ক্লাশ নাইনে পড়ি তখন। অন্যান্য সাবজেক্টের ঠেলায় বাংলা পড়া হয় না কখনোই । কাজেই পরীক্ষার আগের রাতে কিছু রিডিং পড়াই ভরসা! এরপর যেমন খুশি তেমন সাজোর মতো যেমন ইচ্ছে তেমন বানিয়ে লিখো! তো নাইনের ফাস্ট টার্ম পরীক্ষায় বাংলা সেকেন্ড পেপারে রচনা লিখতে হবে । যে পাঁচটা অপশন দেয়া আছে তার মধ্যে বেছে নিলাম "একটি বর্ষণমুখর সন্ধ্যা"! এরপর শুরু হলো মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজ সাহিত্য প্রতিভা উদগিরণ! কিন্তু বিপত্তি বাঁধল অন্য জায়গায়। প্রতিটা পয়েন্টের লেখা বানিয়ে বানিয়ে লেখা খুব সোজা হলেও পয়েন্টের শেষে অথবা মাঝে দু-চার লাইন কবিতা দিতে হয় এ ধরনের রচনায়! কিন্তু আমার কাব্যজ্ঞান তো রবীন্দ্রনাথের , "নীল নব ঘন আষাড় গগনে " পর্যন্ত সীমাবদ্ধ! রচনার বই টই ও পড়ি নাই যে অন্য কবির কিছু লাইন মুখস্থ থাকবে! মহা যন্ত্রনা! পরীক্ষার হলে বসে বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে এরপর শুরু করলাম কবিতা লিখা! পয়েন্টের মাঝে অথবা শেষে কবি বলেছেন কিংবা মনে পড়ে যায় ...এই কথা লিখে বসিয়ে দিতে লাগলাম নিজের সদ্য প্রস্তুত করা দুই লাইন কিংবা চার লাইন! সাহস যখন খুব বেড়ে গেল তখন শেষ প্যারায় রবীন্দ্রনাথের নাম দিয়ে বসিয়ে দিলাম নিজের লেখা চার লাইন!!! কিছুদিন পর পরীক্ষার খাতা দিলো! অবিশ্বাস্য! রচনাতে ২০ এর মধ্যে ঊনিশ দিয়েছিলেন আমাকে ম্যাডাম! আমি যখন আনন্দে পারলে লাফাই বিপত্তি বাঁধল তখন! ম্যাডাম আমাকে ডেকে বললেন , "তোমার রচনাটা আমার খুবই ভালো লেগেছে। তুমি বেশ আধুনিক কিছু কবিতার ব্যবহার করেছো! যদিও কবিদের নাম নেই। ওটা দেয়া উচিৎ ছিলো।" আমি সুবোধ বালকের মত মাথা নাড়লাম! এরপর ম্যাডাম বললেন , "আচ্ছা লাস্ট প্যারাটায় তুমি রবীন্দ্রনাথের যে লাইন গুলো দিয়েছো সেগুলো কোন কবিতার? লাইন গুলো বেশ সুন্দর! কিন্তু টিপিকাল রবীন্দ্রনাথীয় লেখার মতন না! আমার বোধ হয় কবিতাটা পড়া হয় নি!" আমি তখন ঘামছি রীতিমত! এবার কি করি! কোনমতে ঢোক গিলে বললাম, "ম্যাডাম আমাদের বাসায় কোন একটা বইতে জানি পড়েছিলাম। লাইন গুলো খেয়াল আছে। কিন্তু কবিতাটার কথা মনে নেই!" আমার কথা শুনে ম্যাডাম উদাস হয়ে গেলেন! বললেন, "আসলেই রবীন্দ্রনাথের কত লেখাই যে পড়ি নাই!" আমি ম্যাডামের চেয়েও দ্বিগুন উদাস হয়ে বললাম, "আমাদের আরো বেশি করে রবীন্দ্র চর্চা করা উচিৎ! রবীন্দ্র সাহিত্য নিয়ে আরো অনেক জানতে হবে আমাদের! " এই কথা বলে গম্ভীর মুখে বিষন্ন দার্শনিকের মত সরে এলাম ম্যাডামের সামনে থেকে! এই হলো আমার কবি হওয়ার গল্পের শুরু! এরপর থেকে ইন্টার পর্যন্ত যখন যেখানে কবিতার প্রয়োজন হয়েছে নির্দ্বিধায় নিজের লেখা লাইন গুলো চালিয়ে দিয়েছি কবিদের নামে! তবে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রনা গিয়েছে জীবনানন্দ দাশের উ্পর দিয়ে!
কবিতা লেখার ভূত তো মাথায় চাপল! আর তো নামে না! এই ভূতের ঠেলায় ইন্টার লাইফে কাব্য প্রতিভার বিস্ফোরন ঘটল! আমি তখন অনেক কবিতা লিখি! যা মনে আসে তাই লিখি! মাঝে মাঝে জোর করে আমার ছোট ভাইকে শোনানোর চেষ্টা করি! বেচারা করুন মুখে আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে! তো এভাবেই একদিন ফিজিক্স খাতার কভার পেজের উলটো দিকে একটা কবিতা লিখে ফেললাম। ওই খাতা আমি আবার ফিজিক্স প্রাইভেটে নিয়ে যেতাম! একদিন ভুলে ফিজিক্স ম্যাডামের বাসায় খাতাটা রেখে আসা হলো! আর তা পড়ল আমার এক বন্ধুর হাতে! যাকে কিনা আমরা বি বি সি বলি! কারন যে কোন সংবাদ সবার মাঝে প্রচার তার দারুন উৎসাহ! সে যখন দেখল আমার ফিজিক্স খাতার ভেতর কবিতা লেখা তখন সবার মাঝে এই খবর ছড়ানোকে সে নিজের নৈতিক দায়িত্ব মনে করল! পরদিন ফিজিক্স পড়তে গেছি, আমার নিজের ও খেয়াল নেই যে ওই খাতায় কবিতা লিখেছিলাম! ব্যাচে ঢুকতেই দেখলাম সবাই কেমন কেমন করে আমার দিকে তাকাচ্ছে! আমি একটু ক্যাবলা টাইপ হাসি দিলাম সবার দিকে তাকিয়ে। এরপর শুরু হল....এক বন্ধু এসে বলল, "তুই কবিতা লিখিস? " এটা বলেই বিরাট এক হা করে ফেলল সে! আরেকজন এসে বলল, " দোস্ত তুই যে প্রেম করিস এটা বলিস নাই ক্যান?" অন্য আরেকজন এসে দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলল, "ছ্যাঁকা খাইছসি নাকি দোস্ত?" একের পর এক প্রশ্ন তীরের মত ছুটে আসতে লাগল আমার দিকে! পড়ানোর মাঝে ম্যাডাম পর্যন্ত বললেন, "নাহিয়ান তুমি নাকি কবিতা লিখো! " ম্যাডামের কথার সাথে সাথেই ফিক করে হেসে উঠল কয়েকটা মেয়ে! আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বললাম , "ধরণী দ্বিধা হও" । পড়া শেষে যখন বেরিয়ে আসব তখন ব্যাচের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটা আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, "তোমার ফিজিক্স খাতায় যে কবিতাটা লেখা ছিলো, সেটা তুমি লিখেছো?" আমি তখন ত্যাক্ত, বিরক্ত, অস্থির! বালিকার দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, " আর নাহ! আমি যখন রাতে ঘুমাই তখন রবীন্দ্রনাথ এসে আমার খাতায় বসে লিখেছে! ব্যাটা বড় দুষ্টু! আমি বলেছিলাম লিখলে বাংলা খাতায় লিখুন! কিন্তু ওই ব্যাটা ফিজিক্স খাতায় কবিতা লিখেছে! " হায়! আমার এই নির্দোষ রসিকতা বালিকা সরলভাবে নিলো না! রীতিমত মুখ ঝামটা দিয়ে সরে গেল আমার সামনে থেকে!
আগেই বলেছি ইন্টার লাইফেও নিজের লেখা কবিতা বিখ্যাত কবিদের ঘাড়ে নিয়মিতই চাপিয়েছি পরীক্ষার খাতিরে! তবে একবার কিন্তু ধরা পড়েছিলাম! ইন্টারের বাংলা স্যারের কাছে! বাংলা প্রথম পত্রে "বিলাসী" গল্পের একটা প্রশ্নের উত্তর লেখার সময় এরকম দু লাইন চালিয়ে দিয়েছিলাম জীবনানন্দ দাশের নামে! কিন্তু স্যার কিভাবে যেন ধরে ফেললেন !স্যার কখনোই সরাসরি কিছু বলতেন না! যেদিন খাতা দিচ্ছে সেদিন হঠাৎ সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে বলতে স্যার বললেন, " বড় বড় লেখকদের কিছুটা অপরিচিত লেখাকে নিজের লেখা নামে চালানোর চেষ্টা অনেক সময়ই দেখা যায় নবীন সাহিত্যিকদের মাঝে! কিন্তু ইদানিং কালে নিজের লেখা বড় বড় কবিদের নামে চালিয়ে দেয়ার মত অদ্ভুত ব্যাপার ও দেখা যাচ্ছে অ্নেকের মাঝে! " এই কথা বলতে বলতে স্যার মিটিমিটি হাসতে লাগলেন আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে! আমি তখন উদাস ভঙ্গীতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম!
বুয়েটা লাইফের শুরুতেও কবিতা লিখার ভূতটা আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিলো। ফলশ্রুতিতে প্রথম টার্মে যখন মেকানি্কাল ডে হলো , সেখানে আমাদের ম্যাগাজিন "অযান্ত্রিক" এ একটা কবিতা দিয়ে দিলাম! বড় ভাইয়ারা আবার তা পাঠযোগ্য মনে করো ছাপিয়েও দিলো! তো দিন কয়েক পর আমাদের সবার হাতে ম্যাগাজিন দেয়া হচ্ছে। কিছুক্ষন পর আমার এক বন্ধু আসল আমার সামনে । এসে বলল, "তুমি কবিতা লিখো?" আমি বেশ ভাব নিয়ে মুচকি হাসি দিলাম! এরপর আমাকে বলল সে , " কি লিখছো কিচ্ছু বুঝি নাই! কিন্তু লেখাটা সুন্দর!" আমি মনে মনে বললাম, "হায় কবিতা! "
এরকম আরো অনেক কাহিনীই পার করে এসেছি আমার কাব্য বেলায়! আজ তাই হাসি পায়! মনে মনে ভাবি, "আমি ও কবি ছিলাম!"
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১২ সকাল ৭:১৫