‘আভাটার’তেও থ্রিডি এনিমেশন ব্যবহার করা হয়েছে। যাতে থ্রিডি এনিমেশন এর চমৎকার ব্যবহার করা হয়েছে। যা তার নজরকাড়া এনিমেশের জন্যে বিখ্যাত হয়ে রবে।এছাড়া বিশ্বখ্যাত কমিক বুকের প্রধান চরিত্র টিনটিনকে খুব শিগগিরই থ্রিডি পর্যায়ে দেখা যাবে বড়পর্দায়। ওয়েটা নামের একটি স্টুডিওতে খ্যাতিমান পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ টিনটিনকে নিয়ে ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চারস্ অব টিনটিন’ নামে থ্রি ডাইমেনশন ফিল্ম তৈরি করছেন।ছবিটিতে থাকছে সর্বাধুনিক ডিজিটাল ক্যারেক্টার অ্যানিমেশনের প্রয়োগ।
ভিজুয়াল এফেক্টস :
অ্যানিমেশন এবং মাল্টিমিডিয়া স্পেশালিস্টরা আজকাল ভিজুয়াল এফেক্টসকেও তাদের কাজে ব্যবহার করছেন। সাধারণত স্বল্পদৈর্ঘ্যের কোনো অ্যানিমেশন বা স্পেশাল এফেক্টস তৈরিতে এটি ব্যবহার করা হয়।বলিউডের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র রা’ওয়ান এবং হ্যারি পটার’ সিরিজের চলচ্চিত্রের বেশ অনেকগুলো স্পেশাল এফেক্ট এই পদ্ধতিতে তৈরি হয়েছে । এই স্পেশাল এফেক্টের কারনেই ছবিগুলো আমাদের কাছে অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।যাতে বিভিন্ন এফেক্টগুলো আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে।
ক্লে এনিমেশন :
ক্লে এনিমেশন এমন একটি পদ্ধতি যাতে সিন্থেটিক ক্লে-র সাহায্যে চরিত্র তৈরি করে তার নড়াচড়ার পরপর অনেকগুলো ছবি তোলা হয় । এতে অনেক সময় এক সেকেন্ডের একটি নড়াচড়ার জন্যে বিশ থেকে পঁচিশটি ফ্রেমে ছবি নিতে হয়। আর এই ছবিগুলোকেই পরপর সাজিনোর পর হয়ে উঠে এক একটি ক্লে এনিমেশন। যেমন বলিউডের জনপ্রিয় শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘তারে জমিন পার’তে এই ক্লে পদ্ধতির এনিমেশন ব্যবহার কর হয়েছে।
বাংলাদেশে এনিমেশন
বাংলাদেশে ১৯৯৯ সালে ”মানব কঙ্কালের ঢাকা ভ্রমন” নামে একটি এনিমেশন তৈরী করে। যা সে সময়ে ইত্যাদিতে প্রচার করা হয়েছিল। এটি আমাদের দেশের ত্রিমাত্রিক নামের একটি এনিমেশন স্টুডিও তৈরি করেছিল। এছাড়া বেশ কয়েক বছর আগে ঈদ উপলক্ষ্যে“মন্টু মিয়ার অভিযান” নামে একটি এনিমেশন ছবি টিভিতে প্রচার করা হয়েছিল , যা তখন অনেক জনপ্রিয় হয়েছিল। এছাড়া আমাদের দেশে ইদানীং অনেক কার্টুন তৈরি করা হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে শিশুদের বিভিন্নভাবে খেলারছলে শিখতে আগ্রহী করে তোলা হচ্ছে।
পিক্সার এর তৈরি কয়েকটি এনিমেশন ফিল্ম :
১। টয় স্টোরী – ১৯৯৫ সাল।
২। এ বাগ’স লাইফ – ১৯৯৮ সাল।
৩। টয় স্টোরী ২ – ১৯৯৯ সাল।
৪। মনষ্টার ইনক্ – ২০০১সাল।
৫। ফাইন্ডিং নিমো – ২০০৩সাল।
৬। দ্যা ইনিক্রিডিবল – ২০০৪সাল।
৭। কার’স – ২০০৬সাল।
৮। রাট্যাটোউলি - ২০০৭সাল।
৯। ওয়ালই - ২০০৮সাল।
১০। আপ – ২০০৯সাল।
১১।টয় স্টোরী ৩ -২০১০সাল।
ডিজনির অস্কার পাওয়া এনিমেশন "ফ্রোজেন"
বাংলাদেশে করা এনিমেশনগুলার মধ্যে এখন পর্যন্ত সেরা হচ্ছে -মন্টু মিয়ার অভিযান , লেখক মুহাম্মদ জাফর ইকবালের লেখা গল্প অবলম্বনে "ত্রাতুলের জগত" ,"মুরগি কেন মিউট্যান্ট" ।
কিছু বাংলাদেশি এনিমেশন ফার্ম - টুন বাংলা , ম্যাজিক ইমেজ , অরা ।
এক বাংলাদেশীর কৃতিত্বঃ
নাফিস বিন জাফর হচ্ছেন প্রথম বাংলাদেশী যিনি যুক্তরাষ্ট্রের একাডেমী অফ মোশন পিকচার আর্টস এন্ড সাইন্স বিভাগে অস্কার পেয়েছেন হলিউড ব্লকবাস্টার ফিল্ম পাইরেটস অব দ্য ক্যারাবিয়ান: এ্যাট ওয়ার্ল্ড এ্যান্ড এ ফ্লুইড ডাইনামিক্সের অসাধারন কাজ করার জন্য। এই এওয়ার্ড টি তিনি তার আরো দুজন সহকর্মী ডগ রুবেল ও রিও সাকাগুচির সাথে পান।
এনিমেশন নিয়ে আমাদের কাছের দেশ মালয়েশিয়াতে ভালো লেখাপড়া করানো হয় । কম খরচে ইচ্ছে থাকলে ওইখান থেকে পড়ে আসতে পারেন ।। জাপানে এনিমেশনের ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা যায়, এশিয়ার একটি দেশ । বাংলাদেশের ড্যাফোডিলে এনিমেশন এর ওপর লেখাপড়া হয় ।
বাংলাদেশে অনুষ্ঠান নির্মাতা হানিফ সংকেত প্যাকেজ অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে তার নির্মিত "ইত্যাদি" অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রথম গ্রাফিক্স এবং এনিমেশনের ব্যবহার শুরু করেন । শিল্পী রফিকুন্নবী(রনবীর) এর বিখ্যাত "টোকাই" এর মাধ্যমে এনিমেশনের যাত্রা শুরু করেন ।
বর্তমানে দেশিও বিভিন্ন বিজ্ঞাপনেও এনিমেশনের আধিক্য বাড়ছে ।
এভাবে এনিমেশন জগত বিস্তৃত হয়ে চলেছে বিশ্বে ।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০১৪ সকাল ১১:৪২