তিন রুম এবং সামনে খোলা বারান্দা নিয়ে ছোট্ট একটি টিনশেড বাসা। বাসাটির সামনে কিছু খালি জায়গা। খালি জায়গাটুকুর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে আড়াআড়ি ভাবে দু’টি রশি টানানো। কিছু ভেজা কাপড় টাঙানো আছে রশি দু’টিতে। নিচে অযত্নে অবহেলায় বেড়ে উঠেছে কিছু নাম না জানা লতাগুল্ম । কয়েকটি ফুলও ফুটেছে তাতে। সামনের খোলা বারান্দা থেকে গেট পর্যন্ত জায়গাটুকুতে কিছুদূর পরপর কয়েকটি ইট রাখা। বর্ষাকালে কাঁদা-পানি এড়িয়ে ঘরে ঢোকার জন্য এই ব্যবস্থা।বাসার মূল গেটটি টিনের তৈরি। ভিতর বাহির দুই দিকেই রঙ চটে যাওয়া গেটটির কয়েক জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে।
দীর্ঘ বাইশ বছর ধরে বাসাটি ভাড়া নিয়ে আছেন ইউসুফ সাহেব। অবসরপ্রাপ্ত একজন সরকারি কর্মচারি। স্ত্রী, তিন কন্যা ও এক নাতনি নিয়ে তার সংসার।
তার স্ত্রী বিয়ের পর থেকেই ঘর-দোর ও চুলা নিয়ে ব্যস্ত। কোন বিষয়ে তার কোন অভিযোগ নেই। নেই আবদারও। সংসারের জন্য খেটে চলেছেন তিনি উদয়অস্ত।
বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছিল বছর চারেক আগে। তার কোলজুড়ে ফুটফুটে এক মেয়ে শিশুও এসেছে ইতোমধ্যে। কিন্তু স্বামীর সাথে মনের মিল না থাকায় ডিভোর্স হয়ে যায়। এখন আড়াই বছরের মেয়ে আরিশাকে নিয়ে বাবার ভাড়া বাসাতেই উঠেছে ইউসুফ সাহেবের বড় মেয়ে।
ইউসুফ সাহেবের মেজ মেয়ে একটি সরকারি কলেজে বাংলায় অনার্স পড়ছে। তার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। এদিকে ছোট মেয়ে পড়ছে ইন্টারমেডিয়েটে।
এই সংসারের কনিষ্ঠতম সদস্য হলো ইউসুফ সাহেবের নাতনি আরিশা। অসম্ভব মিষ্টি চেহারার একটি শিশু। যাকে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। মা, নানা, নানি ও দুই খালার আদরে চুমুতে তার দিন কেটে যায়। তবে আরিশা সবচেয়ে বেশি ভালবাসে তার নানাভাইকে। তার যত অভিযোগ, আবদার, অভিমান, উচ্ছলতা সব তার নানাভাইকে ঘিরে। ইউসুফ সাহেবও তার একমাত্র নাতনির মুখের হাসির জন্য সবসময় প্রস্তুত।
আজ ইউসুফ সাহেবের পেনশনের চেক পাওয়ার কথা। এজন্য সকাল থেকেই তিনি বেশ খোশ মেজাজে আছেন। যদিও চেকটা পাওয়ার কথা ছিল আরো দুই মাস আগে। কিন্তু টেবিলে টেবিলে কিছু উপরি খরচ না করার জন্য তার ফাইলটি আটকে ছিল। অবশেষে বেশ কিছু টাকা পয়সা ঢালার পর আজ তার চেকটা ইস্যু হওয়ার কথা ছিল।
ইউসুফ সাহেব অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন এমন সময় তার মেজ মেয়ে ঘরে ঢুকল।
‘বাবা, ...’
‘কিছু বলবি?’
