মক্কার মানুষ নাকি হজ্ব করতে পারে না। আমাদের অবস্থা হয়েছে সে রকম। সারা দেশ থেকে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষেরা যখন মৌলভিবাজারের রাজকান্দি বনে তিন ঘন্টা ট্র্যাকিং করে হামহাম জলপ্রপাত দেখে আসছে আমরা তখন খোদ সিলেটে বসে আঙ্গুল চুষছিলাম। ফেসবুকে, ব্লগে, পত্রিকায়, টিভিতে বীরদের সেই বীরত্বগাঁথার সচিত্র বর্ণনা দেখে আমরা ৫ স্কুল বন্ধু এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে মেধাবী ছাত্র হওয়ার আগে আমাদেরও বাড়ির কাছের এই ঝর্ণাটা দেখে আসা উচিত। বন্ধুদের মধ্যে একজন আবার এই ব্লগেই আছে!
আজ যাব কাল যাব করতে করতে চলে আসে রমজান মাস। রোজা রেখে জঙ্গলের মধ্যে ৬ ঘন্টা ট্র্যাকিং করার সাহস আমরা কেউ দেখালাম না। ঠিক হলো ঈদের ছুটিতেই আমরা হামহাম যাচ্ছি। ঈদের দিন সন্ধ্যায় নিসর্গের ট্যুরিস্ট গাইড শ্যামল ত্রিপুরাকে ফোন দিয়ে জেনে নিলাম প্রয়োজনীয় তথ্যাদি। তার কথামত আমরা ঈদের দ্বিতীয় দিন রাতে সিলেট থেকে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
শ্রীমঙ্গলে যখন পৌছালাম রাত তখন ১০টা। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। বাস থেকে নেমেই দেখি আপেল মামা তিনটা ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। বাস স্ট্যান্ডের পাশেই মামার বাসা। বাসায় গিয়ে দেখি মামী আমাদের জন্য টেবিলে রাতের খাবার সাজিয়ে ফেলেছেন। খাওয়া শেষ করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম। পরের দিন ভোর সাড়ে ৪ টায় উঠতে হবে ঘুম থেকে। জীপ বাসার সামনে আসবে ভোর পৌনে ৫ টায়। সারাদিনে বনের মধ্যে হাঁটতে হবে প্রায় ৬ ঘন্টা। তাই ঘুমানোটা বেশ জরুরি। কিন্তু এর আগে যতবার আমরা একসাথে রাত কাটিয়েছি কোনবারই দেড়-দুই ঘন্টার বেশি ঘুমাতে পারি নাই। এইবারও এর ব্যতিক্রম হয় নাই।
ভোর ৪.৩০ মিনিটে একসাথে ৫টা মোবাইলে ৫ ধরণের অ্যালার্ম বেজে উঠল। সে এক বিচিত্র সুর মূর্ছনা। আমরা হাতমুখ ধুতে না ধুতেই শ্যামল ত্রিপুরা ফোন করল, সে জীপ নিয়ে বাসার গেটের সামনে অপেক্ষা করছে। ভোর ৫.১৫ মিনিটে জীপ আমাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করলো। ছোট্ট শহর শ্রীমঙ্গল পার হয়ে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট ও লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান কে পাশ কাটিয়ে আমাদের জীপ ঢুকে পড়ল একটি চা বাগানে। রাস্তা কখনো পিচ ঢালা কখনো শুধু ইট বিছানো কখনোবা মাটির।
