৮ই এপ্রিল।
১৯৭১ সাল।
সিলেট শহর।
হাসপাতালের দিকে যাবার রাস্তায় হেঁটে চলেছেন সিলেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. শামসুদ্দিন আহমদ।
জনমানব শূণ্য হয়ে পড়েছে ছোট্ট শহরটি। সবাই শহর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে।
নিজের পরিবার পরিজনকেও তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন গ্রামের বাড়িতে। মহিলা নার্সদেরকে দিয়ে দিয়েছেন ছুটি। কিন্তু তিনি থেকে গেছেন। তাঁকে সাহায্য করার জন্য আরো কয়েকজন রয়ে গেছেন।
মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল স্যারকে ইতোমধ্যেই ধরে নিয়ে গেছে পাক হানাদার বাহিনী। হয়তোবা আর বেঁচে নেই তিনি। বুকের এক কোনায় হঠাৎ কেমন যেন শূণ্যতার সৃষ্টি হয় তাঁর।
পথিমধ্যে পরিচিত একজনের সাথে দেখা ডা. শামসুদ্দিনের।
“ একি আপনি এই পরিস্থিতিতে হাসপাতালে যাচ্ছেন কেন ?” শুরুতেই প্রশ্ন।
“ ভাই, কিছু রোগী হাসপাতালে রয়ে গেছে। তাদের ফেলে কোথায় যাই বলুন। আমার শিক্ষাই যে মানবতার সেবা।” হাসি মুখে উত্তর দিলেন ডা. শামসুদ্দিন।
প্রশ্নকর্তা একটু লজ্জা পেলেন।
৯ই এপ্রিল।
১৯৭১ সাল।
আকাশে হিংস্র শকুনের চাইতেও পাক হানাদার বাহিনীর আনাগোনা।
হাসপাতালের পূর্বপাশে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ। পাক বাহিনীর ক্যাম্প। উত্তর পাশে টিলার উপর সিভিল সার্জনের বাংলো। সকাল ৯টায় মুক্তিবাহিনী সেই বাংলো থেকে আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি কনভয়ের উপর। মারা যায় তিন পাক সেনা। বেপরোয়া পাক বাহিনী তখন পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের।
ডা. শামসুদ্দিন তখন অপারেশন থিয়েটারে বসে আছেন। রক্তের অভাবে অপারেশন করা যাচ্ছেনা আহত মানুষগুলোর। নিজের অসহায়ত্ব তাঁকে যেন মৃত্যুর চেয়েও বেশি পীড়া দিচ্ছে। হঠাৎ করেই মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে হাসপাতালে এসে উপস্থিত হয় মেজর রিয়াজসহ সশস্ত্র কয়েকজন পাক সেনা।
মুক্তিযোদ্ধাদের না পেয়ে ডা. শামসুদ্দিন সহ পাঁচজনকে লাইন করে দাঁড় করানো হলো।
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে নিজের ব্যক্তিত্বে তখনো অনড় ডা. শামসুদ্দিন। নিজের জীবন ভিক্ষা চাননি। চেয়েছিলেন অপারেশন থিয়েটারে রেখে আসা মুমূর্ষু রোগীগুলোর অপারেশন শেষ করে আসতে। কিন্তু বর্বর পাকিস্তানি সেনারা প্রথম গুলি তাকেই করে। প্রথম গুলিটি লেগেছিল তাঁর বাম উরুতে। দ্বিতীয়টি পেটের বাম পাশে। তিনি তখনও দাঁড়িয়ে। একচোখ বিস্ময় নিয়ে দেখছিলেন কর্তব্যরত ডাক্তার কারো শত্রু হয় কিভাবে। তৃতীয় গুলিটি লাগে তাঁর বুকের বাম পাশে, হৃৎপিণ্ডে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ডা. শামসুদ্দিন।
এরপর একে একে হত্যা করা হয় ডা. শ্যামল কান্তি লালা, ডা. জিয়াউর রহমান, পুরুষ নার্স মাহমুদুর রহমান, এ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার কোরবান আলীকে।
শোনা যায় কিছু আদিম উল্লাস।
তারপর শুধুই নিরবতা...............।
শহরে এরপর থেকে টানা কারফিউ।
১৩ তারিখ মাত্র এক ঘন্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হলে ডা. শামসুদ্দিনের পায়ের জুতো দেখে তাঁকে শনাক্ত করা হয়। হাসপাতালের ভিতর একফুট গর্ত করে দ্রুত তাঁর দাফন করা হয়।
২০০৯ সালের এপ্রিল মাসের কোন এক বিকেল।
আমি তখন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের এমবিবিএস ১ম বর্ষের ছাত্র।
চুপি চুপি গিয়েছিলাম শহীদ ডা. শামসুদ্দিনের কবরের সামনে। কবর জিয়ারত করার পর শুধু একটা দোয়াই করেছিলাম, “ইয়া আল্লাহ, ডাক্তার যদি হতে হয় তাহলে আমাকে শহীদ ডা. শামসুদ্দিনের মত ডাক্তার করো।”
শহীদ ডা. শামসুদ্দিনের কবর
তাঁর সমাধি ফলক
এই সেই সিলেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল যেখানে তিনি শহীদ হন পরবর্তীতে হাসপাতালটি অন্যত্র স্থানান্তরিত হলে পুরাতন হাসপাতালটি তাঁর নামে নামকরণ করা হয়।
তাঁর নামে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের একটি ছাত্র হল।
তিনি যখন ছাত্র
পরিবারের সাথে শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদ
আন্তর্জাতিক চিকিৎসক সম্মেলন শেষে বিভিন্ন দেশের চিকিৎসকদের সাথে (দ্বিতীয় সারিতে বসা অবস্থায় সর্ববামে)
সহকর্মীদের সাথে বনভোজনে
পড়ন্ত বিকেলে নিজ বাসভবনের বাগানে
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০১১ বিকাল ৩:০২