মেয়েটির যা করলো, তাতে বড়োসরো এক ধাক্কা খেলো বসতির বাসিন্দারা । সাহেব লোকজনের এতে কিছু যায় আসে না। তাদের অনেক জরুরী ভাবনা চিন্তা রয়েছে। কিন্তু বস্তিবাসীদের মাঝে বেশ আলোড়ন তুললো ঘটনাটি। ওদের প্রতিদিনের “নুন আনতে পান্তা ফুরোনো” দিনপন্জীতে আলাদা বিষয় নিয়ে ভাবনার পরিধি নেই বললেই চলে। সময়ের প্রবাহ প্রতিদিন তো একই ঢেউএর দোল। মাঝে মাঝে একটা দু’টো ঘটনা সুনামীর মতো পাহাড় সমান ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ে প্রতিদিনের গাঁথুনীতে। তখন আলোড়নে উত্তাল হয় বস্তিবাসী। নিদেনপক্ষে নিজেদের দৈনন্দিন টানাপোড়নের বাইরে কিছু ভাবার সুয়োগ তো হলো!
খুব সাধারণ একটি মেয়ে। বাবা তিন বছর “চাউল কিনতে গেলাম” বলে সেই যে বেরিয়ে গেলো, আজও ফেরেনি। মা পরের বাড়ীতে গতর খেটে খেটে নয় বছরের ছেলে আর বারো বছরের মেয়েকে নিয়ে এখনও আশায় আশায় দিন রাত পার করে। রাতে একা একা শাপ শাপান্ত করে, কখনও নিজের ভাগ্যকে, কখনো উধাও সোয়ামীকে। সেসময় ছেলেমেয়েরা বাড়তি কিছু চাইলে দু’চার ঘা এদের গায়েও পড়ে। ওদের কান্না বস্তির আরো কিছু ওদের মতোই দিনমজুরের ছেলেমেয়েদের কান্নার আড়ালে চাপা পড়ে যায়।
এবারের শীতও যেন সুনামী হয়ে এসেছিল। বস্তির যে ঘরটিতে এদের বাস, সেখানে হু হু করে শীত ঢোকে কেউটে সাপের মতো হিসহিসিয়ে। তেল চিটচিটে ছেড়া কাথায় যতোটা ওম ধরে রাখা যায়, তা সহজেই বরফের আচড় দিয়ে শরীর থেকে পিছলে বেরিয়ে যায়। ভিক্ষের সময়ে কোন এক সাহেব মেয়েটিকে একটি আধছেড়া সোয়েটার দিয়েছিল। নিজের গায়ে না পড়ে ভাইকে নিজেই প্রতিদিন ঢেকেঢুকে রাখে বোন। ছেলের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট মমতায় মা সেটা স্বাভাবিক হিসেবেই ধরে নিয়েছে।
এমনি এক শীতের সকালে মা গেল গতর খাটতে। ভাইকে হাতে ধরে বোনও বেরুলো একটুকরো রোদের ওম ও কারো দয়া দাক্ষিন্যে সামান্য ছিটেফোটা খাবারের আশায়। কখনো সখনো পুন্যের আশাতেও দান খয়রাত করে বসে কেউ। রেললাইন ধরে কিছুক্ষন এগুলেই একটা বড়মানুষের বসতি চোখে পড়ে। মাঝে মাঝে সকালের নাস্তা থেকে বেঁচে যাওয়া এক আধ ঠুকরো রুটি কপালে জুটলে দুজনের ক্লিষ্ট চেহারায় আনন্দের বান ছোটে। মাঝে মাঝে সে রুটিতে আঠার মতো লেগে থাকে চিটেগুড়। ওদের আত্মার ভেতরের ডায়েরীতে সে দিনগুলো শীতের সোনালী রোদের হীরককলমে আঁকা হয়ে থাকে। সে দিনটিও ওদের জন্যে তেমনি আঁকা হয়ে গেল। আজ চিটেগুড়ের বদলে এক টুকরো বাসী মিষ্টি। খাওয়া শেষ হবার পরও হাতের চোটো চাটতে চাটতে সামনের দিকে এগুলো ওরা।
ওদের চোখের তারাতেও সকালের সোনালী রোদের ঝলমলে আনন্দ। চলতে চলতেই বোন হঠাৎই এক উচ্ছসিত শিশুতে পরিণত হলো। ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলল,
- চল, আইজগা লুকান্তি খেলি।
এই খেলা ওরা অনেকবারই খেলেছে। বস্তির শিশুরা এই খেলাটিই খেলতে পারে সহজে। কোন সরন্জামের বালাই নেই। ভাই খুব খুশী।
- হ, বইন। তয় আমি আগে লুকামু!
