তত্ত্বের ক্লাস। ক্লাস নিচ্ছিলেন প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব এ কে এম শাহনেওয়াজ স্যার। একপর্যায়ে তিনি বললেন, ‘পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা গেছে বাংলাদেশের অনেক পুরাকীর্তির দেয়ালের চিত্রফলক পরিবর্তিত হয়ে গেছে। বিভিন্ন ঘটি, বাটি, আসবাবপত্রের চিত্র যেখানে থাকার কথা সেখানে অন্যান্য ফলকের সঙ্গে কাচের লণ্ঠন বা হারিকেনের চিত্র আঁকা ফলক স্থান পেয়েছে। বিষয়টি অদ্ভুত কারণ চিত্র ফলকগুলো যে যুগের বলে ধরা হয় সে যুগে এই লণ্ঠনের আবিষ্কারই হওয়ার কথা নয়। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সংস্কার করতে গিয়ে এদেশীয় অশিক্ষিত কারিগররা নিজের মতো করে তা এঁকে ফলকের সংস্কার করেছেন।’ এভাবে দেশের কত স্থাপনার ফলক, টেরাকোটা যে পরিবর্তন হয়ে গেছে তা আমরা চিন্তাও করতে পারি না। এ ধরনের পদক্ষেপ যে শুধু প্রাচীন ঐতিহ্যেরই ক্ষতি করে তা নয়, বিকৃত করে আমাদের প্রাচীন ইতিহাসকেও।
পুরোনো বলেই পুরাতত্ত্ব। পুরোনো বলেই প্রত্ন নিদর্শনগুলো মূল্যবান। হাজার বছর আগের ব্যবহৃত ইট, কাঠ, পাথর দিয়ে তৈরি আমাদের দেশের প্রাচীন স্থাপনাগুলো সাক্ষী হয়ে আছে গৌরবময় অতীত ঐতিহ্যের। ইতিহাসের স্পষ্ট সাক্ষী বলেই পুরাকীর্তিগুলোর এত গুরুত্ব। পৃথিবীর যে কোনো দেশই তাদের এই ঐতিহ্যকে সবকিছু দিয়েও রক্ষা করতে প্রয়াসী। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে পুরাতত্ত্ব ধ্বংসের যে যজ্ঞ শুরু হয়েছে, তা সত্যিই আমাদের দেশীয় ঐতিহ্যের জন্য চরম হুমকিস্বরূপ। প্রাচীন ঐতিহ্য ধ্বংসের পেছনে কাজ করছে কতগুলো কারণ, যার বেশির ভাগই মানবসৃষ্ট। ১) সংস্কারের অভাব, ২) চোরাচালান, ৩) সংস্কারের নামে স্থাপত্যের ব্যাপক পরিবর্তন, ৪) পুরোনো স্থাপত্যের ইট, কাঠ আত্মসাৎ, ৪) সরকারি বিনিয়োগের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া, ৫) সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও অদূরদর্শিতা ইত্যাদি কারণে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশের প্রত্ন ঐতিহ্য।
প্রথমত, সংস্কারের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বহু প্রাচীন ইমারত ও স্থাপত্য। দেশের বহু স্থানে ছড়িয়ে থাকা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো একমাত্র পৃষ্ঠপোষকতা ও ঔদাসিন্যের কারণে বিলুপ্ত হওয়ার পথে। ধ্বংসের পথে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার মিরুখালি ইউনিয়নের কুলুবাড়ির প্রাচীন স্থাপনাগুলো। সংস্কারের অভাবে এখানকার মূল ভবন, মঠ, মন্দিরের নান্দনিক নকশা ও অপূর্ব নির্মাণশৈলী ধসে পড়ছে। ধ্বংস হচ্ছে নয়নাভিরাম সুরম্য অট্টালিকা ও কারুকার্যখচিত মন্দির। সংস্কারের অভাবে ধ্বংস হতে চলেছে কিশোরগঞ্জের ‘কুতুব শাহ মসজিদ’; যমুনা তীরবর্তী ‘কাশিমপুর রাজবাড়ি’; শেরপুরের পৌনে তিনআনি জমিদারের ‘রংমহল’; সাতক্ষীরার সোনাবাড়িয়ার ‘মঠবাড়ি’; হবিগঞ্জের বিখংগল গ্রামের ‘প্রাচীন আখড়া’; রাজার হাটের ‘চান্দামারী’ ও ‘স্বরূপচামারু’ মসজিদ; তিতাস