সূর্য দেবতার প্রাসাদটি ছিলো এক দীপ্তিমান স্থান। এটি বিকিরন ছড়াতও স্বর্ন থেকে,দীপ্তি ছড়াতো আইভরি থেকে আর চাকচিক্য ছড়াতো মণিমুক্তো থেকে। ভেতরে বা বাইরের সবকিছুই ছিলো উজ্জ্বল এবং ঝলমলে। সেখানে সবসময়ই থাকতো আলোকঝলমলে দুপুর। গোধুলি কখনোই সেখানকার উজ্জ্বলতাকে ম্লান করতে পারতো না। অন্ধকার কিংবা রাত্রি বলতে সেখানে কিছু ছিলো না।
যদিও মরণশীল মানুষ সেখানে যাবার ইচ্ছা ধারন করতো কিন্তু খুব কমই সেখানে যাবার পথ খুজে পেয়েছে। তবুও মায়ের দিক থেকে এক মরণশীল যুবক সেখানে যাবার দুঃসাহস দেখালো। তাকে প্রায়ই থেমে যেতে হলো এবং উজ্জ্বল আলোতে ধাঁধিয়ে যাওয়া চোখ কে বিশ্রাম দিতে হলো। অতঃপর সে পৌছালো সেই প্রাসাদে। বার্নিশ করা দরজার মাঝে দিয়ে সে এগিয়ে গেলো সিংহাসন কক্ষে যেখানে চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল আলোকময় সৌন্দর্যে পরিবেষ্টিত হয়ে বসে ছিলেন সূর্যদেবতা। সেখানেই ছেলেটিকে থামিয়ে দেওয়া হলো এবং সে আর আগাতে পারলো না।
সূর্যদেবতার চোখকে কোনোকিছুই ফাকি দিতে পারে না। তিনি সাথে সাথেই ছেলেটিকে দেখতে পেলেন এবং তার দিকে সদয়ভাবে তাকালেন। " তুমি এখানে কি করে এলে? " তিনি জিজ্ঞেস করলেন। ছেলেটি সাহসের সাথে উত্তর দিলো, " আমি জানতে এসছি তুমি আমার পিতা হও কিনা। আমার মা বলেছে যে তুমিই আমার পিতা, কিন্তু আমি যখন কাউকে বলি যে তুমি আমার পিতা তখন অন্যান্য ছেলেরা আমাকে নিয়ে বিদ্রুপ করে।তারা আমাকে বিশ্বাস করে না। আমি আমার মাকে তা বলেছি এবং তিনি আমাকে বলেছেন তোমার কাছে গিয়ে আমার তা জেনে নেওয়া উচিত। মৃদু হেসে সূরযদেবতা জলন্ত আলোতে তৈরি তার মুকুটখানি খুলে ফেললেন যাতে ছেলেটি তার দিকে ভালো করে তাকাতে পারে। " এখানে এসো ,ফেইথন " তিনি বললেন। " তুমিই আমার পুত্র। ক্লাইমিনি ( ফেইথনের মায়ের নাম) তোমাকে সত্যি কথাই বলেছে। আশা করি তুমি আমার কথা অবিশ্বাস করবে না। কিন্তু তবুও আমি তোমাকে প্রমান দেব। আমার কাছে তুমি যা খুশি চাইতে পারো এবং তুমি তা পাবে। আমি আমার প্রতিজ্ঞার সাক্ষ্য হিসাবে ডাকবো দেবতাদের অঙ্গীকারের নদী স্টিক্সকে।
পিতার এরূপ অঙ্গীকারে অসম্ভব খুশী হয়ে ফেইথন চাইলো এক অসম্ভব চাওয়া যা ছিলো তার জন্য অপরিণামদর্শিতা স্বরুপ। সে বললো, "পিতা, আমি তোমার আসনে বসতে চাই। এই একটি মাত্র চাওয়া। কেবল একটি দিনের জন্য শুধু মাত্র, একটি দিনের জন্য আমাকে তোমার রথটি চালাতে দাও।
সূর্যদেবতা বললেন, প্রিয় পুত্র, আমি জানি যে আমি ষ্টিক্সের নামে অঙ্গীকার করেছি তাই আমাকে তা রক্ষা করতেই হবে, কিন্তু আমি চাই না তুমি এটি চাও।তুমি ক্লাইমিনি এবং আমারও সন্তান।তুমি মরণশীল এবং কোনো মরণশীল এ রথ চালাতে পারবে না। এমনকি এটি দেবতাদের মাঝেও কেউ চালাতে পারবে না। প্রকৃতপক্ষে আমি ছাড়া এটি কেউ নিয়ন্ত্রন করতে পারবে না। পথটির কথা ভেবে দেখো।এটি সমুদ্র থেকে এমনি খাড়াভাবে উঠে গেছে যে আমিও নিচে তাকাতে সাহস পাই না। সবচেয়ে কষ্টের হলো অবতরনটি, এটি এমন খাড়া যে আমি নিজেই আশ্চর্য হই এটা ভেবে যে কিভাবে আমি উলটে না গিয়ে নেমে আসতে পারলাম। ঘোড়াগুলো পরিচালনা করাও এক অনন্ত লড়াই। যখন এরা উপরে উঠে তখন এদের উপর আমার নিয়ন্ত্রন থাকে না বললেই চলে।
