গ্রামের ছেলেরা এখন আর ঘুড়ি উড়ায় না আকাশে। কেননা, আমাদের সব ঘুড়ি; সব আকাশ এখন আটকে যায় গ্রামীন ফোনের টাওয়ারে। লাল ইট বানানোর মিলে। কোথাও আর শোনা যায় না ভাটিয়ালির নতুন সুর। নতুন কোনো গান। এখন কেবল পদ্মার জলে ভাসে অভুক্ত মরে যাওয়া জেলে-শিশুর লাশ। সবুজ ধানক্ষেত উজার করে রাক্ষুসে বণিকেরা আমাদের গ্রামজুড়ে বানাচ্ছে ইট বানানোর মিল। চাক চাক করে কেটে ফেলছে আমাদের উঠান। ঘাসে ঢাকা মাঠ। দানবের মতো মিলগুলো ঢেকে দিচ্ছে মায়াবী আকাশ। কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী মলিন করে ফেলছে মেঘ আর আকাশের সব সৌন্দর্য। দম নিতে গেলে নিশ্বাসে ঢোকে কালো আবর্জনা। শিশুদের চোখে জ্বালা ধরানো এই ধোঁয়া বদলে ফেলছে ঋতু বদলের সব সমীকরন।
একসময় গ্রামের কোল জুড়ে ছিল ভরাট বুকের নদী। কুমারেরা যাদুকরের মতো আঙুলের স্পর্শে বানাতো মাটির হাড়ি-পাতিল ; ছোট্ট-পুতুল। যেন ওদের হাতে ছিল রবীন্দ্রনাথের পেনসিল, যা দিয়ে ওরা আঁকত মাটির কবিতা। লাল হলুদ সবুজ। আর এখন শরীফ মেলামাইন, তাজ প্লাস্টিকের আগ্রাসনে হারিয়ে যাচ্ছে মাটির কারিগরেরা। শিশুরা এখন আর নুতন মাটির পুতুলের স্বপ্নে বিভোর থাকে না । আমরা; আমাদের পাস্টিক সভ্যতা ওদের হাতে তুলে দিয়েছি খেলনা পিস্তল, ছুরি, তলোয়ার, প্লাস্টিকের সাপ।
একদিন আমাদের নদী জুড়ে ভেসে বেড়াত চমৎকার সব নৌকা। মাঝিরা ভাটিয়ালি গাইতে গাইতে এপার ওপার করতো কতো-শতো মুখ ! জেলেরা মনভরে মাছ ধরতো। ভরপেট খেত তিনবেলা। হাট থেকে সন্তানের জন্য কিনত লাল জামা, নিজের নতুন জাল। অথচ এখন পদ্মার পাড় জুড়ে যান্ত্রিক ট্রলারের ভটভটানি। প্রযুক্তির গতির কাছে হেরে যাওয়া জেলেরা মরে যাচ্ছে দিন দিন। হারিয়ে যাচ্ছে নৌকার সৌন্দর্য। মাটির কবিতার শৈল্পিক শুভ্রতা।
এমনিকরে হারিয়ে যায় জেলে পাড়া। মাঝি পাড়া। কুমার পাড়া। তাঁতী পাড়া। গ্রাম জুড়ে নির্মিত হয় শহুরে ঢঙের ইটকাঠের চারদেয়াল। কৃষকের ধানক্ষেত বন্দি হয় দেয়ালে। তাঁতীর কল জেলের জাল যায় যাদুঘরে যাদুঘরে। ছবির শিল্পীরা কৃষকের কঙ্কালসার ছবি তুলে বিখ্যাত হন। মরে যাওয়া গ্রাম নিয়ে কাব্য করে দেশ-বিদেশ ঘোরেন বুদ্ধিজীবী। আর আমাদের শাইখ সিরাজেরা কৃষককে নিয়ে ওয়াটার পলো খেলেন। বানরের মতো তেল মাখানো কলাগাছে চড়ান। বানর আর কৃষক একাকার হয়ে যায়। আমাদের গ্রাম হয়ে ওঠে বানরের গ্রাম; চমৎকার রূপকথা।