একে একে পার হয়ে আসলাম ছবির মত সুন্দর বেশ কয়েকটা চা বাগান। জাহানারাপুর চা বাগান, মাধবপুর চা বাগান, শ্রী গোবিন্দপুর চা বাগান, কুড়মা চা বগান। ছোট ছোট পাহাড়ের গায়ে চা বাগান ছাড়াও কয়েকটি সুপারি বাগান ও আনারসের জুম চাষও দেখেছিলাম। এর আগে বেশ কয়েকবার শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ-কমলগঞ্জে আসায় দৃশ্য গুলো ছিল পরিচিত। কিন্তু তবুও কেন জানি উঁচু-নিচু সবুজের বিছানায় একমনে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। বিশেষ করে মাধবপুর চা বাগান পাড়ি দেবার সময় সূর্যোদয়ের দৃশ্যটি আমার জীবনের একটি সেরা স্মৃতি হয়ে থাকবে।
কুড়মা বাজারে সকালের নাস্তার জন্য আধাঘন্টার বিরতি শেষে আবারো জীপে চড়ে বসলাম। জীপ এবার ঢুকল চাম্পারায় চা বাগানে। সকাল ৮টায় আমরা পৌছালাম কলাবন গ্রামে। চাম্পারায় চা বাগানের চা শ্রমিকদের ছোট্ট গ্রাম কলাবন। কলাবন গ্রামের শেষপ্রান্ত থেকে রাজকান্দি সংরক্ষিত বনের এলাকা শুরু। এই বনের মধ্যেই হাঁটতে হবে আড়াই থেকে তিন ঘন্টা। তারপর দেখা মিলবে হামহাম জলপ্রপাতের। কলাবন গ্রাম থেকে আমাদের সাথে যোগ দিল সুরজিত ত্রিপুরা। সেই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। শ্যামল ত্রিপুরা লাউয়াছড়া পর্যন্ত আমাদের সাথে ছিল। সুরজিতকে নিয়ে আমরা ৫ বন্ধু ঢুকে পড়লাম রাজকান্দি বনে।
সুরজিতের হাতে ছিল একটি রামদা। বনে ঢোকার সাথে সাথেই সে আমাদের সবার হাতে বাঁশের লাঠি ধরিয়ে দিল। বাঁশের লাঠিটি উঁচু নিচু পথে ব্যালেন্স করার জন্য আর ছড়া(পাহাড়ি খাল) বা ঝিরিপথে পানির গভীরতা বা পাথরের উপস্থিতি জানার জন্য।
রাজকান্দি বনে ঢুকে প্রথমেই নজরে পড়বে বেত বন। এই ঘন বেত বন দিয়ে যাওয়া বেশ ঝক্কি-ঝামেলার ব্যাপার। বেতের কাঁটায় বারবার আমাদের জামা আটকে যাচ্ছিল। সুরজিত রামদা দিয়ে বেতের ডাল কেটে কেটে আমাদের জন্য রাস্তা করে দিচ্ছিল। আমার আরেক বন্ধু সঞ্জীব দে সঙ্গে করে একটি ধারাল চাকু নিয়ে এসেছিল। সেও সুরজিতের সাথে সাথে বেতের ডাল কাটছিল। আগের রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টি হওয়ায় মাটিতে পা দিলে পা গোড়ালি পর্যন্ত দেবে যাচ্ছিল। আমাদের ৫ বন্ধুর মধ্যে শুধু বিপুল সিংহ ট্রেইনার পড়ে এসেছিল আর আমরা বাকি ৪ জন সাধারণ জুতো। সবার জুতো ততক্ষণে কাদায় মাখামাখি। বিপুলের ট্রেইনারের ভিতরও কাদা ঢুকে পড়েছে। উপায় না দেখে সবাই জুতো হাতে নিয়ে নিলাম। এবার শুরু হলো নতুন ঝামেলা। কাদায় পা দিলেই কাদার নিচে লুকিয়ে থাকা বেতের ডালের কাঁটা পায়ে লাগছিল। এবার পার হতে হবে একটি ছড়া। রাজকান্দিতে ঢোকার সময়ও একটি ছড়া পার হতে হয় কিন্তু সেখানে দুইটা গাছের কান্ড রাখা ছিল। কিন্তু এখানে ছড়ায় নেমে পার হতে হবে। হাটু পানি ভেঙ্গে আমরা ছড়া পার হলাম। ছড়া থেকে উঠার সময় বন্ধু আলমগীর পিচ্ছিল জায়গায় পা দিয়ে আবার ছড়ার মধ্যে পড়ে যায়। পুরো রাস্তায় সে বেশ কয়েকবার আছাড় খেয়ে পড়ে। আমিও দুইবার খাই।