কিন্তু এসব কথা কোনোটই অর্থময় হয়ে উঠলো না ছেলেটির কাছে বরং এক চমৎকার দৃশ্য উন্মোচিত হলো তার কাছে। সে দেখতে পেলো যে , সে গর্বভরে দাড়িয়ে আছে সেই বিস্ময়কর রথে। সে তার পিতার সতর্কবাণীতে বিন্দু মাত্র কর্ণপাত করলো না। অনুভব করলো না কোনো ভয়ের শিহরন। অবশেষে সূর্যদেবতা তাকে এ কাজ হতে নিবৃত্ত করার প্রচেষ্টায় ক্ষান্তি দিলেন।
সময় হয়ে এসেছে, ভোরের শেষ তারাটিও ম্লান হয়ে গিয়েছে। ঘোড়াগুলোকে লাগাম পরিয়ে দেয়া হয়েছিলো এবং জুড়ে দেওয়া হয়েছিলো যানটির সাথে। ফেইথন শুরু করলো তার রথ চালনা। সমুদ্রের কাছে নিচু হয়ে আসা মেঘদলের ভিতর দিয়ে ঘোড়াগুলোর উড়ন্ত পা ছুটে চললো সমুদ্র কুয়াশা ভেদ করে। অতঃপর স্বচ্ছ বায়ুর ভিতর দিয়ে এরা ছুটে চললো উপরে এবং আরো উপরে, উঠে গেলো স্বর্গ চুড়া পর্যন্ত। কিছু মূহুর্তের জন্য ফেইথন নিজেকে আমাকশের প্রভুরুপে উপলব্ধি করলেন। কিন্তু হঠাৎ ঘটলো ছন্দপতন। রথটি তীব্রভাবে এপাশ ওপাশ দুলতে লাগলো। ফেইথন নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেললো। তখন সে নয় ঘোড়াগুলোই গতি পরিচালিত করছিলো। রথের মধ্যে হালকা ওজন, বলগাতে নরম হাতের স্পর্শ এটুকুই বোঝালো যে তাদের চালক সেখানে নেই।তখন তারাই ছিলো প্রভু। আর কেউ তাদের নির্দেশ দিতে পারবে না। তারা মূল পথ থেকে ছিটকে গেলো এবং ছুটতে লাগলো ইচ্ছেমতন। তারা রথটিকে প্রায় ধ্বংস করে ফেললো। এর মাঝে হতভাগ্য রথ চালকটি ভয়ে প্রায় বিবর্ণ হয়ে গেলো এবং সে লাগাম ছেড়ে দিলো।
এটি ছিলো আরো অনিয়ন্ত্রিত, বেপরোয়া এবং অপরিণামদর্শী এক গতির সংকেত। ঘোড়াগুলো আকাশের শীর্ষে উঠে গেলো এবং অতঃপর উল্টে নিচে পড়লো এবং এতে আগুন ধরে গেলো।
ফেইথন অতিকষ্টে তার অবস্থান ধরে রেখেছিলো, যদিও সে আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছিলো তীব্র ধোঁয়া ও তাপে। ধরিত্রী মাতাকে বাচাবার জন্য জোভ বজ্র্ নিক্ষেপ করলেন সজোরে সেই রথচালকের দিকে। এটি তাকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিলো, চুরমার করে দিলো যানটিকে এবং ঘোড়াগুলোকে ধাবিত করলো সমুদ্রের দিকে।
এত সাহসী এবং এত অল্পবয়সে মৃত্যুবরণকারী ছেলেটির জন্য সহানুভুতি ছিলো সবার। তাকে সমাহিত করা হলো এবং সেখানে খোদাই করে লেখা হলো :
এখানে শুয়ে আছে ফেইথন যে চালনা করেছিলো সূর্য-দেবতার যান।
সে ব্যার্থ হলো, কিন্তু তার সাহস ছিলো অসাধারণ।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০১৩ সকাল ১১:১৯