'নোবেল' পুরস্কারটার ভার এমনই যে- আমরা সবাই ১ম নোবেল জয়কে (স্বাধীন বাংলায়) অন্য উচ্চতায় নিতে চেয়েছি, খুশিতে-গর্বে আত্মহারা হয়েছি ….। ফলে- প্রফেসর ইউনুস বাংলাদেশের শান্তিতে কি অবদান রেখেছেন- তার ক্ষুদ্র ঋণ- গ্রামীণ ব্যাংক আসলে কি করেছে- করছে, কেন ও কোন অবদানে তিনি ও গ্রামীণ ব্যাংক শান্তিতে নোবেল পেতে পারেন- এগুলো আমরা ভাবতে চাইনি। মোদ্দাকথা আমরা গর্বিত হতে চেয়েছি- দুনিয়ায় আমাদের কিছু কদর হোক সেটা চেয়েছি – ব্যাস। ফলে, নোবেল পাওয়ায় আমরা খুশী। 'নোবেল' পুরস্কারটাই যে এখন অনেক বিতর্কিত- বিশেষ করে 'শান্তিতে নোবেল' যে পুরাটাই হাস্যকর ব্যাপার-স্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, এটা ওবামা-এবাদি-পেরেস-রবিন-কিসিঞ্জার এমন বিভিন্ন জনের বেলায় অনেকবারই আমরা ভ্রু কুচকালেও ইউনুসের বেলায় আমরা ওসব মাথায় আনতে চাইনি। কেননা- বাংলাদেশে প্রথম নোবেল বলে কথা। এই হচ্ছে- আসল সমস্যা আমাদের। আর এই জায়গা থেকেই- আজকে যখন আমাদের সবেধন নীলমনি নোবেলবিজয়ী ইউনুস সাহেবকে তার গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অপসারণ করা হলো- সবার মাথায় বাজ এসে পড়েছে! গুনীর (!) সম্মান নিয়ে আমরা ভয়াবহ চিন্তিত!! আমাদের, আমাদের দেশের ভাবমুর্তি নিয়ে খুব ব্যস্ত! আজব! আজব সব যুক্তি দিচ্ছেন তাঁর গুনমুগ্ধ ভক্তরা! বহির্বিশ্বে ইউনুস আমাদের দেশের নামডাক উজ্জ্বল করেছেন- সে জন্য তার সাত খুন মাফ? বিগত ১০ বছরে একটা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া হলো কেন এ প্রশ্ন সঙ্গত হতে পারে, হাসিনা/হাসিনা সরকারের উদ্দেশ্য নিয়েও কথা উঠতে পারে- কিন্তু পূর্বে পদক্ষেপ না নিলে এখন নেয়া যাবে না- এটা কেমন যুক্তি? "এই দশকে পৃথিবীতে বাংলাদেশ পরিচিত হয় প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূ'কে দিয়ে"- আর সে কারণেই তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকাটা যেন আমাদের জন্য ফরয কাম! ফলে, এহেন ইউনুস গ্রামীন ব্যাংক থেকে অপসারিত হওয়ায় আমরা সবাই হয়ে গেলাম 'অকৃতজ্ঞ'- ফেসবুকে "শেম অন আস" / "shame for the whole nation" স্ট্যাটাসের কতই না ছড়াছড়ি !!!!
আর, এত কিছুর মাঝখান দিয়ে ক্ষুদ্রঋণের মরণ ফাঁদ, গরিবী নিয়ে ব্যবসা, ইউনুসের দুর্নীতি এগুলো কি সুন্দর আড়ালে পড়ে গেল !!!!
এই কারণে, যারা সরকারকে বাহবা দিচ্ছেন (বদরুদ্দিন উমর সহ)- ইউনুসের পতনের কথা ভেবে খুশীতে মিষ্টি বিতরণের কথা বলছেন- তাদেরো বলি- ইউনুসকে সরানো মানে- গ্রামীণ ব্যাংক-ক্ষুদ্রঋণের সরা নয়, বয়সের কথা বলে ইউনুসকে সরানো মানে- ইউনুস নামক প্রতিষ্ঠানের কেশাগ্রও ছোঁয়া নয় – বরং তাকে আরো ভালোভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে হাজির করা। দেশের সমস্ত মিডিয়া- তাবৎ বুদ্ধি(!)জীবিরা লেখছেন- হোমড়া চোমড়ারা আওয়াজ তুলছেন- সাম্রাজ্যবাদী মোড়লরা এগিয়ে এসে অসন্তোষ প্রকাশ করছেন …, গ্রামীণের সদস্যরা কান্নাকাটি করছেন- ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে দেখানো হচ্ছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন হচ্ছে, প্রথম আলো সহ বিভিন্ন পত্রিকায় তা দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ প্রথম পাতায় ছবিসহ ছাপানো হয়েছে ... ইউনুসের ক্ষতি কি তাতে?
একই সাথে হাসিনার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠা দরকার। অনেকে বলছেন- এটা জীঘাংসা। এটাতেও একমত যদি না- সেখান থেকে কেউ এই সিদ্ধান্ত না টানেন যে- যেহেতু এগুলো হাসিনার জীঘাংসা সেহেতু ইউনুস মহান! শাসকগোষ্ঠী, সাম্রাজ্যবাদের দালালেরা নিজেদের মধ্য মাঝেমধ্যেই কামড়াকামড়ি করে। এ আর নতুন কি! সরকারের আসলেই যদি সদিচ্ছা থাকতো (থাকার কথাও না)- তবে দুর্নীতি বিষয়ে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারতো- বা দুদককে ইনভল্ভ করতে পারতো, ক্ষুদ্রঋণ- উচ্চ সুদের-মাহাজনি ব্যবসাকে নিষিদ্ধ করতে পারতো- কিন্তু সেটা আওয়ামিলীগ-বিএনপি যে করবে না- সেটা সকলেই বুঝে। আর, বয়সের মত খেলো বিষয়টাকে সামনে নিয়ে আসা মানেই হচ্ছে ইউনুসকে আসল যে বিষয়গুলো নিয়ে ধরা যেত - সেগুলোকে আড়াল করা। যাহোক, সাম্রাজ্যবাদের সাথে গাটছাড়া বাঁধা সরকারগুলো সাম্রাজ্যবাদীদেরই বিশ্বস্ত অনুচর প্রফেসর ইউনুসকে কতটুকু ঘাটাতে পারে- সেটা তো আর অজানা না!
কিন্তু, এই সুযোগে ইউনুসকে নিয়ে নাচানাচি শুরু হয়েছে- সেটা ভয়ংকর। এমন কথাও হচ্ছে যে, 'ইউনুসের ব্যাপারে, গ্রামীণ ব্যাংক- ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে সমালোচনা থাকতেই পারে- কিন্তু তিনি নোবেল জিতে বহির্বিশ্বে আমাদের মুখ যেহেতু উজ্জল করেছেন-সেহেতু ইউনুসকে আমাদের সবসময়ই মাথায় তুলে রাখতে হবে!' অর্থাৎ ঐসব সমালোচনাকে আমলে নেয়ার কোন দরকার নাই। জাফর ইকবাল স্যারের লেখাতেও এই টোন। অনেকে তো আবার ইউনুসের অবদানের তালিকা তুলে ধরতে দারিদ্র বিমোচন, আত্মকর্মসংস্থান এইসব বাহারি সব জিনিসের আমদানি করছেন। প্রফেসর ইউনুস নিজ দেশের দারিদ্র বিমোচন করেছেন/করছেন? কিস্তি দিতে না পেরে অপমানে আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে, টিনের চাল খুলে নিয়ে যাওয়া, হালের গরু- এমনকি ছাগল-মুরগীও নিয়ে যাওয়া, কোমরে দড়ি বাধা, লোকসমাজে অপমান করা- এগুলো গ্রামীণ ব্যাংক/ ব্র্যাক কর্মীদের প্রাত্যহিক কাজ- সেটা সম্ভবত তাদের কি জানা নাই? নাকি এটাকেই তারা দারিদ্র বিমোচন বলছেন? আসলে সম্ভবত তারা চান দরিদ্র বিমোচন। ফেসবুকে কল্লোলের নীচের স্ট্যাটাসটা এখানে প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে:
"সুশীলদেরকে ৫ হাজার টাকা করে ক্ষুদ্র ঋণ দেব। মাত্র ১৫% সুদ। ১ বছরে সুদ-আসলে ৫৭৫০ টাকা। ঋণ দেয়ার সময় জামানত, বিমা, সদস্য চাদা ইত্যাদি বাবদ ২৯০ টাকা কেটে রাখবো। বাকি টাকা ৫২ সপ্তাহে সাপ্তাহিক ১০৫ টাকা করে কিস্তিতে দিলেই চলবে। দেখতে চাই, এই টাকা সম্বল করে কত মুনাফার আত্মকর্মসংস্থান তারা আবিস্কার করে যার মাধ্যমে প্রথম সপ্তাহ থেকেই পরিবারের ভরণপোষণ করার পরও নিয়মিত ঋণের কিস্তি দেবার মতো ১০৫ টাকা করে উদ্বৃত্ত তাদের হাতে থাকে!!"
যাহোক, সরকার ইউনুসরে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অপসারণ করেছে। দুর্নীতির অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে এখনো কোন ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে কোন রকম উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। আর ক্ষুদ্রঋণের মরণ-ফাঁদ নিয়ে তো কোনদিকেই কোন রা নেই। আগেই বলেছিলাম- তেমন কোন ইচ্ছা এই বুর্জোয়া সরকারগুলোর নেই। তদন্ত কমিটি এর মধ্যে গত ২৫ এপ্রিল রিপোর্ট পেশ করেছে, ইউনুসের নানাবিধ দুর্নীতি ও অনিয়মের কথা বিস্তারিতভাবে এই রিপোর্টে উঠেও এসেছে (বিডিনিউজ ডট কমের সৌজন্যে এটা হাতে এসেছে), কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই যে- তদন্ত কমিটির রিপোর্টে এইসমস্ত দুর্নীতির ও অনিয়মের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার কোন সুপারিশ নেই।
চলবে ... (পরবর্তী পর্ব: তদন্ত কমিটির রিপোর্ট)