অনেক সময়ই এ নিয়ে ছোট ঝাগড়া বাঁধে দু’জনের। কিছুটা কৃত্রিম মান অভিমান। প্রতিবারই সামান্য দেরীতে হলেও ছাড় দেয় বোন। আজ সেরকম দেরীও হলোনা। হাতে চোখ ঢেকে বোন পেছন ফিরলেই সমান্য এগিয়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়লো ভাই। তারপর কুউ…..।
এমনি ভাবেই চললো এদের খেলা। পৃথিবীর অন্যান্য সুখী শিশুদের সাথে ওদের কোন পার্থক্য রইল না তখন। খেলাই হয়তো একমাত্র, যা ধনী গরীব নির্বশেষে পৃথিবীর সমস্ত শিশুকে সুখী করে দেয়। এটা যদি ঈশ্বর জানতেন, তাহলে এত ইবাদত বন্দেগী না দিয়ে খেলায় খেলায় ভরে দিতেন পৃথিবী।
বাজারের সামান্য আছে নতুন ক’ঘর মানুষের বাস। একটা দুটো করে ধীরে ধীরে নতুন বাড়ীঘর গড়ে উঠছে। কোন কোন জায়গায় থরে থরে ইট সাজানো। তারই আশেপাশে বালির টিবি। সেখানে আসার পর লুকোনোর পালা বোনের। একটু পরেই শোনা গেল তার গলা। কুউ…।
ভাই হালকা পায়ে ছুটলো। ডানদিকে ইটের স্তরের আড়ালে খুঁজলো বোনকে। না পেয়ে পাশের বালির টিবির আড়ালে। সেখানেই নেই বোন। ছুটে গেল ডানদিকে। সেখানেও নেই। আরেকটু দুরে এক আধভাঙ্গা দেয়ালের আড়ালে। নেই! একটি শেওড়া গাছে কিছুটা দুরে। সেখানেও নেই। চারিদিকে হন্যে হয়ে বোনকে খুঁজে বেড়ালো ভাই। সুর্য তখন অনেকটাই মাথার উপর উঠে এসেছে। খোঁজার ক্লান্তি, ঘাম আর চোখের জল মিলেমিশে একাকার। তখন অনেকটা দুর থেকে স্পষ্ট হলো একটি চেহারা। কোন এক অবসন্ন ক্লান্তিকে ছোট্ট শরীরে বহন করে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে কাছে। কাঁদতে কাঁদতে সেদিকে দৌড়ে গেল ভাই। ছোট্ট হাতে বোনকে জড়িয়ে ধরলো আদরে।
জড়িয়ে ধরেই চমকে উঠল ভাই। থরথরিয়ে কাঁপছে শরীর। বোনকে শীতে অনেকবারই কাঁপতে দেখেছে ভাই। কিন্তু এ কাঁপুনি সে কাঁপুনির চেনে আলাদা, নয় বছর বয়েসেও টের পেলো সে। হাজার বছরের শীত যেন একসাথে জমা হয়েছে শরীরে। চোখে শুকানো অশ্রুর নোনা দাগ আর বরফের মতো রক্তশুন্য সাদা চেহারা। বরফের চেয়েও যেন শীতল শরীর। অনেক প্রশ্ন করেও কোন উত্তর পেলো না ভাই। নিজের গা থেকে সোয়েটার খুলে পড়িয়ে দিল বোনকে। তারপর কাঁপতে কাঁপতে সীমাহীন পথ পেরিয়ে ফিরে বাড়ীতে।
