মমতা
নাসরিন সুলতানা
রহমত বাড়ি যাবে তাই সকাল থেকেই কাঁদতে শুরু করল মৌমি। রহমতের পেছনে পেছনে হাঁটছে আর চোখের পানি ফেলছে। মা-বাবার অগোচরে বলল, তুমি গেলে আমাকে অনেক মারবে।
রহমত তাকে বুঝিয়ে বলল, তুমি ঠিকমতো খেয়ো তাহলে আর মারবে না।
মৌমি বলল, ওদের হাতে আমার খেতে ইচ্ছে করে না। ওরা তো গল্প বলে না। গল্প না বললে তো আমি খেতে পারি না। তখনই তো আমাকে মারবে।
রহমত যখনই বাড়িতে যায় মৌমি খুব কান্নাকাটি করে তবুও রহমত যায়। রহমতের জন্য মৌমির মন সব সময় খারাপ থাকে। কিছুই ভালো লাগে না তার। মন খারাপ থাকলে কি খেতে ইচ্ছে করে? তখন মার খাওয়াটা তার জন্য আবশ্যিক হয়ে যায়। কাজলের ছুটি না থাকলে কখনোই বাড়িতে যায় না রহমত। কাজল ইচ্ছে করলে মৌমিকে আদর দিতে পারে কিন্তু কিভাবে দেবে? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তো এখন আর কোনো পর্যায়ে নেই। আলাদা হওয়ার জন্য দুজনই প্রস্তুত। দুজনের একই কথা, মেয়েটা না হলে অনেক আগেই এ সংসার ভেঙে দিতাম। বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে করতে স্বামী-স্ত্রী দুজনের মেজাজই খিটখিটে হয়ে গিয়েছে। ছকে বন্দি জীবন। সকালে বের হয়ে যায়, রাতে ফেরে। পরিশ্রম আর নানা রকম ঝামেলায় তেতো হয়ে গিয়েছে সব আশা-ভরষা। বাসায় ফেরার পরে কিছুই ভালো লাগে না। কারো কথাই শুনতে ইচ্ছে করে না। এমন কি পাঁচ বছরের মেয়েটাকেও কাছে নিতে ইচ্ছে করে না। মেয়েটাও মা-বাবার কাছে যায় না। খুব ভয় পায়। রহমত তাকে মা-বাবার কাছে যেতে বলে কিন্তু সে বলে, না। গেলেই মারবে। রহমতের তখন ভীষণ মায়া লাগে। জন্মের পর থেকে রহমতই এই মেয়েটাকে লালন-পালন করেছে। তার কখন কী লাগবে তা রহমত বলবে তারপরে তারা আনবে। রহমত নিজের সন্তানের মতোই স্নেহ করে এই মেয়েটাকে। তার নিজেরও একটা মেয়ে আছে। তার বয়স চার বছর। এই মেয়েটার মধ্যে সে তার নিজের মেয়েকেই খোঁজে। এই মেয়েটার জামা-কাপড় নিয়ে নিজের মেয়েকে পরায়। তার জন্য কিনতে হয় না। বাড়ি যাওয়ার সময় কাজল বলে, মৌমির যে সব কাপড়-চোপড় ছোট হয়ে গিয়েছে সেগুলো তুমি নিয়ে যাও। রহমত মনে মনে হাসে, কাপড়-চোপড় ছোট হয়ে যায়নি ; মৌমি বড় হয়ে গিয়েছে। রহমত যে ক'দিন বাড়িতে থাকে মৌমির জামা পরা অবস্থায় নিজের মেয়েকে মৌমির মতোই মনে হয়। মৌমির ভালো ভালো ড্রেস কাজল দিয়ে দেয়। রহমতের মেয়েটাও খুব সুন্দর। দেখলে কেউ বুঝবে না সে গরীব ঘরের বাচ্চা। নিজের মেয়ের মধ্যে মৌমিকে খুঁজে পায় বলেই ঐ জামা-কাপড়গুলো নিতে তার ভালো লাগে।
মৌমি কান্নাকাটি শুরু করল, সে রহমতের সাথে যাবে। কাজল আর পলাশ রাজি হচ্ছিল না। এক সময় কাজল রাজি হল এই ভেবে যে ওখানে মৌমি রহমতের কাছেই থাকবে তাছাড়া রহমতের স্ত্রীও ভালো। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে, বাচ্চার যত্ন বোঝে, শুদ্ধ করে কথা বলে। কাজল পলাশকে বলল। সেও রাজি হয়ে গেল।
মৌমি খুব খুশি। এত খুশি সে জীবনে কোনো দিন হয়নি। রহমতও খুশি। মৌমির আনন্দই তার আনন্দ। দুজনের মনের অবস্থা অভিন্ন। হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে দূরে কোথাও যেন কেউ কোনো দিন তাদেরকে খুঁজে না পায়। এই বাচ্চাটাকে যখন তার মা-বাবা মারে তখনই রহমত পরিকল্পনা করে ওকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার কিন্তু সাহস পায় না। বাচ্চাটা যদি রাজি না হয় তাহলে মহা বিপদে পড়ে যাবে সে। রহমত রেল স্টেশন থেকে কয়েক রকমের খেলনা কিনে দিল মৌমিকে। নতুন খেলনা পেয়ে মৌমি খুব খুশি।