নদীর তীরবর্তী রূপসদী গ্রামের ‘খানেপাড়া জমিদারবাড়ি’; মনোহরগঞ্জ উপজেলার ‘লৎসর মিঞা বাড়ি শাহী জামে মসজিদ’; চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার রাজানগরের ‘রাজবাড়ি’; নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার ‘বোয়ালবাড়ি পুরাকীর্তি’; নওগাঁ জেলার জয়পুরহাটের ‘জগদ্দল বিহার’; বগুড়ার ‘মহাস্থানগড়’; কুমিল্লার ‘সোমপুর বিহার’; দিনাজপুরের ‘রাজবাড়ি’; ঠাকুরগাঁওয়ের ‘রাজা টঙ্কনাথের বাড়ি’সহ বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত প্রাচীন প্রত্ন নিদর্শনগুলো।
পাচারের মাধ্যমেও হারিয়ে যাচ্ছে অনেক পুরাকীর্তি। নিয়মিতভাবে আন্তর্জাতিক পাচার চক্রের মাধ্যমে পাচার হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান পুরাকীর্তি, ফলক, আসবাব, মূর্তি ইত্যাদি বহু ধরনের প্রত্নসম্পদ। বাংলাদেশের পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ আইনটি বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে যেমন অসামঞ্জস্যপূর্ণ, তেমনি পুরোনো। ১৯০৪ সালে এ বিষয়ে একটি আইন পরিবর্তন করে ১৯৬৮ সালে প্রণীত হয়েছিল, যা ১৯৭৬ সালে সংশোধনীর মাধ্যমে প্রত্নবস্তুর পাচার ও কেনাবেচার জন্য শাস্তির বিধান করে। সেখানে এ ধরনের অপরাধের জন্য ৫০০ টাকা জরিমানা বা এক মাসের জেলের শাস্তির কথা বলা হয়। এরপর ২০০৯ সালে নতুন করে ঐতিহ্য সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করা হলেও প্রকৃত অর্থে এ বিষয়টির ওপর তেমন গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি। ভাবার বিষয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে অমূল্য প্রত্নবস্তুর পাচারে এ ধরনের ঠুনকো শাস্তির বিধান কতটুকু কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম?
কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি কর্তৃক দখল হয়ে যাওয়ার কারণেও ধ্বংস হচ্ছে প্রাচীন অনেক স্থাপনা। দখলদারের খপ্পরে পড়ে এখন রাজধানীর ‘রূপলাল হাউস’, শাঁখারী বাজার ও সূত্রাপুরের হেরিটেজভুক্ত বাড়ি, তাঁতীবাড়ির ‘জগন্নাথ মন্দির’, ‘ফরাশগঞ্জ বড়বাড়ি’, কোতোয়ালির ‘২৭/২ নম্বর বাড়ি’সহ অনেক পুরোনো ঐতিহ্যবাহী বাড়ি ধ্বংস করে ফেলেছে দখলদাররা। ঢাকা সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ১২ সদস্যের একটি হেরিটেজ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। যে কমিটি রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত প্রাচীন ভবনগুলোকে হেরিটেজ বলে চিহ্নিত করে। এর মধ্যে ছিল ঢাকা টিএসসির ‘শিব মন্দির’, ‘জাতীয় তিন নেতার মাজার’, ‘লালবাগ কেল্লা’, ‘ছোট কাটরা’, বড় কাটরা’, ‘শাহাবাজ খান মসজিদ’, ‘রূপলাল হাউস’, ‘নবাববাড়ি’সহ প্রায় ৯৩টি ঐতিহ্যবাহী ভবন। ঢাকা সিটি করপোরেশন, রাজউক, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে এসব ভবন সংস্কারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এগুলো সংরক্ষণের জন্যও পাঠানো হয়েছিল পূর্ণাঙ্গ সুপারিশমালা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। প্রথমত কর্তৃপক্ষ এসব বিষয়ে চরম উদাসীনতা প্রকাশ করেছে, দ্বিতীয়ত যেসব সংস্কারকাজ হাতে নেওয়া হয়েছে তা প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ নয়, রীতিমতো ধ্বংসের পথ প্রশস্ত করেছে।
সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো, সরকারি উদ্যোগে যেসব প্রত্ন ঐতিহ্যের সংরক্ষণের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে তা স্থাপত্যগুলোকে সংরক্ষণ তো করছেই না বরং ভয়ংকরভাবে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ২০১৩ সালে ধ্বংসের উদ্যোগ নেওয়া হয় চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের ‘নয়দুয়ার মসজিদ’ যা নির্মিত হয়েছিল ১৬১০ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে। প্রায় ৪০০ বছর পুরোনো ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি ভেঙে সেখানে বিদেশি অনুদানে নতুন মসজিদ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। আবার সংস্কারের নামে লাল, নীল, গোলাপি রং চড়িয়ে হাস্যকর বানানো হচ্ছে লাল ইটের অপূর্ব পুরাকীর্তিগুলোকে। টাঙ্গাইল জেলার ‘বহেরা জমিদারবাড়ি’, কিশোরগঞ্জের ‘চন্দ্রাবতীর মন্দির’সহ আরো অনেক পুরোনো ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা এখন পূর্বের সৌন্দর্য হারিয়ে গাঢ় গোলাপি রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে। বিষয়টি যেমন অবমাননাকর, তেমনি এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ জাতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের চরম উদাসীনতা ও অদূরদর্শিতার পরিচায়ক। সংরক্ষণ ও পুনরায়ণের নামে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর একে একে ধ্বংস করছে প্রাচীন সোনারগাঁওয়ের পানাম সিটির প্রত্ন নিদর্শন। এরই মধ্যে ভেঙে ফেলা হয়েছে নগরের ঐতিহাসিক প্রবেশদ্বার। ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে নগরীর বহু গুরুত্বপূর্ণ ভবন। প্রাচীন নকশা তুলে ফেলে অদ্ভুত শ্রীহীন ও নগ্ন করে তোলা হয়েছে বহু পুরোনো পানাম নগরীকে। এবং অতি সম্প্রতি ২৫ জুন সবার সম্মুখে ধ্বংস করা হলো ৪০০ বছরেরও পুরোনো অক্ষত প্রত্ন নিদর্শন লালবাগ কেল্লা। সরকারের অবিবেচনা দেখে হতবাক হলো দেশবাসী। লালবাগ কেল্লার সৌন্দর্যই হলো এর সুরম্য লাল ইটের দেয়াল। এখানে ১০ ফুট কেন এক ইঞ্চি জায়গার ক্ষতি করা মানে অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করা যা নিজ হাতে করলেন বাংলাদেশ পত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। যদিও তারা দাবি করেছেন যে অংশটি ভাঙা হয়েছে তা কেল্লার অংশ নয়, তারপরেও একটি মনোরম পুরাকীর্তি আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ পার্কিং স্পেস তৈরি কতটা যুক্তিসংগত তা বিবেচনার বিষয়।
