তমা নিলয়
নাসরিন সুলতানা
মমতা ইসলাম অবসরকালীন প্রস্তুতিজনিত ছুটি ভোগ করছেন। এত বছর সরকারি চাকরি করেছেন। এখন বেকার। ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে যায় তার। কে যেন এক দিন তাকে বলেছিল এয়ার পোর্টের পেছনের দিকে কিছু দূর গেলে একটা গ্রামের পরিবেশ পাওয়া যায়। কোনো দিন যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তার কাছে ছুটির দিন মানেই ঘরে থাকা। কাজ অথবা ঘুম। কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। এখন তার অখন্ড অবসর। একটা রিক্শা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। ঘণ্টা হিসেবে ভাড়া দিবেন। মনে মনে ঠিক করে নিয়েছেন রিক্শাওয়ালা যা চাইবে তার চেয়ে একটু বেশিই দিবেন। কত দিন গ্রাম দেখা হয় না। রিক্শাওয়ালা তাকে গ্রাম দেখাবে। অনেক টাকা তার প্রাপ্য। হঠাৎ রিক্শাওয়ালা তাকে প্রশ্ন করল , ম্যাডাম , আপনি কি কবি ?
: না তো !
: কবিরা এই রকম ঘণ্টা হিসাবে রিক্শা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আবার কেউ কেউ আসে বাচ্চা নিয়ে। ঢাকা শহরের বাচ্চারা তো জানে না , গ্রাম কেমন তাই তাদেরকে দেখাতে আনে।
মমতা ইসলামের মনটা দিগি¦দিক ছুটল। তারও একটা শৈশব ছিল। শৈশবে তিনি গ্রামে ছিলেন। তিনিও এক সময় কবিতা লিখতেন ইত্যাদি। রিক্শাওয়ালা জিজ্ঞেস করল , ম্যাডামের জন্ম কি শহরেই ?
: না।
মমতা ইসলামের গ্রামের বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল। ঘরের পেছনে পুকুর, সামনে উঠান। পুকুরের পেছনে বাগান, বাগানের পরে খাল। খালপাড়ে যাওয়ার জন্য একটা পথ আছে। কারণ নৌকা তাদের একমাত্র পরিবহন। উঠানের পরে বৈঠক ঘর, তারপরে সবজির ক্ষেত। দুটো ক্ষেতের মাঝখানে পথ। সামনে রাস্তা। রাস্তার পরে মসজিদ, তারপরে পুকুর। পুকুরের পরে ধানের জমি। তাদের বাড়িটা অনেক বড়। বাড়িতে অন্য কোনো পরিবার নেই। নিজেদেরই ছিল হাঁস, মুরগি, তিতির, কবুতর, রাজহাঁস, গরু আর ছাগল। সে গুলোর জন্য কয়েকটা ঘর ছিল। এসব নিয়ে দিন কেটে যেত বেশ। তাদের গ্রামে এমন কোনো ফলের গাছ নেই যা তাদের বাড়িতে নেই। কমলা , জাম্বুরা , আমড়া , কামরাঙা ইত্যাদি ফলও টক লাগত না। সবাই বলত এই বাড়িতে যাদু আছে। যা-ই হোক, মসজিদ বাদ দিলে অন্যান্য দৃশ্য সব বাড়িতে মোটামুটি একই রকম। কারো সামনের পুকুরটা রাস্তার ভেতরে, কারোটা বাইরে। বৈঠক ঘর সব বাড়িতে না থাকলেও বাড়িগুলো সারিবদ্ধভাবে সাজানো। ও রকম গ্রাম তিনি আর কোথাও দেখেননি। যদিও কাঁচা রাস্তা, বিদ্যুৎ নেই তবুও মনে হয় অনেক সুন্দর ঐ গ্রামটা। গ্রামটা দক্ষিনমুখী। তাদের সামনের পুকুরের উত্তর পাশে একটা চৌকি পাতা ছিল। ওপরে গোল পাতার ছাউনি দেওয়া। গরমের দিনে ওখানে বসে বা শুয়ে থাকলে ঠান্ডা বাতাস এসে গায়ে লাগে। সন্ধ্যার পরে মমতার বোনরাও ওখানে গিয়ে বসতেন বা শুয়ে থাকতেন। দুপুরে ভাত খেয়ে মমতা ইসলাম ওখানে গিয়ে ঘুমিয়ে থাকতেন। দু’তিন দিন পরে তার বড় বোন জানতে চাইলেন যে তিনি দুপুর বেলা কেন অন্য বাড়িতে খেলতে যান। তখন তিনি এটা বললেন। তারপর তাকে বোঝানো হল যে ওখানে ঘুমিয়ে থাকলে কেউ চুরি করে নিয়ে যাবে। আর ঘুমাননি তিনি ওখানে।
বড়রা বলতেন, মমতা অসাধারণ মেধাবী মেয়ে । তিনি যখন খুব ছোট ছিলেন তখন নাকি একটা কাগজে লিখেছিলেন ‘বিবি’। ঐ কাগজটা ছিল প্রথম শ্রেণির বাংলা বইয়ের একটা বিচ্ছিন্ন পৃষ্ঠা। বড় করে ছাপার অক্ষরে ‘বিবি’ লেখাটা। দেখে দেখেই লিখে ফেলেছিলেন তিনি। শেখার ইচ্ছে ছিল তার খুব। তার বড় ভাই খুলনায় থাকতেন। তার বোন তাকে চিঠি দিতেন। ভাইয়ের চিঠি পেয়ে বোন আনন্দে উদ্বেলিত হতেন। তারও সখ জাগত ভাইয়ের হাতের একটা চিঠি পাওয়ার। তিনি তার বোনকে বলতেন ভাইয়ের কাছে একটা চিঠি লিখে দিতে। তার বোন লিখে দিতেন এবং সেটা দেখে দেখে তিনি আবার লিখতেন অথচ তাকে কোনো অক্ষর লিখতে শেখানো হয়নি। বাধ্য হয়ে তার ভাই সেই ছোট বয়সেই তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন স্লেট-পেন্সিল। তার বোন তাকে লেখা শেখাতেন। তার হাতের লেখা খুব ভালো। তার লেখা অনুকরন করতেন তিনি। কোনো অক্ষর শিখতে তার বেশি সময় লাগত না। সবাই অবাক হয়ে যেতেন। অসাধারণ মেধা। প্রথম শ্রেনির পাঠ তিনি ঘরে বসেই শিখেছিলেন। স্কুলে গিয়ে বার্ষিক পরীক্ষা দিয়েছেন। তার পর থেকে নিয়মিত স্কুলে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু যেতে দেওয়া হয়নি। কারণ তিনি অতিরিক্ত ছোট। পুকুর-ডোবায় পড়লে উঠতে পারবেন না। দ্বিতীয় শ্রেনির বার্ষিক পরীক্ষা দিতে আবার তিনি স্কুলে গেলেন। প্রথম হলেন। এবার তাকে স্কুলে যেতে দিতেই হবে। তার ছয়টা বই। একটা ব্যাগ কিনে দেওয়া হল। তিনি নিয়মিত স্কুলে যাওয়া শুরু করলেন। বাড়িতে তার কোনো পড়াশোনা ছিল না। শিক্ষক যখন ক্লাসে পড়াতেন তখনই তার পড়া হয়ে যেত। এক দিন তার বোন পড়া ধরলেন। ইংরেজি পড়া। গল্পের নাম ‘এ প্যারট’। তার শিক্ষক বলেছেন প্যারট মানে পাউরুটি। রাস্তার পাশের খোলা পাউরুটি খাওয়া