বেতবন পার হবার পরে বনের ঘনত্ব কিছুটা কমে যায়। পায়ে হাটা ছোট্ট পথ দিয়ে আমরা সামনে এগুতে থাকি। সুরজিতের সাথে কথা বলে জানতে পারি। বনের ভিতরে তারা খুব একটা যায় না বন্য প্রাণীর উৎপাতে। তবে ট্যুরিস্টরা যে পথ ব্যবহার করে সেখানে বন্য প্রাণীরা এখন আর আসেনা। বন্য প্রাণীর মধ্যে এই বনে আছে ভাল্লুক, বন্য শূকর, অজগর, বানর, উল্লুক। কয়েকটা চিতাবাঘও নাকি আছে।
আমরা এবার নেমে পড়লাম ছড়ায়। এই ছড়ার পানি আসছে হামহাম ঝর্ণা থেকে। তাই এই ছড়া ধরে চলে গেলেই হামহাম ঝর্ণা পাওয়া যাবে। ছড়ার বেশির ভাগ জায়গায় হাটু পানি। পানির মাঝ দিয়ে হাঁটার সময় তৈরি হওয়া ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ দুই পাশের পাড়ে ধাক্কা লেগে অদ্ভুত এক শব্দ করছিল। নদীর পানি পাড়ে আছড়ে পড়ে যেমন শব্দ করে ঠিক তেমন না অন্যরকম একটা শব্দ। কানে আসছিল নাম না পাখি এবং পতঙ্গের ডাক। ছড়ার দুই পাশে ঘন বন। যতই সামনে এগুতে থাকি বনের ঘনত্ব বাড়তে থাকে। একপাশে কলাবন আরেকপাশে বাঁশবন। যদিও লোকজন কলা খাওয়ার জন্য এদিকে পা বাড়ায় না।
আমদের ৫ জনের মধ্যে ২ জনের কাঁধে ব্যাগ ছিল তাতে ছিল শুকনো খাবার, পানি, আমদের মোবাইল, ক্যামেরা । আর দুই জনের হাতে ছিল পলিথিন তাতে ছিল সবার জুতো। কলাবন পর্যন্ত এসে সেই পলিথিন যায় ছিড়ে। আবার সবাই যার যার হাতে জুতো গুলো নিয়ে নেয়। কিন্তু এক হাতে জুতো নিয়ে পথ চলা বেশ ঝামেলা হচ্ছিল তাই আমরা হাতের জুতো গুলোকে কলা গাছের বাকল দিয়ে কোমরে বেঁধে নেই। কলাবন একসময় শেষ হয়ে গেল। এখন ছড়ার দুই পাশে উঁচু উঁচু গাছ আর বাঁশঝাড়। রাজকান্দির বনের ধরণ অনেকটা লাউয়াছড়া আর সাতছড়ির বনের মত। আমরা এগুতে থাকি ছড়ার পানি ভেঙ্গে। যেখানে ছড়ার পানির গভীরতা বেশি বা নিচে বাঁশ আছে সেখানে আমরা ছড়ার পার দিয়ে যাচ্ছিলাম এবং আলমগীর যথারীতি আছাড় খাচ্ছিল।
একঘণ্টার মতো হাঁটার পর ছড়ার দুই পাশের পাথুরে পাহাড় আস্তে আস্তে খাড়া হয়ে গেল। আর ছড়াতে বাড়তে থাকল বড় বড় পাথরের উপস্থিতি। এখানে ছড়ার পাড় বলে কিছু নেই। পাথুরে পাহাড়ের কার্ণিশ ধরে ধরে আমরা সামনে এগুতে থাকি। জায়গাটাও বেশ অন্ধকার। একসময় সামনে থাকা ফারহান চিৎকার দিয়ে উঠল। দ্রুত সামনে এগিয়ে আমিও গলা ফাটিয়ে এক চিৎকার দেই। অপূর্ব সুন্দর এক শৈলপ্রপাত আমাদের সামনে। চলল ক্লিক ক্লিক ফটোসেশন।
শৈলপ্রপাতটি পাড় হয়ে এগুতে থাকি আমরা। কোথাও সরু গিরিখাত। অন্ধকার চারপাশ। কোথাও কিছুটা খোলামেলা। সবুজের উপর আলো ঝলমল পরিবেশ।
