একতারার ছেঁড়া তার
নাসরিন সুলতানা
বাইর থেকে এসেই দীপু শুয়ে পড়েছে। কারো সাথে কোনো কথা বলেনি। বাসায় থাকলে দুপুরের ভাত খেয়ে ও ঘুমায়। সেটা স্বাভাবিকও কিন্তু আজকে ও ঘুমায়নি। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। তাহলে কি ওর শরীরটা ঠিক নেই ? একবার জিজ্ঞেস করতে চেয়েও করা হয়নি। কারণ ওর মা’র আজকে মন খারাপ। যন্ত্রের মতো রান্নাটা শেষ করেছেন। খেয়ে শুয়ে পড়েছেন। তিনিও ঘুমাননি। তার মনটা খারাপ বলে তার স্বামীর মনটাও তেমন ভালো নেই। তারও দুপুরের ঘুমটা হল না। দুপুরে খাওয়ার পরে ঘুমানো তাদের অভ্যাস। না ঘুমালে শরীর ভালো লাগে না। শরীর ভালো না লাগলে কোনো কিছুই ভালো লাগে না।
দীপুর মা’র সুন্দর কণ্ঠ। সুর দিয়ে গীতা পাঠ করেন। একতারা বাজিয়ে গান করেন। ঠান্ডা গান তার পছন্দ। যে সব গানে বেশি বাদ্যযন্ত্র , বেশি চিৎকার চেচামেচি সে সব গান তার ভালো লাগে না। গান নিয়ে কোনো দিন বাইরে নামেননি তিনি। ঘরে বসে গান করেন। নিজের জন্য , স্বামীর জন্য , সন্তানের জন্য। বিদ্যুৎ চলে গেলে পাশের কক্ষে মোম জ্বেলে গান করেন তিনি। পরিবেশটাই পরিবর্তন হয়ে যায়। একতারাটা তার ভীষণ প্রিয়। ওটা ছাড়া তিনি গান গাইতে পারেন না। বহু পুরণো একতারা। তার পরিবারের বহু ঘটনার সাক্ষী। পরিষ্কার করতে গিয়ে আজকে তারটা ছিঁড়ে গিয়েছে তার নিজের হাতেই। সেই থেকেই তার মন খারাপ।
দীপু গিয়েছিল তিন্নির বিয়ের অনুষ্ঠানে। তিন্নি ওর অনার্স-মাস্টার্সের ক্লাসমেট। খুব ভালো মেয়ে। শালীনভাবে চলাফেরা করে , কখনো কারো সাথে রাগ করে না , ক্লাসমেটদের মধ্যে কোনো মনোমালিন্য হলে মধ্যস্থতা করে মিটিয়ে দেয়। সবাই ওকে পছন্দ করে। ফাইনাল পরীক্ষার পরেও দীপুর সাথে তিন্নির যোগাযোগটা নিয়মিত ছিল। কারণ তাদের বাসা একই শহরে। বিসিএসের জন্য এক সাথেই পড়াশোনা করত। শিক্ষা ক্যাডারে দুজনের চাকরি এক সঙ্গেই হয়েছে। একই শহরে নিয়োগ হয়েছে তবে ভিন্ন কলেজে। সেটা কোনো সমস্যা নয়। যে কলেজেই পদ খালি হবে অন্যজন সেখানে বদলী হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ওদের একটা বন্ধু-বলয় ছিল। পরীক্ষার পরে সবাই আলাদা হয়ে গিয়েছে। ফোনে মাঝে-মধ্যে কথা হয় কিন্তু ওদের দুজনের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। পরীক্ষার পরে ওদের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছে। কারণ আর তো কেউ নেই। দুজনে মিলেই বিসিএসের জন্য পড়তে হবে। দুজন পরস্পরের সুখ-দুঃখের সঙ্গী। এমন কোনো সমস্যা নেই যা তারা একে অন্যের সাথে আলোচনা করে না। বন্ধু মানেই তো তাই যাকে সব কথা বলা যায় নিদির্¦ধায়। তিন্নি দীপুর সব চেয়ে প্রিয় বন্ধু ; একমাত্র বন্ধুও বলা যায়। কারণ দীপু বেশি মানুষের সাথে মিশতে পছন্দ করে না।
তিন্নির মুখটা দীপুর বার বার মনে পড়ছে। এত সুন্দর মেয়েটা, কেমন ভূতের মতো লাগছিল। সারা জীবন দেখে এসেছে বিয়ের সাজে মেয়েরা অপরূপা হয়ে ওঠে অথচ তিন্নিকে মনে হচ্ছিল একটা ভূতের মুখোশ পরে বসে আছে। সবাই বলছিল চমৎকার লাগছে তিন্নিকে অথচ ওর ইচ্ছে করছিল মুখোশটা খুলে ফেলতে। আজকে কারো সাথেই ওর মনের মিল হল না। হয়ত বিয়ের অনুষ্ঠানের সবার চোখে ছানি পড়েছে। বর-কনে দুজনকেই তাদের কাছে ভালো লেগেছে। ও তিন্নিকে সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসে তাই ওর মনে হয়েছে বরটা সুন্দর হয়নি। তিন্নির পাশে মানাবে না। চেহারা, শারীরিক গঠন, ব্যক্তিত্ব কোনো কিছুই ভালো লাগেনি ওর কাছে। বড় একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল , না , বিয়েটা ভালো হল না।
কাত হয়ে শুইল দীপু। একটা বালিশ নিল বুকের মধ্যে। বুকটা কেমন যেন খালি খালি লাগছে অথচ ও কোনো দিন বালিশ জড়িয়ে শোয় না। তিন্নির বিয়ে হয়ে গেল। এখন থেকে ও স্বামীর ঘরেই থাকবে। ওর স্বামী একটা কক্ষ ভাড়া নিয়ে থাকত। বিয়ে ঠিক হওয়ার পরে বড় বাসা নিয়েছে। সেও কলেজের শিক্ষক। জীবনে এই শহর ছেড়ে যেতে হবে না। এক কলেজ থেকে অন্য কলেজে যাবে। তার মানে কী ? তিন্নির বাসায় আর কোনো দিন যাওয়া হবে না ? কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে হাঁটার সময় দীপু এক দিন তিন্নিকে জিজ্ঞেস করেছিল , বিয়ে হয়ে গেলে তোমার বাসায় কি আমি যাব ?
: হিম।
: তোমার স্বামী যদি পছন্দ না করে ?
: তাহলে আর যাবে না।
: আচ্ছা।
সেদিন বিষয়টা সহজভাবেই নিয়েছিল দীপু কিন্তু আজকে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। যে কোনো সময় ইচ্ছে করলেই তিন্নির বাসায় যাওয়া যাবে না। তিন্নি আর ছুটে আসবে না তাদের বাসায়। কী নিষ্ঠুর পরিস্থিতি ! ভেতর থেকে কেউ একজন তাকে প্রবোধ দিল , কে বলেছে তোমাকে এ রকম পরিস্থিতি হবে ?
: বলতে হবে কেন ? আমি বুঝি না ? আমি ওর বরের মুখ দেখেই বুঝেছি সে সহজ মানুষ নয়।
: ধর , সে সহজ মানুষ। তার বাসায় সে তোমাকে সহজভাবেই নিল কিনÍু তুমি যখন বিয়ে করবে ? তোমার বউ কি এটা সহজভাবে নেবে ?
: নিতেই হবে। আমার বউ আমার কথার বাইরে যেতে পারবে না।
: সেটাকে সহজভাবে নেওয়া বলে না। তুমি ভাবছিলে সহজভাবে নেওয়ার কথা।
: তার মানে কী ? তিন্নিকে আমি চির দিনের জন্য হারিয়ে ফেললাম ?
: আমার তো সেটাই মনে হচ্ছে।
দীপু দুহাতে চুল টানতে লাগল। সোজা হয়ে শুইল। আমি ওকে এতটা ভালো কেন বাসতে গেলাম ? ওর জন্য আমার এত কষ্ট কেন হচ্ছে ?
বিকেল হয়ে গেল। চার দিকে আজান হচ্ছে। তিন্নি এখন কী করছে ? ও তো কখনো নামাজ বাদ দেয় না। একটা নতুন জায়গায় গিয়ে ও কিভাবে কী করবে ? না , ও একটা বেকায়দায়ই পড়ে গেল।
তিন্নি ফোন করল। দীপু আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। তিন্নি ওকে বলেছে যে ও যেন বউভাতে অবশ্যই যায়। তিন্নি এটাও বলে দিল যে ওর ভাইয়া দীপুকে ফোন করবে। দীপুর এখন ভালো লাগছে। কারণ ওর ভাইয়া ফোন করবে। সৌজন্য রক্ষার জন্য হলেও তাকে যেতে হবে। তার নিজেরই যে যেতে ইচ্ছে করছে এটা কাউকে বলা যাবে না।
দীপুর কক্ষে ওর বাবা এলেন। বললেন , ঘুমোসনি ?
দীপু উঠে বসল। তিনি চেয়ারে বসলেন। বললেন , তোর মা’র মন খারাপ।
: কেন ?
: একতারা পরিষ্কার করতে গিয়ে তার ছিঁড়ে গিয়েছে। আমি বলেছি , দীপু এলে সারানোর জন্য নিয়ে যাবে অথবা লোক ডেকে এনে ঠিক করে দেবে কিন্তু তার মন কিছুতেই ঠিক হচ্ছে না। তুই একটু তোর মা’র সাথে কথা বল। নিয়ে যাবি নাকি লোক নিয়ে আসবি জিজ্ঞেস কর।
: তুমি যাও , আমি আসছি।
: একটা তার ছিঁড়ে গিয়েছে তাতে এত মন খারাপ করার কী আছে ? বলেই তিনি উঠে গেলেন। দীপু মনে মনে বলল , একতারার একটা তার ছিঁড়ে গেলে আর ক’টা তার থাকে , বাবা ?
রচনা- ৩০.৯.১১
প্রকাশ- ৭.১০.১১
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০১৪ রাত ৯:২০