রহমতের বাড়িতে গিয়ে মৌমির আনন্দের আর সীমা রইল না। ওখানে সে পেয়েছে ছোট একটা বোন আর একজন মায়ের স্নেহ যে দুটো জিনিস সে কোনো দিন পায়নি। রহমতের স্ত্রীকে সে মা ডাকতে শুরু করল। রহমতের মেয়ে তিথি একবার বলেছিল, আমার মা। মৌমি তার দুগালে হাত বুলিয়ে বলল, আমারও মা, আমি তোমার বোন। একবার শুনেই তিথি মেনে নিয়েছিল। তারও ভীষণ পছন্দ হয়েছিল পরীর মতো এই বোনটাকে। ঢাকায় ফেরার সময় মৌমি কিছুতেই রাজি হল না এই বাড়ি ছেড়ে যেতে। সে রহমতকে বলল, তুমি কিছু দিন পরে এসে আমাকে নিয়ে যেও। রহমত এবং তার স্ত্রী ওকে অনেক বুঝিয়েছে কিন্তু কাজ হয়নি। দুজনেরই খুব মায়া লাগছিল মেয়েটার জন্য। রহমত বলল, তোমার মা-বাবাকে বলে তোমাকে আমি অনেক দিনের জন্য নিয়ে আসব।
ঢাকায় ফেরার দুমাস পরে মৌমি হারিয়ে গেল। তাদের বাড়ির ভেতরে মা-মেয়ে হাঁটছিল। অন্য ফ্ল্যাটের এক ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলা শেষে মৌমিকে আর পাওয়া গেল না। পলাশ-কাজল দুজনই পাগলের মতো হয়ে গেল। সাধ্যমতো খুঁজতে লাগল। রহমত তো অবাক, দুজনের কেউই বলল না যে ভালোই হল, এখন আলাদা হয়ে যাওয়া যাবে বরং তাদের মধ্যে একটা আত্মরিকতা সৃষ্টি হল, একজন না খেয়ে শুয়ে থাকলে অন্যজন মুখে তুলে খাইয়ে দিতে লাগল।
বেশ কিছু দিন ছুটি কাটানোর পরে তারা জয়েন করতে বাধ্য হল। কাজের চাপে তারা মৌমির জন্য কান্নাকাটি করার তেমন একটা সময় পাচ্ছিল না। রহমতের কাছে বিষয়টা ভালো লাগছিল না কিন্তু তাদেরকে কিছু বলতেও সাহস পাচ্ছিল না। এভাবে কিছুদিন চলল।
কেয়ারটেকার একদিন রফিকের বাসায় একটা চিঠি পৌঁছে দিল। কাজলের উদ্দেশে সেই চিঠিতে লেখা হয়েছে, আপনার খুব অহংকার, না ? আপনার বাহ্যিক সৌন্দর্য আর কাজের যোগ্যতা দিয়ে আপনি সবাইকে জয় করে ফেলেছেন। ফলে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে আপনার অফিসের অন্য মেয়েরা। আপনি কি জানেন, আপনার মেয়েটা কেন কেড়ে নেওয়া হয়েছে ? আপনি যাতে চাকরিটা ছেড়ে দেন। কর্মক্ষেত্রে মুহুর্মুহু প্রশংসা পেয়ে আপনি সংসার জীবনকে তুচ্ছ ভাবছেন। আপনি ভুলেই গিয়েছেন আপনার স্বামী বা সন্তান আপনার কাছে কী চায়। আপনার অফিসের অন্য সব মেয়ে তাদের সংসারকে সময় দেয় তার পরে অফিসের কথা ভাবে আর আপনি অফিস ছাড়া কিছুই বোঝেন না। আপনি যদি কালকেই চাকরিটা ছেড়ে দেন তাহলে আমরা আপনাকে জানাব মৌমিকে আপনি কোথায় পাবেন।
চিঠিটা পড়ে কাজল চিৎকার করে কাঁদল যেন বছরের পর বছর সে ঘুমিয়ে ছিল, কেউ একজন তাকে সজাগ করে বলল, তোমার সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে। নিজের ভুলের জন্য সে স্বামী-সন্তান-সংসার সবকিছুকে তুচ্ছ ভেবেছিল।
সত্যিই কাজল চাকরিটা ছেড়ে দিল। তার কাছে ফোন এলো, টাকা-পয়সা কিচ্ছু লাগবে না। মৌমিকে এসে নিয়ে যান। কাজল ঠিকানাটা লিখে নিল। পলাশকে নিয়ে চলে গেল মৌমিকে আনতে। কিছু পুলিশও রেখে দিল পাহারায়। রহমত তাদেরকে বিদায় দিয়ে রাস্তায় পায়চারি করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে একটা ফোন করল। তারও কিছুটা সময় পরে মৌমি এলো। রহমত তাকে কোলে নেওয়ার সাথে সাথে সে কেঁদে ফেলল। বলল, সত্যিই কি ওরা আমাকে আদর করবে? আমার সাথে গল্প করবে?
: করবে, মা, করবে। তুমি এতদিন কোথায় ছিলে তা যেন বলো না। তাহলে তোমাকে মারবে।
: মারুক। তুমিতো মার খাওয়ানোর জন্যই আমাকে দিয়ে দিচ্ছ।
: তোমাকে শুধু মারবে আর আমাকে একেবারে মেরেই ফেলবে।
: আমি বলব না, কাকা। আমি কোনো দিন বলব না। তাহলে তো তুমি আর আমাকে নেবে না।
: হিঁম।
: আচ্ছা, কাকা, ওরা যদি আমাকে আদর না করে তাহলে যে তুমি আমাকে নেবে আর কিন্তু ফিরিয়ে দেবে না, মনে থাকবে?
: থাকবে, মা, থাকবে।
রহমত মৌমিকে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরল আর চোখের পানি ছেড়ে দিল বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো।