“শ্রদ্ধেয় প্রেসিডেন্ট রিগ্যান,
আপনি কেন যে আমার ছোটো বোনটিকে মেরে ফেললেন। আমার পুতুলটাও নষ্ট করে দিলেন। আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।”
ছোট্ট খুকির ছোট্ট চিঠিতে থাকা যন্ত্রণা, আকুতি ও বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে সাংবাদিক গ্ল্যাস চিঠিটি প্রচারের জন্য বহু নামিদামি সংবাদপত্র ও চ্যানেলের দোরে দোরে ঘুরেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা-প্রগতি ও সভ্যতার দেশের মুক্ত সংবাদ মাধ্যম বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায়নি।
মার্কিন প্রেসিডেন্টদের কাছে শিশুদের লেখা এরকম আরও তিনটি মর্মস্পর্শী চিঠির বৃত্তান্ত জানিয়ে দিচ্ছি।
হিরোশিমার কিমুকো সেলদির বয়স তখন দশ। হ্যারি ট্রমান তখন ছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। তাঁকেই প্রচুর শারীরিক কষ্ট নিয়ে চিঠিটি লিখেছিলো কিমুকো।
“প্রিয় প্রেসিডেন্ট ট্রমান,
আমার হাতের লেখার জন্য ক্ষমা করবেন। আমি যেভাবে পুড়ে ঝলসে গেছি, আমার হাতদু’টো এখনো কাঁপছে। ঠিকভাবে পেন্সিলটা ধরতেই পারছিনা আমি। আমি জানি, তুমি ভীষণ রেগে গেছো। কিন্তু দোহাই, আর কোনো অ্যাটম বোমা আমদের ওপর ফেলোনা। আমি স্কুলে পড়ি। অ্যাটম বোমার বিষক্রিয়ায় আমার প্রায় সব সহপাঠী বন্ধু ও আন্টিরা মারা গেছে। আমার জন্য ডাক্তার ডাকতে ছুটে গেছে, কিন্তু আমি জানি মারা গেছে অধিকাংশ ডাক্তারও। যন্ত্রণায় আমার পা দু’টো ছিড়ে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে কেউ আমার পা দু’টো কেটে ফেললে একটু যেন স্বস্তি পাই। ঝলসে যাওয়া দু’চোখে আমি খুব আবছা দেখছি। কখনো কোনো ছেলেকে তুমি হাঁটুতে ভর দিয়ে হেঁটে আসতে দেখেছো? আজ আমি একজনকে দেখেছি। কি করবে বেচারা, তার পা দু’টোতো ছিড়ে গেছে। আর একটি ছোটো মেয়েকে দেখলাম, তার চোয়ালটাই কোথায় হারিয়ে গেছে। বিচ্ছিন্নভাবে ঝুলছে পুরো জিভটা। এরপরও সে চিৎকার করে কাঁদছে। এক্ষুণি অবশ্য আমিও খুব কাঁদছিলাম, তবে আমি মোটেও কাঁদুনে নই। সবাই বলে আমি নাকি সব সময় হাসি। কি করবো, এতো যন্ত্রণা! পারলে তুমি কোনো আমেরিকান ডাক্তার আমার জন্য শিগগির পাঠাও..................।”
ছোট্ট কিমুকো চিঠিটা শেষ করতে পারেনি। কারণ এরপর আর আবছাও দেখছিলো না, কোন আমেরিকান ডাক্তারও আসেনি। ছোট্ট মেয়ে, সে জানতো না কোন আমেরিকান ডাক্তার আসবে না। কেনোনা মার্কিন প্রেসিডেন্টের এ ব্যাপারে কোন কর্মসূচি নেই। কয়েক মিনিটের মধ্যে সব যন্ত্রণার অবসান হয় কিমিকোর। হাত থেকে খসে পড়ে পেন্সিল। ঝলসে যাওয়া ছোট্ট মাথাটা ঝুলে পড়ে বুকের ওপর। কিমুকো, ছোট্ট কিমুকো মারা যায়। আমেরিকার জনপ্রিয় পত্রিকা “লাইফ” সে সময় স্রেফ ঝলসে মারা যাওয়া জাপানি এক মেয়ের ফটো প্রকাশ করে। ফটোর নিচে ক্যাপশন ছিলো, ‘এটাই ছিলো একমাত্র পথ’। ‘আর কোনো অ্যাটম বোমা আমদের ওপর ফেলোনা’, কিমুকোর শেষ অনুরোধও রাখেনি মার্কিনীরা। তিনদিন পর জাপানের নাগাসাকি শহরে আবারও অ্যাটম বোমা ফেলে।
ভিয়েতনামের মাইলাই-এর লিউ এঙ চিঠি লিখেছিল তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিডন জনসনের কাছে। লিউএর বয়স তখন বার।
“শ্রদ্ধেয় প্রেসিডেন্ট জনসন,
আপনাদের সৈন্যদের একটু বলুন তারা যেন আর কোন গ্রামে ঢুকে হত্যা লীলা না চালায়। আমরা নেহায়েত চাষ করে খাই। আমদের কোন অস্ত্র নেই। ওরা জনা তিরিশেক লোককে আমার চোখের সামনে একটি গর্তের ভিতর ফেলে দিলো। বড়োরা তো ছিলোই আমার মতোও অনেকে ছিলো। আমার মা আর দুই বছরের বোন ভোথিকেও তারা মেরে ফেলেছে। আপনাদের সৈন্যরা যখন আমদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলো তখন তারা ভিতরেই ছিলো। মা ভোথিকে নিয়ে বেরিয়ে আসতে অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু মেশিনগানের গুলি চালিয়ে তারা বের হতে দেয়নি। বাবা আর আমি যখন তাদের বের করার জন্য এগোলাম, মার্কিন হেলিকাপ্টার থেকে আমদের ওপর বোমা ফেলা হলো। আমরা দ্রুত দৌড়ে গিয়ে মাঠের ওপারে লুকিয়ে পড়ি। সেখান থেকে কাঁদতে কাঁদতে দেখলাম, আমাদের বাড়িঘর জ্বলে শেষ হয়ে গেলো। শেষ হয়ে গেলো মা আর ফুটফুটে বোন ভোথি। প্লিজ প্রেসিডেন্ট! আপনি বিশ্বাস করুন, আমার বাবা একজন গরীব কৃষক। আমদের কাছে কোন অস্ত্র নেই। আপনি আপনার সেনাদের এই কাজ বন্ধ করতে বলুন। আমরা বাঁচতে চাই।”
সে রাতে মার্কিন সেনারা ওই গ্রামে আবার হামলা চালায়। যারা বেঁচে ছিলো তাদের তাড়িয়ে একটা খন্দকে ঢোকানো হলো। এরমধ্যে ছিলো কিশোর লিউ এবং তার বাবাও। একজন মার্কিন সেনা তার স্বয়ংক্রিয় রাইফেলটা লিউএর মাথায় তাক করে ট্রিগার টেনে দিলো। কিছুক্ষণ পর যখন গোটা খন্দকটা কয়েকশো মানুষের লাশে ভরে গেলো, মার্কিন সেনারা তখন তার মধ্যে নাপাম বোমা ফেললো। উদ্দেশ্য কেউ যেন এই গণহত্যার কথা জানতে না পারে। ইতিহাসের পাতায় এটাকে মাইলাই গণহত্যা বলা হয়েছে। ঘটনার বহুদিন পর সাংবাদিক রিচার্ড বয়েল মাইলাইয়ে গিয়েছিলেন সত্য অনুসন্ধানে। তার ‘ফ্লাওয়ার অব দ্যা ড্রাগন’ বইতে ফুটে উঠেছে সেইসব নৃশংস বর্ণনা। কুখ্যাত মার্কিন বাহিনীর নেতা উইলিয়াম কর্সোন্টো পরে স্বীকার করেছিলেন, “ভিয়েতনামের জনগনের আশা আকাঙ্ক্ষাকে ধূলিস্যাৎ করার জন্য কৌশলগত ভাবেই পুরো দেশ জুড়ে পরিকল্পনামাফিক এই ধরনের হত্যাকাণ্ড চালানো হয়।
আট বছরের আফগান শিশু দিলওয়ার। কয়েক বছর আগে চিঠি লিখেছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের কাছে। দিলওয়ারের কাছে কোন কাগজ ছিলো না। আফগানিস্তানের গরম বালিতে একটি কাঠি দিয়ে চিঠি লিখেছিল সে।
“শ্রদ্ধেয় প্রেসিডেন্ট বুশ,
আমি এক এতিম। চারদিন খাবার পাইনি। এর আগে সামান্য খাবার মিললেও এ ক’দিন কিচ্ছু নেই। আমি শুনেছি তুমি খুব রেগে আছো। তাই বোমা মেরে আমদের সব খাদ্য গুদাম ধ্বংস করছো। আমাদের খওয়া-দাওয়া, চিকিৎসা সব বন্ধ করে দিয়েছ। যদি কোন ভুল করে থাকি, ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমাকে একটু খাবার দাও। সামান্য হলেও দাও। তোমার প্লেন থেকে এত্তো বোমা পড়ছে কিন্তু দেখো আমি কিছুতেই মরছিনা। মনে হয় আমি মরে গেলেই ভালো হতো। অন্তত ক্ষুধার এই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে রেহাই মিলতো। হয় একটু খাবার দাও নয়তো মেরেই ফেলো। বুশ, আমি তোমার পছন্দের অপেক্ষা করছি।”
জানা যায়নি আফগান তোরাবোরা সবুজ উপত্যকার কৃষকের ছেলে দিলওয়ার মরেছে কিনা।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ বিকাল ৪:২৬