আমাদের জীবনে অণুজীবের ভূমিকা কি? মানে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এইসব আর কি। প্রশ্নটা শুনে অনেকেই হয়তো ভুরু কুঁচকে অবজ্ঞাভরে বলবেন “ জীবন কোথায় , মরনেই তো এদের আসল ভূমিকা ! ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস না থাকলে এতো রোগ ব্যাধিও থাকতো না , এতো শয়ে শয়ে মানুষ কষ্টও পেতনা ।“ খুবই খাঁটি কথা । কিন্তু সাধারন পাঠকদের বলছি সত্যি সত্যি এই পৃথিবীতে ব্যাকটেরিয়া না থাকলে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি হতো তা বর্ণনাতীত ! শুধু এইটুকু বলতে পারি, কোটি কোটি অণুজীব আমাদের জীবনকে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখতে যে কাজ করে যাচ্ছে , সেখানে ঐসব রোগ বাঁধানো দুষ্ট অণুজীবের পরিমান খুবই নগণ্য । তাই বলি, এদেরকে হেলাফেলা করবেন না । আর সবাইকে এক দৃষ্টিতে দেখাটাও বোধহয় ভুল হবে । যাই হোক ব্যাকটেরিয়ার এইসব সমাজসেবা (!) মূলক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে কিছু তথ্য শেয়ার করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা । আমার এই প্রচেষ্টাকে অণুজীবদের পক্ষে একজন এজেন্ট হিসাবে বিজ্ঞাপনদাতা ভাবলেও ভুল করবেন না । আমার ক্লায়েন্ট অর্থাৎ অণুজীবদের বিজ্ঞাপনের স্বার্থে কিছু দেশি-বিদেশি বই পত্র, জার্নাল এবং ইন্টারনেট মামার (!) সহযোগিতায় গ্রহন করেছি ।
প্রথমে আমি Geobacter নামে অসাধারন এক ব্যাকটেরিয়ার কথা বলব। এটি একটি Proteobacteria, বৈজ্ঞানিক নাম ,Geobacter metallicreducens । সেই ১৯৮৭ সালে Dr. Derek Lovely এদেরকে খুঁজে পান Washington D.C. এর Potomac নদীর তলদেশের কাদামাটির ভেতরে। তখন থেকেই এই অণুজীব ব্যবহার হয়ে আসছে পেট্রোলিয়াম বিশুদ্ধিকরন আর মাটি চাপা দেয়া আবর্জনায় দূষিত ভূগর্ভস্থ পানিকে দূষণমুক্ত করার কাজে। এমনকি আমেরিকার বিভিন্ন পারমানমানবিক শক্তি গবেষণাস্থলে ভূগর্ভস্থ পানিকে ইউরেনিয়ামমুক্ত করার কাজেও এদের ব্যবহার করা হয় দেদারেসে।এভাবেই চলে আসছিল, আবর্জনা পরিষ্কার করার কাজে এতদিন প্রাণান্ত খেটে গলদঘর্ম হচ্ছিলো আমাদের Geobacter।
এমন করেই হয়ত চলত তার জীবন যদি না Massachusetts Amherst বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন গবেষক খুঁজে বের করতেন তার এক বিস্ময়কর ক্ষমতা। এখন তো ভাবেসাবে মনে হচ্ছে Geobacter শুধু ঝাড়ুদার নয়, সে পৃথিবীকে আমূলে বদলে দেবার ক্ষমতাও লালন করেছে এতদিন গোপনে। ব্যাপারটা এরকম । এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন গবেষক (যাদের নেতৃত্বে আছেন স্বয়ং Dr. Derek Lovely) সম্প্রতি এই ব্যাকটেরিয়ার শরীরে ছোট্ট একধরনের অঙ্গাণুর মধ্যে বিশেষ এক বৈশিষ্ট্য খুঁজে পান। সেটা হল- এই অঙ্গাণুর আছে অতিমাত্রায় বিদ্যুৎ পরিবহনের ক্ষমতা। খুব সম্ভবতঃ এই আবিস্কারের মধ্যেই লুকিয়ে আছে Geobacter এর আবর্জনা সাফ করার ক্ষমতার রহস্য। শুধু তাই নয়, সবচে’ অবাক করার ব্যাপার এই জ এই অঙ্গাণুগুলো নাকি ইদানিংকালে সাড়া জাগানো ন্যানোপ্রযুক্তির (Nanotechnology) বিভিন্ন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ইলেকট্রিক্যাল সার্কিট তৈরির কাজেও ব্যবহার করা যাবে। প্রসঙ্গত ন্যানোপ্রযুক্তি হল সেই প্রযুক্তি, জার মাধ্যমে অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং আধুনিক জন্ত্রগুলকে খুব...খুব ছোটো করে তৈরি করা সম্ভব। চিন্তা করুন না, ওপেন হার্ট সার্জারির ঝক্কি সেরে ফেলছে রক্ত স্রোতে ঘুরে বেড়ানো একদল ন্যানোরোবট, কিংবা আপনার অতি প্রিয় মোবাইল সেটটা আর ছিনতাই হবার ভয় নেই, কেননা সেটা এত ছোটো যে ছিনতাইকারী আসা মাত্র আপনি মুখের ভেতর পুরে বসে আছেন (মুখ খুলবেন না কিন্তু!)। বুঝতেই পারছেন কতখানি প্রয়োজন আমাদের এই ন্যানো টেকনোলজি। আর এই টেকনোলজি দরকার হয় অতি সূক্ষ্ম (Ultra fine) ইলেক্ট্রিক্যাল তার (Nanowire), যা প্রস্তুত করতে গিয়ে সারা দুনিয়ার ইলেক্ট্রনিক্স কোম্পানিগুলর প্রান উচটান অবস্থা। কেননা এগুলো এতোই সূক্ষ্ম যে, সিলিকা, কার্বন বা অন্যান্য ধাতু থেকে তৈরি করা খুবই খরচ আর পরিশ্রমের ব্যাপার। আমাদের এই অণুজীব মহাশয় এক্ষেত্র হাজির হয়েছেন এক নতুন সমাধান নিয়ে। Geobacter এর শরীরের Pili নামে সুতার মত(আসলে সুতার চেয়েও সূক্ষ্ম) কিছু গঠন এর কোষীয় দেহের উপর ছড়িয়ে থাকে, যেমন থাকে আমাদের শরীরের লোমগুলো। তবে অন্যান্য ব্যাকটেরিয়ার থেকে Geobacter এর Pili’র পার্থক্য হল-এগুলো পাওয়া যায় এদের শরীরের কেবল একদিকে। এই পিলিগুলো ব্যবহার করে এরা DNA Transfer বা চলাফেরার কাজও করে থাকে। Geobacter এই Pili গুলো মাত্র ৩ থকে ৫ ন্যানোমিটার চওড়া(মানুষের চুলের থেকেও ২০,০০০ গুন বেশি চিকন!) আর যত না চওড়া তার থেকে হাজার গুন বেশি লম্বা। আর এরা অনেক বেশি স্থায়ী। অতএব......বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা। কেননা কাদামাটির ভেতর এদের সংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে- কোটি কোটি বললেও কম হবে। ল্যাবে এদের জন্মানো যায় বিলিয়ন বিলিয়ন সংখ্যায়, অতি অল্প আয়াসে। এমনকি Genetic Modification করে ইচ্ছেমত গুণাবলীসম্পন্ন বিদ্যুৎ পরিবাহী Pili তৈরি করাও সম্ভব হবে। কাজেই কিছুদিন পর যদি এই Microbial Nanowire ব্যাবহার করা হয় তাহলে কি খুব অবাক হবার কিছু থাকবে? মোটেও না। কমবে খরচ, বেঁচে যাবে পরিশ্রম আর হাজারো যন্ত্রপাতি সামলানোর ঝামেলা। এটুকু অন্ততঃ বলা যায় সময়ের সাথে দৌড়ে পৃথিবী এগিয়ে যাবে কয়েকগুণ । বলুন, বদলে যাবেনা আপনার এই চিরচেনা পৃথিবী? বর্তমান বিশ্বের Microelectronics এর উন্মাদনাকে কয়েকগুন বাড়িয়ে দেবে Geobacter।
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১১ রাত ১২:২৯