গতকাল রাতে, আনব্যানের দাবি আদায়ে বিজয় অর্জনের কিছুক্ষণের মধ্যেই অবাক হয়ে ত্রিভুজের একটি পোস্ট দেখলাম। সেখানকার লিংক ধরে তার আরো দুটি ও আশরাফ রহমানের একটি পোস্ট পড়লাম।
কিছু কথা বলা আবশ্যক মনে হওয়াতে আজ ফুল রেস্টে থাকার কথা থাকলেও নেটের সামনে বসতে হলো।
তাদের মূল বক্তব্য কি?
আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে আমার সোনার বাংলা গানটি থাকার যৌক্তিকতা কতখানি? কারণ-
রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশ চেতনার বিরুধী ছিলেন, বা বাংলাদেশ তথা পূর্ববঙ্গের উন্নতির বিরুদ্ধপক্ষ মানুষ ছিলেন।
এর পক্ষের যুক্তি কি?
১। তিনি বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা নিয়েছিলেন।
২। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে কলকাতায় আয়োজিত সমাবেশের সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৩। আমাদের স্বাধীনতা হরণকারী ব্রিটিশদের তাবেদার ছিলেন। কেননা, তিনি জনগণমন ভাগ্যবিধাতা গানটি রচনা করেছিলেন সাদা চামড়ার স্তুতির উদ্দেশ্যে।
উপরের তিনটি ঘটনাকে সত্য ধরেও কি তাকে বাংলাদেশ চেতনার বিরুধী বলা যায়?
১। বঙ্গভঙ্গের ঘটনার সাথে বাংলাদেশ চেতনার কোন সম্পর্কই নেই। এটা ঠিক যে, পূর্ববঙ্গের মুসলিম উঠতি বুর্জোয়া শ্রেণীর তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণী বিভিন্ন দিক থেকে এগিয়ে ছিল, কেননা- তারা মুসলিমদের আগে থেকেই ইংরেজী শিক্ষার দিকে ঝুকেছিল এবং বণিকী পেশাতেও তারা অগ্রজ ছিল। ফলে, ইংরেজরা যখন ডিভাইড এণ্ড রুল এর নীতিতে বঙ্গভঙ্গ করলো- ঐ হিন্দু বুর্জোয়া অংশ স্বভাবতই তার বিরুধীতা করে। এবং মুসলিম অংশটিকে গোষ্ঠী স্বার্থেই ইংরেজরা পক্ষে পায়। তবে, এই অংশদুটির বাইরে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে দুই বঙ্গের অনেক মুক্তমনা এই বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা করেছিল এই জায়গা থেকে যে, প্রথমত ইংরেজরা প্রথমবারের মত সাফল্যের সাথে হিন্দু-মুসলিমে বিভেদ টানতে সক্ষম হয়, যা স্পষ্ট হয় পরবর্তি দাঙ্গায়, নজরুল সহ অনেকের লেখনীতে এই দাঙ্গা-বিরোধী বক্তব্য পাবেন (আমার কাজী নজরুল ইসলাম শীর্ষক পোস্ট দ্রষ্টব্য)- [যার চুড়ান্ত ফলাফল গিয়ে দাঁড়ায় দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ধর্মকেন্দ্রিক পাকিস্তান নামক হাস্যকর রাষ্ট্রটির উদ্ভব]; এবং দ্বিতীয়ত- অবিভক্ত বাংলার স্বপ্নচারী ও অভ্যস্ত মানসিকতায় ইংরেজ কর্তৃক নির্মম আঘাতের কষ্ট।
এটা পরিস্কার যে, এই বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনাকারী ইংরেজরা, মুসলীম লীগের উত্পত্তির পেছনেও তাদের ভূমিকা ছিল এবং এটাও ঠিক যে, তাদের এ উপমহাদেশে কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বী একটি রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন ছিল- এবং হিন্দু ও মুসলিমকে বিভক্ত করাও প্রয়োজন ছিল; বেশীদিন এখানে তাদের শাসন-নির্যাতনের রাজত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদেই।