মন্দির ও প্রাসাদের দেয়াল থেকে সংস্কারের নামে পুরোনো নকশা তুলে নতুন করে তা স্থাপনের বিধ্বংসী সিদ্ধান্ত আমাদের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্তৃপক্ষ প্রায়শই নিয়ে থাকেন। একবার ভেবে দেখুন, যদি যুগের সঙ্গে সংস্কার করতে গিয়ে প্রাচীন রমণীমূর্তির চোখে চশমা এঁকে দেওয়া হয় তাহলে বিষয়টি যেমন হাস্যকর হবে, ঠিক ততটাই হাস্যকর দেয়ালের ফলক পাল্টে বা রং পাল্টে তার আধুনিকায়ন করা। একজন সাধারণ মানুষও এটা বোঝে যে, পুরোনো জিনিস রক্ষা করতে গেলে তা ধ্বংস করে নয় বরং তার চারপাশ থেকে ক্ষতিকর বস্তু সরিয়ে নিতে হয়। কিন্তু আমাদের কর্তৃপক্ষ এতটাই উদাসীন যে তাদের মাথায় সে চিন্তা আদৌ উদিত হয় না। তারা কেবল বিভোর থাকে বরাদ্দের টাকা দিয়ে নিজের আখের গোছানোর চিন্তায়। এভাবেই উপযুক্ত সংস্কারের অভাবে ও কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শিতা এবং মূর্খতার কারণে ধ্বংস হতে চলেছে দেশের প্রাচীন সব ঐতিহ্য।
ঐতিহ্য আর পুরাকীর্তির দেশ ভারত। প্রচুর ঐতিহ্যের সমাহার সেখানে। কিন্তু কোথাও কোনো প্রসাদ বা সৌধের বা মন্দিরের চুল পরিমাণ পরিবর্তন রোধে তারা চরম সচেতন। সংস্কারের নামে প্রত্ন নিদর্শন ধ্বংসের পক্ষপাতি তারা নয়। একমাত্র সচেতনতার জন্যই প্রতিবছর প্রত্ননির্দশন থেকে তারা কোটি কোটি টাকা আয় করছে। অথচ সেদিক থেকে বাংলাদেশেও প্রত্ন নিদর্শন কম নেই কিন্তু তা থেকে কোনো প্রকার লাভজনক খাত আমরা তৈরি করতে পারিনি বরং সচেতনতার স্থানে এখানে গৃহীত হয়েছে চরম অবহেলা ও উদাসীন ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপ। বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায়, বিশ শতকের শেষের দিকে তালেবান জঙ্গিরা আফগানিস্তান ও একবিংশ শতকে এসে আইএস জঙ্গিরা ইরাক, সিরিয়া, তিউনিসিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রত্ন ঐতিহ্য ধ্বংসের খেলায় মাতে। তারা জঙ্গি বলেই হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ধ্বংস করতে তাদের বাধে না কিন্তু আমাদের প্রত্ন কর্তৃপক্ষ জঙ্গি না হয়েও অভিনব উপায়ে দেশের ঐতিহ্য ধ্বংস করতে উদ্যত।
বাংলাদেশ প্রত্ন ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ একটি দেশ। এই পুরাকীর্তিগুলো আমাদের সমৃদ্ধ অতীতের পরিচায়ক। এগুলোর বিলুপ্তির অর্থ হচ্ছে দেশের ইতিহাসকে, অতীত গৌরবকে ধ্বংস করা। একটি দেশের সমৃদ্ধি ও খ্যাতির ক্ষেত্রে তার পুরাকীর্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে; তাই এই অমূল্য পুরাকীর্তিগুলো ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে শুধু সরকারকেই নয় সর্বস্তরের মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। বাড়াতে হবে এ বিষয়ে জনসচেতনতা। দেশীয় ঐতিহ্য ধরে রাখতে হলে অত্যাবশ্যকীয় করণীয় হলো প্রত্ন ঐতিহ্যকে ধ্বংসের হাত থেকে উদ্ধার করা। প্রত্ন ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ছাড়া আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে ধরে রাখা সম্ভব নয়। তাই এ বিষয়ে অতিদ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।
নাজিয়া ফেরদৌস : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০১৬ রাত ৯:৫২