‘না মানে, আজকে তো তুমি পেনশনের টাকা পাবে।’
‘হ্যা। আজকেই তো দেওয়ার কথা।’
‘বাবা, ডিপার্টমেন্টের আমদের ইয়ার থেকে সবাই কক্সবাজার যাচ্ছে শিক্ষা সফরে। সঙ্গে স্যার-ম্যাডামরাও যাচ্ছেন।’
‘সবাই গেলে তুইও যাবি।’
‘না মানে... পাঁচ হাজার টাকা ফি দিতে হবে।’
ঘরে অদ্ভুত এক নিরবতা নেমে এলো। মেজ মেয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যেন বাবার দীনতা ও নিজের অসহায়ত্ব তাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে। ইউসুফ সাহেব ভেবে পাননা, পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে শিক্ষা সফরে কক্সবাজার নিয়ে গিয়ে তার মেয়েকে স্যার-ম্যাডামরা কি শিক্ষা দিবে।
‘যাওয়ার তারিখ কবে?’ অবশেষে নিরবতা ভাঙলেন ইউসুফ সাহেব।
‘সতের তারিখ।’ এখনো মাথা নিচু করে রেখেছে মেয়েটা।
‘এখনো তো দশ দিন বাকি আছে।’ দেয়ালে ঝুলানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে বললেন ইউসুফ সাহেব।
‘না মানে বাবা, আগামীকাল ফি জমা দেয়ার লাস্ট ডেট।’
ইউসুফ সাহেবের কাছে এখন আট হাজার টাকা আছে কিন্তু সেটা খরচ করা যাবেনা। এটা অফিসের ট্রেজারার সাহেবের জন্য।
‘ঠিক আছে, পেনশনের টাকাটা তুলে আনি। সন্ধ্যার সময় নিয়ে নিস।’
মেজ মেয়ে ঘর থেকে চলে গেল। পেনশনের এতগুলো টাকা থেকে মাত্র পাঁচ হাজার চলে গেলে এমন আহামরি কোন ক্ষতি নেই। ভাবতে লাগলেন ইউসুফ সাহেব। তাছাড়া টাকাগুলো তো তার তিন মেয়ের আনন্দ সুখের জন্যই।
‘বাবা, তুমি এখনো বের হওনি?’ ইউসুফ সাহেবের ছোট মেয়ে এবার ঘরে ঢুকল। এসেই বাবার শার্টের বোতাম লাগাতে লাগল।
‘কিরে কিছু বলবি?’
‘না কিছু না। তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে তাই আসলাম তোমাকে রেডি করে দিতে।’
‘কিছু একটা বলতে এসেছিস। কি বলবি বল।’
‘বাবা, আমার একটা বান্ধবী আছেনা মিতু নাম । দশ তারিখ ওর বোনের বিয়ে।’
‘গিফট নিয়ে আসতে হবে তো, বিয়ের আগের দিন মনে করিয়ে দিস।’
‘ইয়ে বাবা, মিতু বলছিল ওর বান্ধবীরা মানে আমরা সবাই বিয়ের দিন যেন একই রকম শাড়ি পড়ি। মিতু, ফাতেমা আর মনি মার্কেটে গিয়ে একটা শাড়ি দেখে এসেছে। বার পিস অর্ডারও দিয়ে এসেছে।’
‘দাম কত একটা শাড়ির?’
‘তিন হাজার টাকা।’
ইউসুফ সাহেব হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন কিছু সময়। সরকারি চাকুরীজীবীদের বেতন ভাতার কিছু অংশ থাকে বাড়ি ভাড়ার জন্য। কিছু অংশ থাকে চিকিৎসার জন্য। এরকম বিভিন্ন খাতের জন্য বেতন ভাতার বিভিন্ন অংশ থাকে। কিন্তু সামাজিকতা রক্ষার জন্য কি কোন টাকা দেয়া হয়। ইউসুফ সাহেব মনে করতে পারেননা। যদি সামাজিকতা রক্ষার জন্য কোন টাকা নাই দিবে তাহলে সরকারের উচিত আইন করে সব ধরণের সামাজিক অনুষ্ঠানাদি বন্ধ করে দেয়া।
‘বাবা কি চিন্তা করছো?’ ছোট মেয়ের ডাকে চিন্তায় ছেদ পড়ে ইউসুফ সাহেবের। ‘তুমি না আজকে পেনশনের টাকা পাবে। সেখান থেকে না হয় তিন হাজার টাকা দিয়ে একটা শাড়ি কিনলা আমার জন্য। আর শাড়িটা তো বিয়ের অনুষ্ঠানের পরে অন্য কোন অনুষ্ঠানেও পড়তে পারবো। আমার তো একটা ভালো শাড়িও নেই।’
‘শাড়ি ছাড়া সালোয়ার কামিজ পড়েও তো বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়া যায়। গত ঈদে না তুই বেশ সুন্দর একটা থ্রি পিস কিনলি। ওটা পড়ে যাওয়া যায় না?’
নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর একটি অদৃশ্য সংবিধান আছে। বাংলাদেশের সব নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সেই সংবিধান মেনে চলে। সেই সংবিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হলো, রোজার ঈদ ছাড়া বছরের অন্যান্য সময় নতুন কাপড় কেনা যাবেনা।
‘তুমি মেজ আপুকে পাঁচ হাজার টাকা দিচ্ছ আর আমার জন্য তিন হাজার টাকা খরচ করতে চাচ্ছনা কেন? আমি ছোট তাই কেউ আমাকে ...।’ ইউসুফ সাহেবের এই মেয়েটা একটু আহ্লাদী গোছের হয়েছে। বিয়ের পরে এসব মেয়েদের কপালে দুঃখ থাকার সম্ভাবনা শতকরা সত্তর ভাগ।
‘ঠিক আছে, সন্ধ্যার সময় টাকা নিয়ে যাস।’
‘আমাকে টাকা দিতে হবেনা। এই নাও কার্ড। এই দোকানে গিয়ে বলবে দশ তারিখের বিয়ের জন্য যে বার পিস শাড়ির অর্ডার দেয়া হয়েছিল সেখান থেকে একটা শাড়ি দেন।’ কার্ডটা ইউসুফ সাহেবের হাতে দিয়ে উনার শার্টের শেষ বোতামটা দ্রুত লাগিয়েই দৌড় দিল মেয়েটা।
ইউসুফ সাহেব ঘর থেকে বের হলেন। বারান্দায় তার নাতনি আরিশা তখন খেলনা হাড়ি-পাতিল নিয়ে রান্না-বাড়া খেলা খেলছে। ইউসুফ সাহেব আরিশাকে কোলে নিয়ে তার দুই গালে দুই চুমু দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, নানাভাই বাজার থেকে তোমার জন্য কিছু আনতে হবে?’
‘নাহ। আমার কাছে সব আছে। চাল আছে, ডাল আছে, ডিম আছে, মাছ আছে। দেখছো না চুলায় রান্না চড়িয়েছি।’ আধো আধো গলায় বলল আরিশা।
‘ঠিক আছে, তুমি রান্না শেষ করো তারপর আমাকে খেতে দিও।’ নাতনিকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন ইউসুফ সাহেব।
গেট খোলার আগেই পেছন থেকে আরিশা বলল, ‘নানা ভাই, আমার জন্য দুইটা বেলুন আনবে। একটা লাল রঙের আরেকটা নীল রঙের। আমরা দু’জন মিলে খেলবো।’
‘ঠিক আছে নানাভাই।’ ইউসুফ সাহেব মৃদু হেসে তার ভাড়া বাসার সীমানার বাইরে পা রাখলেন।
মাথার উপরে পাকিস্তান আমলের একটা ফ্যান ক্রমাগত ঘটর ঘটর শব্দ করে ঘুরছে। ঘরের ভেতরকার সব আসবাব পত্রই কমবেশি ত্রিশ-চল্লিশ বছরের পুরনো। শুধু টেবিলের পেছনের মানুষটি নতুন।
ইউসুফ সাহেব সপ্তাহ দুয়েক আগেও এখানে এসেছেন। তখন ঐ চেয়ারে ট্রেজারার ময়নুল আহমদ বসতেন। উনি পাঁচ দিন আগে বদলি হয়ে গেছেন। তার জায়গায় সিলেট থেকে এসেছেন আরেকজন। নতুন ট্রেজারারের নাম মো. হারুনুর রশীদ। টাক মাথা। খাটো মতো লোক।