২। ঢাকা কিন্তু তখন বাংলাদেশের রাজধানী নয়, ফলে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধীতার সাথে বাংলাদেশ চেতনার কোন সম্পর্কই থাকতে পারে না। একটি উদাহরণ দেই- ধরেন এই মুহুর্তে পদ্মাসেতুর একটি সিদ্ধান্ত হতে যাচ্ছে। এখন কোথায় এই সেতু নির্মিত হবে সেটা নিয়ে দুদল লোক এলাকাগত সুবিধার ভিত্তিতে একদল মাওয়া আরেকদল পাটুরিয়ায় সেতু নির্মাণের দাবি করলো। সে দাবিতে- পাটুরিয়ায় সেতু নির্মিত হলে যারা লাভবান হবেন তারা সমাবেশ করলো- মাওয়ায় সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করে। সেক্ষেত্রে কি বলা যেতে পারে? আমরা এটুকুই বলতে পারি পাটুরিয়ার লোকজন দেশের বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভাবতে ব্যর্থ হয়েছে, কেননা মাওয়া সেতু হলেই সবদিক থেকে মঙ্গল। কিন্তু বাংলাদেশ যদি দুটুকরা হয়ে দুটি দেশ হয় যার একদিকে মাওয়া আর দিকে পাটুরিয়া তবে মাওয়ার দিকের লোকজন কি দাবি করবে- অমুক ঐ সমাবেশে মাওয়া সেতুর বিরোধিতা করেছিল- সেজন্য সে আমাদের এই দেশের চেতনা পরিপন্থী??
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা ছিল- সেটা তাঁর বিশেষ স্বপ্ন ছিল। আর, বিভিন্ন সময়ে কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ উভয়বঙ্গের শিক্ষাবিস্তার নিয়ে তাঁর অনেক নিরন্তর ইতিবাচক ভূমিকার কথা সকলেই জানে।
৩। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের আপোষকামী অংশের প্রতিনিধি। উঠতি বুর্জোয়া, জমিদার শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দল কংগ্রেসও তাই। সূর্যসেন-ক্ষুধিরাম-ভগত সিং- প্রীতিলতা- পরবর্তিতে সুভাষ বোস - এনাদের বিপ্লবী ধারার বিপরীতে কংগ্রেসের ভূমিকা ছিল ব্রিটিশদের সাথে আপোষ-লড়াই-সুবিধা আদায়-আপোষ- নীতিতে চলা এক রাজনৈতিক সংগ্রাম। যার ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি ব্রিটিশদের দান করা পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র- এ আমাদের লজ্জা যে, আমরা ব্রিটিশদের বিতাড়িত করতে পারিনি- এ লজ্জা আমাদের দান করেছে কংগ্রেস তথা মহাত্মা গান্ধী ও নেহরু- জিন্নাহরা; যদিও অগ্নিপুরুষ ঐ বিপ্লবীদের কারণেই ব্রিটিশরা এ উপমহাদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল- তাই এ লজ্জা আমাদের লাঘবও হয়।
যাহোক, যা বলছিলাম- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপোষকামী অংশের প্রতিনিধি- ফলে ওনার চিন্তা-ভাবনার মধ্যে এই সংগ্রাম ও আপোষ উভয়েরই সংমিশ্রন পাওয়া যায়। তবে তাঁর সাহিত্য-কর্ম, তাঁর জীবন, তাঁর কর্মপদ্ধতি সবকিছু দেখে তাঁকে একজন অত্যন্ত সংবেদনশীল মনের অধিকারী- সত ব্যক্তি বলেই মনে হয়। ফলে, তার যাবতীয় কর্মকাণ্ডের পেছনে সুবিধা গ্রহণের কোন বিষয় থাকাটা সম্ভব নয়, বরং চিন্তাগত সারল্য জনিত কিছু ভুলের প্রভাবই মনে হয় আপোষের অংশটুকুকে। মনে রাখবেন জালিয়ানওয়ালাবাদের ঘটনায় কংগ্রেস তথা গান্ধীও এত তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
বাংলা ভাষা, বাঙ্গালি সংষ্কৃতি ও রবীন্দ্রনাথঃ