উচিৎ নয়। তাতে ময়লা এবং রোগজীবানু থাকে। প্যাকেট করা পাউরুটি খাওয়া উচিৎ। খোলা পাউরুটি খেতে যদি একান্তই বাধ্য হও তাহলে ঝাড়া-মোছা দিয়ে পরিষ্কার করে নিও। পুরো গল্পটা মমতা এভাবেই শেষ করেছিলেন। এক লাইন ইংরেজি পড়েছেন , পরে তার বাংলা বলেছেন। তার বোন সেদিন অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর সঠিক অনুবাদ শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর থেকে প্রতিদিন তাকে পড়তে বসতে হত। ঠিক পড়তে নয় ; পড়া দিতে। পড়া ভুল দিলে তাকে শুধরে দেওয়া হত। এক পড়া তাকে দুবার বোঝানোর প্রয়োজন হত না। সবাই বলতেন তার মেধা শের-ই-বাংলার মতো।
থ্রিতে পড়াকালীনই লিখে ফেললেন ছড়া। লিখে গোপন রাখতেন। কাউকে দেখাতেন না কিন্তু সবাই দেখে ফেলতেন। কোনো দিন কোনো পেপারে ছাপানোর চেষ্টা করেননি। সে রকম কেউ ছিলেনও না যে তার লেখা ছাপানোর উদ্যোগ নেবেন। খুব সখ ছিল, কোনো দিন যদি একটা লেখা পেপারে ছাপা হত ! তবে কখনো কাউকে বলেননি। একটা সখ পূরণ করার সাধ্য তার নাগালেই ছিল। সেটা হচ্ছে রেডিওতে চিঠি লেখা। রেডিওতে তার নাম বলবে, তার উদ্দেশে দুটো কথা বলবে, খুব ভালো লাগবে। এই কাজটা তিনি করতেন তবে বাড়ির কেউ জানতেন না। তার মনে হচ্ছিল, কেউ জানলে তাকে রেডিও শুনতে দেওয়া হবে না। তার চিঠি লেখাও বন্ধ হয়ে যাবে। এ রকম মনে হওয়ার কারণ হচ্ছে এই যে তার ভাই খুব রাগী মানুষ। পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছু তিনি পছন্দ করতেন না। দা-বটি ধরা তার জন্য পুরোপুরি নিষিদ্ধ ছিল। হাত কাটলে লিখতে অসুবিধে হবে, লেখা কিছু দিন বন্ধ থাকবে তা হবে না। কাঠবাদাম, পানিতাল, ডাব, তালের কোপরা তিনি নিজেই কেটে খাওয়াতেন। গাছে ওঠা যাবে না, পুকুরে বেশিক্ষন থাকা যাবে না, অনেক নিষেধ ছিল তার। কোনো ধরণের খেলাধুলা পছন্দ করতেন না তার ভাই। বেড়াতে যেতে হবে মায়ের সাথে তাও স্কুল বন্ধ থাকাকলীন।
বেড়ানো মানে নানা বাড়ি যাওয়া। মামা অথবা মামাতো ভাইয়ের সাথে বলেশ্বর নদীর পাড়ে যাওয়া ছিল তার কাছে সবচেয়ে আনন্দের বিষয়। জেলেরা ইলিশ মাছ তুলত , লাফাতে লাফাতে মরে যেত। সেই মাছ কিনে আনা হত। অনেক সুস্বাদু ছিল সেই মাছ। ভাজি করার সময় চার দিকে একটা লোভনীয় গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত। ইলিশ মাছের সেই গন্ধ, সেই স্বাদ এখন আর পাওয়া যায় না। মাছের সাইজও অত বড় হয় না। আর বেড়াতেন বড় বোনের শ্বশুর বাড়ি। দুলাভাই ছিলেন হাই স্কুলের টিচার। বাজারে তার দোকানও ছিল। স্ব-মিল ছিল। ভালো ব্যবসায়ী। বাড়ি ফেরার সময় প্রতি দিন তার জন্য মজার খাবার নিয়ে আসতেন।