‘স্যার, আগের ট্রেজারার ময়নুল স্যারের সাথে আমার আগেও কিছু লেনদেন হয়েছে। উনি বলেছিলেন বিশ হাজার টাকা দিলে ফাইল ছেড়ে দিবেন। আমি দুই সপ্তাহ আগে উনাকে বার হাজার টাকা দিয়েছি, আজ বাকি আট হাজার টাকা নিয়ে এসেছি। এখন নতুন করে আরো বার হাজার টাকা জোগাড় করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
‘আপনি পেনশনের এতগুলো টাকা পাবেন আর আমাদেরকে মিষ্টি খাওয়ার জন্য কিছু টাকা দেয়া আপনার পক্ষে সম্ভব না এটা কেমন কথা।’
‘স্যার, আগের স্যারের জন্য আজ যে আট হাজার টাকা এনেছি এটা আপনি রেখে দেন।’
‘আগের ট্রেজারার আপনার ফাইল ইস্যু না করেই বার হাজার টাকা নিয়ে বদলি হয়ে গেল এদিকে আমি আপনার ফাইল ইস্যু করব আর আপনি আমাকে মাত্র আট হাজার দিবেন! এটা কেমন ইনসাফের কথা বললেন?’
‘স্যার,এমনিতেই আমি অনেক দেনার মধ্যে পড়ে গেছি। আজকে পেনশনের টাকা তুলে সবার দেনা শোধ করার কথা। এখন নতুন করে কেউ আমাকে বার হাজার টাকা ধার দিবেনা।’
‘আচ্ছা আপনার ঐ আট হাজার টাকাটা দেন।’
সুবোধ বালকের মতো ইউসুফ সাহেব টাকাটা বের করে দিলেন।
‘আপনি আগামীকাল সকালে আরো দশ হাজার টাকা নিয়ে আসবেন। দুই হাজার টাকা আমি মাইনাস করলাম। যদিও এটা কেমন কেমন দেখায়।’ টাকা গোনা শেষ করে বললেন হারুনুর রশীদ। ‘আপনি এখন আসতে পারেন। আমি আপনাকে আর সময় দিতে পারছিনা। এখন আমাকে ডিরেক্টর স্যারের রুমে যেতে হবে।’
শহরের ব্যস্ত রাস্তা। সবাই ছুটছে নিজের স্বার্থে। পুরো দুনিয়াটা ইউসুফ সাহেবের কাছে স্বার্থপর মনে হয়। পকেটে হাত দিয়ে দেখেন তেত্রিশ টাকা আছে মাত্র। এই টাকা দিয়ে না পারবেন মেজ মেয়ের শিক্ষা সফরের ফি দিতে না পারবেন ছোট মেয়ের জন্য শাড়ি কিনে নিয়ে যেতে।
‘আচ্ছা তেত্রিশ টাকা দিয়ে কি বিষ কিনতে পাওয়া যাবে?’ মনে মনে ভাবেন ইউসুফ সাহেব, ‘ যে বিষ খাওয়ার সাথে সাথে এই নিষ্ঠুর জগৎ সংসার থেকে মুক্তি মিলবে।’
ইউসুফ সাহেব পাগলের মতো ডানে বাঁয়ে তাকাতে থাকেন, এক শিশি বিষ কোথায় কিনতে পাওয়া যাবে এই আশায়। হঠাৎ তার নজরে আসে ১০-১২ বছরের একটি ছেলে রঙ-বেরঙের বেলুন ফেরি করে বেড়াচ্ছে। লাল রঙের বেলুন , নীল রঙের বেলুন। আরো নানান রঙের বেলুন। নাতনির কথা মনে হয়ে গেল ইউসুফ সাহেবের। এই ছোট ছোট শিশুগুলোর মিষ্টি মিষ্টি হাসিই এই পৃথিবীকে এখনো বাসযোগ্য করে রেখেছে।
দ্রুত পা চালালেন ইউসুফ সাহেব। বিষ কিনতে নয়। দু’টি বেলুন কিনতে। একটি লাল রঙের আরেকটি নীল রঙের।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০১১ রাত ৯:২৬