হুমায়ুন আজাদের ভাষায় বলি, "আকাশে সূর্য ওঠে প্রতিদিন, আমরা সূর্যের স্নেহ পাই সারাক্ষণ। সূর্য ছাড়া আমাদের চলে না। তেমনি আমাদের আছেন একজন, যিনি আমাদের প্রতিদিনের সূর্য। তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [১৮৬১-১৯৪১]। তিনি আমাদের জীবনে সারাক্ষণ আলো দিচ্ছেন। তিনি বাঙলা ভাষার সবার বড় কবি। তাই নয় শুধু, তিনি আমাদের সব। তিনি কবিতা লিখেছেন, গল্প লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন, নাটক রচনা করেছেন, গান লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি কি লেখেন নি? তিনি একাই বাঙলা সাহিত্যকে এগিয়ে দিয়ে গেছেন কয়েকশো বছর। আজ যে বাঙলা সাহিত্য বেশ ধনী- তার বড় কারণ তিনি"। কিন্তু তিনি শুধু বাঙলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি নন, বাঙলা ভাষার শ্রেষ্ঠ বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানীও। তিনি তাঁর সৃষ্টির মাঝে বাংলাকে যেন নবপ্রাণ দান করেন। ভাষাকেই করে তুলেন সমৃদ্ধ।
সংক্ষেপে ইতিহাসটা একটু বলি(বিস্তারিত অন্য সময়ে বলা যাবে)। চর্যাপদ এর কালে বাঙলা ভাষা ছিল খুবই অবিকশিত। ১৮০১ সালে শুরু হয় আধুনিক বাঙ্গালীর বাংলা গদ্যের ধারা। কেরি, রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামমোহন রায়, অক্ষয়কুমার দত্ত এবং আরো অনেকের শ্রমে ক্রম বিকশিত হয় সাধুভাষা। ১৮৬০ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভাষায় সাধুরীতি স্থির মানরূপ লাভ করে। এরপরে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও আরো অনেকে সাধুরীতির বাংলায় নিয়ে আসেন আরো অনেক বৈচিত্র। তবে রবীন্দ্রনাথের কৃতিত্ব অন্যখানে। তা হলো চলতি বাংলা। প্যারীচাঁদ মিত্র ও প্রমথ চৌধুরীর পথ ধরে যখন রবীন্দ্রনাথ গদ্যরীতি হিসাবে চলতি রীতিতে লেখা আরম্ভ করেন- তখন থেকেই কিন্তু চলতি রীতিই মান ভাষা, বাংলা ভাষা। এ কাজ করতে গিয়ে তাঁর ভাষাকে সৃষ্টি করতে হয়েছে। তাই তিনি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ সন্তান।
শুধু সাহিত্য ও ভাষার ক্ষেত্রেই নয়- রবীন্দ্রনাথ তাঁর অসংখ্য কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রভৃতির মাধ্যমে বাঙ্গালীর মনন, রুচি, সংস্কৃতিও তৈরি করতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন।
ফলে, আমাদের ভাষা কেন্দ্রিক যে জাতীয়তা বোধ- সেই বাঙ্গালী জাতিয়তাবোধই অসম্পূর্ণ থেকে যায় রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে।
কেন ও কিভাবে সোনার বাংলা আমাদের জাতীয় সঙ্গীতঃ
পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর হাতে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা থেকে যায়- মুসলীম লীগের প্রতিষ্ঠাতা নেতা জিন্নাহর হাত ধরে। যে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব- সেখানে পূর্ব ও পশ্চিম দুটি অংশের মধ্যে একমাত্র মিল ধর্ম- ইসলাম।
পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী প্রথমেই আঘাত হানে আমাদের বাংলা ভাষার উপর। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেয়ার চেস্টা করা হলো। মূল কারণ ঐ ধর্মকেন্দ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সৃষ্টি। ভারতের এক বড় অংশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলা, এই ভাষার উতপত্তি-বিকাশে বড় ভূমিকা বিভিন্ন হিন্দু কবি-সাহিত্যিকদের, তদুপরি পূর্ববঙ্গের মানুষদের সাথে সমস্ত দিক দিয়েই পশ্চিম পাকিস্তানীদের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের সাথে আত্মিক যোগাযোগ যুগযুগ ধরেই অনেক ভালো ছিল। ফলে, পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী প্রথম থেকে এখানকার লোকদের ভাষা, কৃষ্টি-কালচারকে ভালো নজরে দেখতে পারেনি- যা তাদের চোখে হয়ে দাঁড়ায় হিন্দুয়ানি। বাংলাকে তারা দেখেছিল হিন্দুর ভাষা হিসাবে। ফলে খড়গ নেমে আসে ভাষার উপরে- তৈরি হয় বায়ান্নো।
এই ভাষার লড়াই করতে গিয়ে অনন্য এক অভিজ্ঞতা হয় বাংলার। আগের স্ট্রীমের বাংলা থেকে তার একটি পার্থকয় তৈরি হয়ে যায়। এবারে বাংলা পায় একটি লড়াই এর চেতনা। ভাষার জন্য লড়াই- পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের বাংলা হয়ে ওঠে তেজোদ্দীপ্ত বাংলা। আর, এর মধ্য দিয়ে আরেকটি ঘটনা ঘটে, সেটা হলো বাঙ্গালী জাতিসত্তার উন্মেষ। এই ভাষা আন্দোলনের তাতপর্য এখানেই অনন্য যে, এর মধ্য দিয়ে আমরা পাকিস্তানী ধর্মভিত্তিক জাতিসত্তার অন্তসারশূণ্যতা উপলব্ধি করি এবং একই সাথে- আবহমান অবিভক্ত বাংলার যে বাঙ্গালী জাতিসত্তা তার সাথেও একটা সীমারেখা তৈরি হয়ে যায় আমাদের এই ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া বাঙ্গালী জাতিসত্তার। ফলে, স্বভাবতই এই বাঙ্গালী জাতীয়তাবোধের সাথে আছে লড়াইয়ের তেজ, আছে অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা এবং ভাষার সাথে গাটছাড়া এক সম্পর্ক।
এদিকে ভাষার লড়াইয়ে হেরে গিয়ে শাসক গোষ্ঠী শুরু করে দেয় সাংস্কৃতিক দমন, পীড়ন, নির্যাতন। অন্যান্য অর্থনৈতিক শোষণের সাথে সমান তালে এসবও চলতে থাকে। ফলে, একে কেন্দ্র করে লড়াইও চলতে থাকে সমান তালে। সবচেয়ে বেশী আক্রমণ আসে, রবীন্দ্র চর্চার উপর। কেননা, আগেই বলেছি- রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে বাঙ্গালিত্বের আর কিছু থাকে। খুঁজে-ফিরে আমদানি করা হয় মুসলমান কবি-সাহিত্যিককে। এককালের কাফের উপাধী পাওয়া নজরুলকে মুখোমুখি করাতে চাইলো রবীন্দ্রনাথের। আমরা দুজনকেই আকড়ে ধরলাম, কাউকে কারো প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে নয়, দুজনকেই পরম বন্ধু হিসাবে। ফলে, আমরা প্রতিবাদী জলসায় কারার ঐ লৌহ কপাট এর সাথে সাথে আমার সোনার বাংলাও গাইলাম।
তারপর তো, সবই ইতিহাস। রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকী। রবীন্দ্র চর্চার উপর নিষেধাজ্ঞা- জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনে বাঁধা, আর অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে লড়াই- এবং রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলাকে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদায় অভিষিক্ত করা।
এভাবে শাসক গোষ্ঠী রবীন্দ্রনাথকে যতই আমাদের কাছ থেকে দূরে সরাতে চেয়েছে- ততই রবীন্দ্রনাথ হয়ে গেছেন বাঙ্গালী চেতনারই অংশ-বিশেষ।
বাংলা ভাষা, রবীন্দ্রনাথ, জাতীয় সঙ্গীতের বিরোধীতা একই সূত্রে গ্রোথিতঃ
বাংলা ভাষা, রবীন্দ্রনাথ ও জাতীয় সঙ্গীতের বিরোধীতার মূলে আছে- সাম্প্রদায়িকতা, উপরের আলোচনায় তা নিশ্চয় এতক্ষণে পরিস্কার হয়েছে। ত্রিভুজ সেনাপতি আশরাফও তার এক পোস্টে এরকম একটি কথা লিখেছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথ নিজে ব্রাহ্ম হলেও তিনি হিন্দুত্ববাদের প্রচার করে গেছেন!!!