কিছুদূর এগুনোর পরে আবার সামনে হাজির হয় আরেকটি শৈলপ্রপাত। শৈলপ্রপাতের সামনে এসে আবার আছাড় খায় আলমগীর। এবার আমরাও তার পাশে বসে পড়ি। হাত মুখ ধুয়ে নেই। সবাই দেখে নেয় কারো গায়ে জোঁক লেগেছে কিনা। টানা দুই ঘন্টা হাঁটার পর আমরা একইসাথে ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত। সঙ্গে আনা বিস্কুট ও পানি দিয়ে নাস্তা করলাম। অবশ্য শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সবার মুখেই চকলেট, চুয়িংগাম, ম্যাঙ্গোবার সবসময় কিছু না কিছু ছিল।
নাস্তা শেষ করে সামনে দেখি ছড়ার এর পরের অংশে কোমর সমান পানি। এখন কি এই দিক দিয়ে যেতে হবে কিনা সুরজিতকে সেটা জিজ্ঞেস করতেই সে হাতের ডান দিকে একটা খাঁড়া টিলা(ছোট পাহাড়) দেখিয়ে বলল এই দিক দিয়ে যেতে হবে। আমদের কোন সমস্যা না হলেও আলমগীর একটু ভয় পাচ্ছিল। আমি, ফারহান আর সুরজিত ওকে প্রায় টেনেই তুলি। সঞ্জীব আর বিপুলের কাঁধে ব্যাগ থাকায় ওরা একা একা উঠছিল। টিলাটার নাম মোকাম টিলা। গাছ বলতে শুধু বাঁশ। তবে জোঁকের জন্য ভালো নামডাক আছে। টিলায় উঠলে জোঁক ধরবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে আমাদের কারো পায়ে বা গায়ে জোঁক ধরেনি শুধু আমার পায়ে ছোট সাইজের একটা আর বেচারা আলমগীরের পায়ে বেশ বড় সাইজের দুইটা জোঁক ধরে।
টিলা থেকে নামার পথেও বেচারা........... না থাক ওর কথা আর বলবনা। মোকাম টিলা থেকে নেমে আবার ছড়া ধরে হাঁটা শুরু হলো। ছড়ার মাঝে বড় বড় পাথর। দুই পাশে খাঁড়াউঁচু টিলা। টিলার মধ্যে ঘন জঙ্গল। একপাশের টিলার একটি গাছ আরেকপাশের টিলার উপর পড়ে ওভারব্রিজের মতো তৈরি করেছে। কয়েকটা বানর এই গাছ থেকে ঐ গাছে লাফিয়ে আমাদের সাথে এগুচ্ছিল। বানরের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে গিয়ে এবার পা হড়কে পড়ে গেলাম আমি। বানর গুলো আমার দুর্দশা দেখে আমাদের পিছু নেয়া ছেড়ে দিল। এই জায়গায় হাঁটা বেশ কষ্ট সাধ্য ব্যাপার ছিল। কারণ পুরো ছড়া জুড়ে ছিল বড় বড় সব পাথর। শ্যাওলা জমে সেগুলো পিচ্ছিল হয়ে ছিল। লাঠি দিয়ে ভালভাবে গভীরতা ভালোভাবে না বুঝে পা দিলেই হয়ত দুইটা বড় পাথরের ফাঁকে পুরো পা একবারে ঢুকে যাবে। জায়গাটা ছিল অসম্ভব রকম সুন্দর। যদিও ছবি তোলার কথা আমরা একদম ভুলে গিয়েছিলাম।
মোকামটিলা থেকে নেমে ৪৫ মিনিট ছড়া দিয়ে হাঁটার পর হঠাৎ করে দুই পাশের পাহাড়দুইটা যেন দুই দিকে সরে গেল। আমরা সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠলাম হামহাআআআআম। পিচ্ছিল পাথরের কথা ভুলে দিলাম দৌড়। ঝর্ণার সামনে এসে দুই মিনিট সবাই চুপচাপ। কান পেতে শুনছিলাম উঁচু পাথুরে পাহাড় থেকে পানি পড়ার শব্দ। উপভোগ করছিলাম আনকোরা এক সৌন্দর্য। তারপর আবার সবাই একসাথে হৈ হৈ করতে করতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম হামহামের পানিতে গোসল করতে।