দোল পূর্ণিমার পরে পুকুর-নালার পানি বাড়তে শুরু করেছে। গাছে গাছে বিভিন্ন রঙের কচি পাতা। কোকিলের ডাকও বেড়েছে। চারদিকে মিষ্টি বাতাস, সূর্যের প্রখরতা গায়ে লাগে না। আস্তে আস্তে গরম পড়বে। আকাশে জমবে মেঘ। মন ভরে দেখা যাবে না সূর্যের লাল রং। এখনই তো কুয়াকাটা যাওয়ার সময়। জীপে বসেই আমজাদ হোসেন ঠিক করে ফেললেন কিছু দিনের জন্য কুয়াকাটা যাবেন।
হোটেলটা ভালো। খাওয়ার ব্যব¯থা আছে। বাইর থেকে খাবার এনে খাওয়া একটা ঝামেলার কাজ। দুপুরে খেতে বসেই পরিচয় হয়ে গেল মোবারক হোসেন আর কাশেম আলীর সাথে। খুব ভালো লাগল। তাদের সাথেই গিয়েছিলেন সূর্যাস্ত দেখতে। বেশি দূর যেতে হয়নি। হোটেলটা বীচের কাছেই। হোটেলে বসেও সূর্যাস্ত দেখা যায়। সমুদ্রের বাতাসও আসে হোটেলে। কক্সবাজারে তিনি গিয়েছেন কয়েকবার। সেখানকার হোটেলগুলো সমুদ্রের এত কাছে ছিল না। এখন সমুদ্রের কাছাকাছি কোনো হোটেল হয়েছে কি না তা তিনি জানেন না। জানতেও চান না। অনেক দূর। ওখানে বোধ হয় আর যাওয়া হবে না। একটা নিশ্বাস ফেললেন তিনি। তারপরে চলে গেলেন ওযু করার জন্য।
জায়নামাজে বসে আছেন আমজাদ হোসেন। তার নতুন বন্ধুরা দরজায় নক করলেন। দরজা খোলাই ছিল। তিনি পেছন ফিরে তাকালেন। মোবারক হোসেন বললেন, চা খেতে আসুন। তিনি উঠে জায়নামাজ ভাঁজ করতে করতে বললেন, কোথায় ? কাশেম আলী বললেন, এখানেই। তিনি বের হলেন। তিনজন একত্রেই সামনে গেলেন। একটা খোলা বারান্দা। কিছু অংশ ছাদের নীচে, কিছু অংশ আকাশের নীচে। আকাশের নীচে বসে আছে সিমকি। তার সামনে টেবিল নেই। পাশে কোনো চেয়ারও নেই। একমাত্র চেয়ারে বসে আছে সে। এমনভাবে বসে আছে যেন ডানে তাকালেই দেখা যায় তার দিকে কেউ আসছে কি না। সে বা’ দিকে তাকিয়ে সমুদ্র দেখছে। ডান দিকে একবার তাকিয়ে তাদেরকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে নিজের মতো করে। আকাশের নীচে বড় একটা টেবিল আছে। পাঁচটা চেয়ার আছে। এখানে বসেই তাদের চা খাওয়ার কথা। মোবারক হোসেন রেলিংয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। সিমকির সুন্দর মুখটা তার দিকে ফিরল। তিনি বললেন, আমরা কি একটু এখানে বসে চা খেতে পারি ? সে মৃদু হেসে বলল, অবশ্যই। কাশেম আলী বললেন, আপনি অনুমতি দেবেন সেটা আমরা জানি কিন্তু আমরা বসলে আপনি উঠে যাবেন সেটা আমরা চাই না। সিমকি আবারও স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে বলল, ঠিক আছে, আমি উঠব না।
হোটেল বয় চা নিয়ে এল। মোবারক হোসেন বললেন, আর এক কাপ দাও না, ভাই !
কাশেম আলী সিমকিকে চা খেতে ডাকলেন। সে হাসিমুখে বলল, না, ভাইয়া, আপনারা খান। কথাটা এত সুন্দর করে বলল যে সবার মন ছুঁয়ে গেল। মনে হল যেন সে তাদেরই ছোট বোন। তারা আরো বেশি আগ্রহ নিয়ে ডাকলেন। সিমকি আসলো। মোবারক হোসেন বললেন, আমরা দুজন ছোট বেলা থেকে বন্ধু। এক সঙ্গে পড়াশোনা করেছি। কাশেম আলী বললেন, আমাদের যোগাযোগ সব সময়ই ছিল। কিছু বন্ধু আছে এমন যে পড়াশোনা শেষে হারিয়ে গিয়েছিল আবার অনেক বছর পরে দেখা হয়েছে। আমাদেরটা সে রকম নয়। আমজাদ হোসেন এবং সিমকি তাদের কথা উপভোগ করছেন। মোবারক হোসেন বললেন, কুয়াকাটা এসেছি বউয়ের যন্ত্রণা থেকে কিছুদিন দূরে থাকার জন্য। সারা দিন একটাই গান, এটা নেই, ওটা নেই। আর ভালো লাগে না। আমজাদ হোসেন বললেন, বলেন কী ? স্ত্রী হচ্ছে আপনার সুখ, আপনার ঘরের সৌন্দর্য। সে আপনার ঘরটা গুছিয়ে রাখে, আপনার কাপড়টা পরিষ্কার করে রাখে, আপনার খাবারটা ঠিক করে রাখে, তার যন্ত্রণায় আপনি এখানে এসেছেন ? সে যদি না বলে তা হলে আপনি কী করে বুঝবেন আপনার সংসারে কোন জিনিসটা দরকার ? কাশেম আলী বললেন, আরে ভাই, এটা বাস্তবতা। আমিও তো এসেছি বাচ্চাদের যন্ত্রণায়। দুজনই সায়েন্সে পড়ে, যা চায় তাতেই দাম। ঘরের মধ্যে আমার ঢুকতেই ইচ্ছে করে না। তাই ভাবলাম দুদিন সমুদ্রের বাতাস খেয়ে আসি। দুটো দিন তো শান্তিতে থাকা যাবে। আমজাদ হোসেন মন খারাপ করে বললেন, আমি আপনাদের কথা বুঝি না। শান্তির জন্য আপনারা কুয়াকাটা এসেছেন। যে ঘরে বাচ্চা নেই সে ঘরে কি শান্তি আছে ? মানুষের জীবনে মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবার ভালোবাসা যেমন দরকার তেমনি স্ত্রী-সন্তানের ভালোবাসাও দরকার। যার ঘরে স্ত্রী-সন্তান নেই তার ঘরটা তো মাছের জন্য ডাঙা। মোবারক হোসেন বললেন, বুঝতে পেরেছি, আপনি খুব সুখি মানুষ। টাকা-পয়সার অভাব নেই তো, সুখ কিনতে পারেন খুব সহজে। করতেন আমাদের মতো সরকারি চাকরি, বুঝতেন কষ্ট কাহাকে বলে, কত প্রকার, কী কী, প্রত্যেক প্রকার উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলতে পারতেন। সবাই হাসলেন। কাশেম আলী বললেন, আমরা এখানে তিন বছর ধরে আছি। বলা যায় কুয়াকাটা আমাদের নাকের ডগায় কিন্তু স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আসব সেটা আর ভাগ্যে জোটেনি। ঠিক আছে, আমজাদ ভাই, আপনি কেন একা আসলেন সেটা বলেন। আমজাদ সাহেব মৃদু হেসে বললেন, পরে বলব। সিমকি ভাবল, এর পরে বোধ হয় আমাকে জিজ্ঞেস করা হবে আমি কেন একা এসেছি। আমি কি বলব ? যখন আমি বলব মানুষের মিথ্যাচার, অহংকার, বিশ্বাসঘাতকতা, নিষ্ঠুরতা, ষড়যন্ত্র আর স্বার্থচিন্তা দেখে আমি বিয়ে না করে থাকার চেষ্টা করছি। আমি একটা ব্যাংকে চাকরি করি। ম্যানেজার স্যার আমাকে বোনের মতো ¯েœহ করেন কিন্তু কিছুদিন হয় তার অত্যাচারে আমার অফিসে যেতে ইচ্ছে করে না। তিনি আমাকে বিয়ে দিতে চান। তার পরিচিত ছেলে, ভালো চাকরি করে, পরিবারও ভালো কিন্তু আমি বিয়ে করতে ভয় পাই। এত দিন আমি এক কথায় সবাইকে ফিরিয়ে দিতাম বিয়ে করব না বলে কিন্তু স্যারের আন্তরিকতা আর ছেলের প্রোফাইলটা আমাকে সিদ্ধান্তহীনতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না তাই ছুটি নিয়ে ঢাকায় গেলাম ট্রান্সফার হওয়ার জন্য। ট্রান্সফারের অর্ডার হয়ে গেল কিন্তু যে ব্রাঞ্চে আমি যাব সেখানকার পোস্ট খালি হতে আরো দুদিন লাগবে। ভাবলাম সে দুটো দিন সমুদ্রের সাথে কাটাই। স্যারের অনুরোধ শুনতে আমার আর ভালো লাগে না, তখন সবাই কী ভাববে ? সমাজে অবিশ্বাস আর অত্যাচার সব সময়ই ছিল তাই বলে ক’টা মানুষ বিয়ে না করে থেকেছে ?
কাশেম আলী সিমকিকে বললেন, আপনি কেন একা এসেছেন, আপা ? সিমকি হেসে বলল, পরে বলব। মোবারক হোসেন সিমকিকে বললেন, এখান থেকে সূর্য ওঠা দেখা যায় না , জানেন ?
: জানি।
: দেখবেন ?
: কিছু ঠিক করিনি।
: মোটর সাইকেলে যাবেন-আসবেন, দুশ টাকা।
: আমি মোটর সাইকেলে যাব না।
: ভ্যানে গেলে অনেক আগে বের হতে হবে।
: তাহলে যাওয়া হবে না।
কাশেম আলী বললেন, কুয়াকাটা হচ্ছে বিশ্বের একমাত্র সমুদ্রসৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়। এ জন্যই মানুষ এখানে আসে। রাস্তার যে অব¯থা, এখানে মানুষ আসত ? কক্স বাজার গিয়েছেন ?
: জি।
: পানি কত স্বচ্ছ, ঢেউ কত বড়, সৈকত কত চওড়া, আর লম্বা ? তা তো জানেনই।
: জি।
: বিশ্বের কোথাও এত বড় সৈকত নেই। একটা ভ্যানে চার জন যাওয়া যায় খুব ভালোভাবে। যদি কিছু মনে না করেন, আপনি আমাদের সাথে যেতে পারেন।
: ঠিক আছে।
আমজাদ হোসেন কিছু বললেন না অথচ সিমকির মনটা তার দিকেই ঝুঁকে আছে। মোবারক হোসেন আর কাশেম আলী তার প্রতি এত আগ্রহ দেখাচ্ছে অথচ তাদের বেশি কথা বলার স্বভাবটা সে মেনে নিতে পারছে না। পরিবার সম্বন্ধেও তাদের ধারণা ভুল। ইস ! সব পুরুষ যদি আমজাদ সাহেবের মতো হত ! পৃথিবীটা হয়ত তাদের কাছেই ভালো লাগে যাদের ভালোবাসার মানুষ আছে।
তিনটে রাত, দুটো দিন তারা চারজন একত্রেই কাটালেন। খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে গেল তাদের মধ্যে। সকাল বেলা সবাই নিজ নিজ বাসে উঠবেন। তার আগে নাস্তার টেবিলে মোবারক হোসেন বললেন, কাশেম, তারা দুজন বলেছিল, পরে বলব, তোর মনে আছে ?
: অবশ্যই মনে আছে। পরে মানে এখন। এর পরে আর কোনো পর নেই।
আমজাদ হোসেন এবং সিমকি মুখ টিপে টিপে হাসছেন। কাশেম আলী বললেন, সিমকি আপা আগে বলেন।
: আমি একা এসেছি...কারণ আমি একাই। দশ বছর ধরে চাকরি করছি। কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় না।
: মাস্টার্স শেষ করে ঢুকেছেন ?
: জি।
: দশ বছরেই হাপিয়ে উঠলেন ? আমাদের সবার বিশ বছর। আমরাও মাস্টার্স পাস করার আগে কোনো চাকরিতে ঢুকিনি। জানি তো, একবার ঢুকলে আর কেয়ামতের আগে বের হতে পারব না।
সবাই হাসলেন। মোবারক হোসেন বললেন, আমজাদ ভাই, এবার আপনার পালা।
আমজাদ হোসেন বললেন, আমি এসেছি আনন্দ করার জন্য। আমার স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে আমি খুব কষ্টে আছি। আমার পরিচিত লোকজনের মধ্যে আমার আর ভালো লাগছিল না। আমি চেয়েছিলাম, হোটেলে যেন আমি মেশার মতো কাউকে পাই। আমি যদি প্রথম দিনই আমার এই কষ্টের কথাটা আপনাদেরকে বলতাম তাহলে আপনারা আমার সাথে আনন্দ করতেন না। আমার একটা সন্তানও নেই যাকে নিয়ে আমি বাঁচব।
সবার মুখ মলিন হয়ে গেল। আমজাদ হোসেন বললেন, দুঃখিত, আমি এই পরিবেশটা সৃষ্টি করতে চাইনি। চলুন, বের হই।
এক বাসে মোবারক হোসেনরা আর এক বাসে আমজাদ হোসেন উঠলেন। সিমকির বাস আরো আধ ঘন্টা পরে। সে স্টেশন বিল্ডিং থেকে বের হল না।
কাশেম আলীদের বাস ছেড়ে গেল। আমজাদ হোসেনেরটার ইঞ্জিন শব্দ করে উঠল। তিনি বাইরে তাকালেন। সিমকি দ্রুত এসে বলল, ভাইয়া, আপনার ফোন নাম্বারটা দিবেন ? কার্ডটা তিনি হাতে নিয়েই বসে ছিলেন। চাওয়ার সাথে সাথেই দিয়ে দিলেন। পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন, সুখের হাসি হাসলেন। মিষ্টি একটা বাতাসে শিরিষের পাতা ঝিরঝির করে উঠল।
রচনা- ৩০.৩.১২
প্রকাশ- ১৫.৬.২০১২