ত্রিভুজ গোত্রীয়রা আজ যেসব যুক্তি(!!) করছে- একই কথা পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী আমাদের এখানে প্রচারের চেস্টা চালাতো। তাদের হয়ে এ প্রচারকার্যের মূল দায়িত্ব পালন করতো এখানকার রাজাকার ও মুসলিম লীগের দালালরা। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, সে সময়ে চেতনার জায়গা বা লেভেলটা এমন জায়গায় ছিল যে, যখনই কেউ রবীন্দ্রনাথ বা হিন্দুত্ব নিয়ে কথা বলতে আসত- সাথে সাথেই তাকে দালাল হিসাবে প্রতিরোধ করতো। ফলে, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কোন চক্রান্তই হালে পানি পায়নি।
আজও, দালালরা, মানে রাজাকার-রাজাকারপুত্র-নব্যরাজাকাররা একই ধরণের যুক্তি করতে চায়- জাতীয় সঙ্গীত পাল্টানোর কথা বলে - এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যার অপরনাম বাঙ্গালিত্বের চেতনার মূল যে চেতনা সেই অসাম্প্রদায়িক সেক্যুলার চেতনাকে আঘাত করা।
আরেকটি চমতকার(!) যুক্তি আজকাল প্রায়ই শোনা যায়ঃ এই জাতীয় সঙ্গীত আমাদের বাংলাদেশকে ধারণ করে না; বা আরো ভালো কোন সঙ্গীত যদি বাংলাদেশকে ধারণ করতে পারে তবে- সেটিকে জাতীয় সঙ্গীত করা উচিত। আজ জাতীয় সঙ্গীতকে কেন্দ্র যিনিই কথা বলছেন- বুঝতে হবে চিন্তায়-মানসিকতায় সকলেই 'একই গোয়ালের গরু' প্রকৃতির। সেদিনের মত আজও তাদের দালাল-রাজাকার হিসাবে প্রতিরোধই কাম্য।
আর, বাংলাদেশকে ধারন করা প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য হলো- এই গানের মত বাংলাদেশকে ধারণ করে, আমাদের ইমোশনকে ধারণ করতে পারে আর একটি গানও আমি কোনদিন শুনিনি। এমনকি অন্য যেকটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের ইংরেজী অনুবাদ পড়েছি- সেগুলোকেও আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের তুলনায় কিছুই মনে হয়নি- কেননা আমাদেরটি একই সাথে দেশকে ও দেশের প্রতি আবেগকে তুলে ধরে। আর, যদি এই গানটির কথায়-সুরে তা এমন মাটিছোয়া-হৃদয়গ্রাহী না-ও হতো, তারপরেও এই গানটিকেই জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে রাখতে হবে এ কারণে যে, এর সাথে একটি ইতিহাস আছে, তাকে ছাপিয়ে আছে একটি চেতনা- যে চেতনাটি হলো অসাম্প্রদায়িক-সেক্যুলার বাংলার চেতনা।সকলকে ধন্যবাদ
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০০৮ বিকাল ৪:০৭