একবার রেডিওতে তার নাম শোনা গেল। তিনি তখন বেড়াতে গিয়েছেন। তার বোন এই খবরটা সবাইকে দিয়েছিলেন। তাকে কেউ বকলেন না। তিনি ধরে নিলেন এটা বুঝি পাস হয়ে গেল। রেডিও শোনা যাবে, চিঠিও লেখা যাবে। এইটে বার্ষিক পরীক্ষার পরে ছোট একটা উপন্যাসও পড়তে নিলেন তিনি। তার বোন সেটা কেড়ে নিলেন। বললেন যে উপন্যাস পড়ার বয়স তার হয়নি। পাঠ্য বই ছাড়া কোনো সাহিত্য তাকে পড়তে দেওয়া হত না তবে কোরআন শরীফের বাংলা অর্থ ও ব্যাখ্যা ক্লাস ছিক্স থেকেই পড়তে হয়েছে। একটা উপন্যাস আর একটা নাটক তার এসএসসির পাঠ্য ছিল। ও-ই তার পড়া প্রথম উপন্যাস আর নাটক। এইচএসসির বই কেনার সময় একটা শেষের কবিতা কিনেছিলেন কিন্তু সেটা পড়ার সময় তিনি বের করতে পারেননি। সেটা তাকে পড়তে হয়েছে ফাইনাল পরীক্ষার পরে। তবে এক সুযোগে লুকিয়ে-চুরিয়ে দেবদাসটা পড়ে ফেলেছিলেন। পরীক্ষার পরে আরো কিছু সাহিত্য তিনি পড়েছেন। কেউ নিষেধ করেননি।
ভাবনায় ছেদ পড়ল মমতা ইসলামের। রিক্শা থামালেন একটা বাড়ির সামনে। বাড়িটার নাম তমা নিলয়। মনে পড়ে গেল তার স্টুডেন্ট লাইফের কথা। পেপারে এক দিন এক ডাক্তার একটা আর্টিকেল লিখেছিলেন পরিবেশ দূষণের ওপর। ঐ লেখাটার ওপর ছোট একটা আলোচনা করেছিলেন মমতা। লেখাটা ছাপা হয়েছিল পাঠকের কলামে। ঠিকানাও লেখা ছিল। সেই ঠিকানায় ডাকযোগে একটা চিঠি দিয়েছিলেন তিনি। সুন্দর একটা খাম, কাগজটাও সুন্দর, সুন্দর ছিল কথাগুলোও। তিন বছর চিঠি বিনিময়। এগার বছর ফোন। তারপরও তিন বছর ফোন করেছেন মমতা কিন্তু তিনি কথা বলেননি। আর যোগাযোগ নেই।
রিক্শা থেকে নামলেন। ঘরটার সামনে ফুল-ফলের গাছ। টিনের চালা, টিনের বেড়া, কাঠের পাটাতন। দেখলে মনে হয় যেন তাদের গ্রামের বাড়ির ঘরটা, শুধু আকারে ছোট। সামনের রুমে এক ভদ্রলোক বসে আছেন। মমতা জানেন না ইনি কে। হাফ হাতার একটা শার্ট, চোখে চশমা, দিনের আলোতে চশমাটা কালো হয়ে আছে। বয়স সত্তরের কম নয় তবে দেখতে খুব সুন্দর ; সুদর্শণ-সুপুরুষ। মমতা সালাম দিলেন। তিনি এমনভাবে পুলকিত হলেন যে মমতা বোকা হয়ে গেলেন। মমতার কণ্ঠ শোনার সাথে সাথে তিনি দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি এসেছ, তমা ? তুমি এসেছ ? আমি পনের বছর ধরে এই ঘরে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। আজকে তোমার আসার সময় হল ?
: আপনি বসুন, প্লিজ।
: সরি, তমা, তোমাকে বসতে বলিনি। আমারই ভুল হয়ে গিয়েছে। বস।
: না, না, ঠিক আছে। আপনি বসুন।
মমতার মনে তখনও সংশয় , ইনি নিলয় নাকি তমা নিলয় মানে তমার বাড়ি। ভদ্রলোক যেন মনের কথা পড়তে পারেন। বললেন, কী ভাবছ ? আমি তোমার নিলয়। কোনো সন্দেহ নেই।
মমতা ধপাস করে বসে পড়লেন। দুহাতে মুখ ঢেকে কান্না শুরু করলেন। ডাক্তার নিলয় রিক্শাওয়ালাকে ডেকে ভাড়া দিয়ে দিলেন। সোফায় বসে বুঝতে পারলেন যে মমতা কাঁদছেন। শব্দ করে একটা প্রশ্বাস নিয়ে লম্বা করেই নিশ্বাসটা ছাড়লেন। তারপর বললেন, কাঁদ, তমা। বেশি করে কাঁদ। হয়ত অনেক দিন আগেই আমার জন্য কাঁদা ছেড়ে দিয়েছ।
নিলয়ের বুকের ভেতরটা হু হু করে কাঁদছে। কিছুক্ষন নীরব থেকে বললেন, তোমার মনে আছে, তমা ? আমি এক দিন তোমাকে বলেছিলাম, তোমার সাথে দেখা হওয়ার সাথে সাথেই জড়িয়ে ধরব। তুমি বলেছিলে ‘অসভ্য’। আজকে তো দেখলে, আমি আসলে অসভ্য নই।
মমতার কান্নাটা থামছে না। নিলয় বললেন, আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে তোমার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। তুমি তখন অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়। আমার বিয়ের বয়স আট বছর। বাচ্চা হচ্ছিল না। শিপ্রার সমস্যা ছিল। অনেক চিকিৎসা করিয়েছি। মানসিকভাবে ও খুব ভেঙে পড়েছিল কিন্তু আমাকে ওর কষ্টের কথা কখনো বলত না। আমি এসব কথা তোমাকে বলিনি। শুধু এক দিন লিখেছিলাম , দারিদ্রের কারণে জন্ম নিয়ন্ত্রন সমর্থন করি না আমি কিন্তু নিয়তি আমার জীবনে এনে দিয়েছে জন্ম নিয়ন্ত্রন। তুমি একবারও জানতে চাওনি সমস্যাটা কী। বুঝে নিলাম, তুমি কারো দুর্বলতা নিয়ে খোঁচাখুঁচি করতে পছন্দ কর না। দিন যত যাচ্ছিল তোমার প্রতি ততই দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম। তোমাকে মনে হয় লিখেও ফেলেছিলাম, তোমাকে যতই দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। সৌম্য-শান্ত ব্যক্তিত্ব। আমি তোমার নাম দিলাম তমা। তুমি একবার প্রশ্নও করনি, তমা মানে কী। হয়ত বুঝতে পেরেছিলে তমা একটা সুপারলেটিভ ডিগ্রি- প্রিয়তমা, সুন্দরীতমা, দি বেস্ট। খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছিল তোমাকে কিন্তু শিপ্রা আমাকে এত ভালোবাসত যে আমি ওকে বলতে পারছিলাম না।
মমতার কান্নাটা থামানো দরকার। তিনি বললেন, আচ্ছা, তমা, তোমার কি মনে আছে , তোমার কথা ওকে আমি কিভাবে বলেছিলাম ?