সারাদিন না খেয়েই কাটিয়ে দিল দু’জন। এভাবে এরা অনেকবারই কাটিয়েছে। কিন্তু এবারের কাটানো আলাদা। মা নিজের ভাগ্যকে অভিসম্পাত করতে করতে শাকভাত রান্না করে গিয়েছিল মাটির হাড়িতে। সে খাবার হাড়িতেই পরে রইল। বোনকে পাশে শুইয়ে কাথায় ঢেকে ভাই বসে রইল পাশে। কিন্তু ক্ষুধা আর ভয়ে নিজেই জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে একসময় নিজেও এলিয়ে পড়লো বিছানায়।
সারাদিনের গ্লানি আর ক্লান্তি নিয়ে মা ফিরে এলো সন্ধ্যাবেলায়। মেয়ের পাশে ছেলেকে জ্বরে কাঁপতে দেখে বিগড়ে গেল মেজাজ আরো বেশী।
- হারামজাদী, ভাইডা জ্বরে কাঁপতাছে, খবর নাই মাগী!
মেয়ে কোন জবাব না দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসল। তার চেহারার ক্লান্তি আর কালিমা সন্ধ্যার আধো অন্ধকার আর নিজের বিবশ শরীর ছাপিয়ে চোখে পড়ল না মায়ের। চাটাশ করে একটা চড় বসিয়ে দিল গালে।
- এই মাগী, তুই সুইটার পড়ছস ক্যান। ভাইটা মরতাছে, আর তুই এইডা গতরে দিয়া আরাম করস। খানকী মাগী..!
বলেই মেয়ের চুল টেনে ধরলো। কিন্তু পুরো শক্তিতে টেনেও মেয়েকে জায়গা থেকে সরাতে পারলো না মা। একসময় হাল ছেড়ে দিতেই আস্তে করে থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল মেয়ে। তারপর মোয়েটারটি খুলে পরম মমতায় ঘুমন্ত ভাইয়ের শরীরটা ঢেকে দিল। তারপর নিজে শুয়ে পড়লো আগের মতোই পাশে।
পরের দিন বস্তির পাশের একটি আমগাছে লাশ ঝুললো মেয়েটির। সেদিন রোদকে অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশী সময় ধরে আটকে রাখল কুয়াশা।
একটু পরই পুলিশ এলো। কোন ঘটনায় এদেরকে ডাকলে ওরা কখনো আসে না বস্তিতে। কিন্তু যে কোন অপমৃত্যুতে ওরা সবসময়েই হাজির। মেয়েকে নিয়ে গেল ময়না তদন্তের জন্যে মর্গে। মেয়েটির শরীরে রক্তাক্ত চিহ্নগুলো দেখে ডোম ছুরি বসানোর আগেই বোঝা গেল সেদিন কয়েকবারই ধর্ষন করা হয়েছিল ওকে।
বস্তিপাড়ায় আলোচনার ঝড়। অনেক ঘটনা ঘটে, যা বস্তিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে দেয়। এবার ভাগ হলো দু’টো। একভাগ বলে, ধর্ষনের গ্লানিতেই আত্মহত্যা করেছে মেয়েটি। অন্য ভাগ বলে, মায়ের দেয়া অপমান সহ্য না করতে জীবন দিয়েছে সে। আরো অনেক কারণই থাকতে পারে। সাহেব পাড়াতে গোয়েন্দা পুলিশ এসবের কারন খুজে বের করার চেষ্টা করে। বস্তি এলাকায় ঘটনা নিয়ে কেউ বেশীদিন ভাবে কি?