মমতা কান্নাটা সামলে নিয়ে বললেন, এক দিন সে খবরের কাগজের সাহিত্য পাতা দেখছিল। ঐ পাতায় আমার একটা কবিতা ছিল। আপনি তাকে বলেছিলেন, একে আমি চিনি।
: হ্যাঁ , তারপরে ও জানতে চেয়েছিল , কিভাবে চিনি। আমি তা-ও বলেছিলাম। তখন ও কোনোভাবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেনি। সমস্যাটা হল তখন যখন তুমি ওর সাথে কথা বললে। তোমার এত সুন্দর কণ্ঠ, এত সুন্দর হাসি, এত সুন্দর কথা বলার ধরণ, তোমার কিছু লেখাও ও পড়েছে। ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিল। ভেবেছিল, ও মা হতে পারছে না বলে আমি তোমাকে ভালোবাসি। ওর ধারনা অমূলক ছিল না, এ কথা সত্যি তবে এও সত্যি যে পৃথিবীর যে কোনো মানুষ সে নারী হোক বা পুরুষ তোমাকে ভালো না বেসে পারবে না। তোমার এই সাতান্ন বছরের জীবনে তুমি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পেরেছ যে আমি যা বলছি তা মোটেই আমার মনগড়া কথা নয়। মিনির সাথে আমি এক দিন মজা করে বলেছিলাম, তোমার আপা তো পঁচা। আমি ভালো বলেই সম্পর্কটা টিকে আছে। ও আমাকে বলল, ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দেব। আমি হাসলাম। ও বলল, মমতা আপা আমার দেখা শ্রেষ্ঠ মানুষ। আমি চিন্তা করলাম, দূর থেকে এক জন মানুষকে ভালো লাগা খুবই স্বাভাবিক কিন্তু যে মানুষটা ছোট বেলা থেকে তোমার কাছে থাকে তার কাছে শ্রেষ্ঠ মানুষ হওয়া সত্যিই বড় কঠিন। সে তোমার আপন বোন নয় ; ফুফাতো বোন। মিনি কেমন আছে ?
: ভালো।
: এক দিন তুমি বলেছিলে , আমি বদলী হয়ে ঢাকায় এসেছি। আপনিও আসুন। আমি বদলী হয়ে ঢাকায় এলাম কিন্তু তোমাকে বললাম না। এসেই এই জমিটা কিনলাম। কাউকে বললাম না। বাড়ির কাজ শেষ হওয়ার পরে মা নিলেন। তুমি একদম একা হয়ে পড়লে। আর সে সময়ই আমি তোমাকে ফোন করা বন্ধ করে দিলাম। তারপরও তিন বছর তুমি ফোন করেছ। আমি কথা বলিনি। তারপরে চলে গেল আঠার বছর।
আমি কোনো দিন টিনের ঘরে থাকিনি। তোমাদের বাড়িতে টিনের ঘর, নানা রকম ফলের গাছ। তুমি যখন বাড়িতে ছিলে তখন বিভিন্ন ধরণের ফুলের গাছও ছিল। এই বাড়িটা আমি এমনভাবে করেছি যেন এখানে বসে তুমি তোমার হারানো শৈশবকে কিছুটা হলেও খুঁজে পাও।
একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, শিপ্রা কার কাছে যেন শুনল আমি বাড়ি করেছি। আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমি বললাম, ভালো করে সাজানোর পরে বলতাম। ও আসলো। ঘরে ঢুকেই কেঁদে ফেলল। বলল, সত্যি করে বল তো, এ বাড়ি তুমি কার জন্য করেছ ? রাগে, দুঃখে, হিংসায় ও তখন ফেটে যাচ্ছিল। বলল, ফের যদি তুমি মমতার সাথে কথা বল তাহলে আমাকে তালাক দিয়ে নিও। যদি না দাও তাহলে আমার সাথে সম্পর্ক রাখার অপরাধে তোমাকে জাহান্নামে যেতে হবে। আমি তোমাকে ক্ষমা করব না। এক বছরের মধ্যে যদি আমি মা হতে না পারি তাহলে আমি নিজেই তোমাকে তালাক দিয়ে দেব। আমি তোমার পথ আটকে রাখব না।
এক বছরের মধ্যে ও মা হয়নি ঠিকই তবে দেড় বছরের মধ্যে হল। বাচ্চাটার নাম আমিই রেখেছিলাম তমা। তোমার নামটা যেন আমার ঘরে বার বার শোনা যায় তার জন্যই আমি এই কাজটা করেছিলাম। শিপ্রাকে আমি এই বাড়িতে থাকতে রাজি করতে পারলাম না। ও বলত, ওখানে আমি মমতাকে দেখতে পাই। ওর জন্য একটা ফ্ল্যাট কিনেছিলাম। সেটা এখনো আছে। ও যত দিন বেঁচে ছিল আমরা সেখানেই থাকতাম। একটা গাড়িও কিনেছিলাম। আমার মেয়েটা গাড়ি চড়তে খুব পছন্দ করত। একবার ঈদের আগে বাড়ি যাচ্ছিলাম। গাড়ির ওপর ট্রাক পড়ে গাড়ি দুমড়ে-মুচড়ে গেল আর ওরা দুজন চলে গেল পৃথিবী ছেড়ে। আমি বেঁচে রইলাম কিন্তু আমার চোখদুটো অন্ধ হয়ে গেল।
আমাকে সবাই বিয়ে করতে বলেছিল কিন্তু আমার সাহস হয়নি। তমা, তোমার মনে আছে ? আমি এক বার তোমাকে লিখেছিলাম, হৃদয়ের রূপোলী পর্দায় প্রতিনিয়ত ভেসে ওঠে যে পবিত্র মুখ দাও না, তমা, সে মুখের একটা কাগুজে প্রতিচ্ছবি। দরকার হলে ফেরত দেব তবু দাও। তুমি একট ছবি পাঠালে। ঐ ছবিটা আমি বার বার দেখতাম। শিপ্রা এক দিন ঐ ছবিটা পেয়ে গেল। কিছু জিজ্ঞেস না করেই টুকরো টুকরো করে পুড়ে ফেলল। আমাকে বলল, মমতার সাথে তোমার এখনও যোগাযোগ আছে ? কী পেয়েছ তুমি ওর মধ্যে ? যাকে কোনো দিন দেখনি তার জন্য এত টান কেন ?
তোমার সাথে আমি কথা বলি না। তোমার ছবিটাও নেই। আমার ভেতরে যে কী পরিমান ভাঙচুড় হত তা শুধু আমিই জানি। শিপ্রা ঘুমিয়ে পড়লে অবশিষ্ট রাতটা আমি কেঁদেই কাটাতাম আর আল্লাহর কাছে বলতাম, আমার চোখদুটো তুমি অন্ধ করে দাও।
: কেন ? মমতা আর্তনাদ করে উঠলেন। আবার কান্নার গতি বাড়িয়ে দিলেন।
: আমার সে প্রার্থনা আল্লাহ কবুল করেছিলেন কিন্তু আমার অনেক বড় একটা ক্ষতি হয়ে গেল। আমার কেন যেন মনে হত তুমি বিয়ে করনি কিন্তু আমি যে তোমাকে আমার কাছে এসে থাকতে বলব তাও পারিনি। কারণ আমি অন্ধ, আমার স্ত্রী-কন্যা মারা গিয়েছে। আমার এই গ্লানি আমি তোমার হাতে তুলে দিতে পারি না। তোমাদের বাড়িতে পাঁচটা পুকুর ছিল। বাবার যুক্তি ছিল , বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি নেই। বেশি পুকুর থাকলে বাড়িটা ঠান্ডা থাকবে। এই বাড়িটার পেছনেও একটা দিঘি আছে। রিক্শায় বসে হয়ত দেখেছ। ঐ দিকটা দক্ষিন। ঠান্ডা বাতাস আসে কিন্তু আমি ওখানে গিয়ে বসতে পারি না। শুধু মনে হত তুমি এসে যদি ফিরে যাও !
: আমি যাব না, সোনা ! তোমাকে ছেড়ে আমি আর কোনো দিন যাব না।
রচনা- ২৬.০৯.২০১১
প্রকাশ- ডিসেম্বর, ২০১১
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০১৪ রাত ৮:৪৩