দৃশ্যটা আমার খুব পরিচিত। লাল ফ্রক পরা একটা বাচ্চা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে চোখ ভর্তি বিস্ময় নিয়ে। সামনে সাদা কাপড়ে ঢেকে দেয়া একটা মানুষের শরীর। ওরা এটাকে বলছিল "লাশ"। ওরা মানে বাচ্চাটার আত্বীয় স্বজনেরা। বাচ্চাটা এটা বুঝতে পারছিল না এই শুয়ে থাকা মানুষটার নাম তো "আম্মু"। তাহলে এরা লাশ বলছে কেন? সন্ধ্যা মিলাবার আগেই যখন বাচ্চাটা অর্থাৎ আমি নিজেকে আবিস্কার করলাম ছোট ফুফুর কোলে তখন কেন জানি আম্মুর কথা আর মনে হচ্ছিল না। খুব ঘুম পাচ্ছিল আমার, ছোট ফুফুর গা থেকে আসা তীব্র ঘামের গন্ধটাকে অগ্রাহ্য করেই। সেদিনের ঘুম ভাঙ্গার পরের গল্প আর মনে নেই। কিন্তু এর কিছুদিন পরে লাল রঙ এর শাড়ী পড়ে চিকন, কালো মত একজন মহিলার আমাদের বাসায় আসার কথা মনে আছে। "ইনি তোমার আন্টি হন, আন্টি তোমাকে এখন থেকে অনেক আদর করবে। ", আমার সদা স্মার্ট ইঞ্জিনিয়ার বাবা কথাগুলো বলছিলেন যখ্ন তখন আমি লক্ষ্য করছিলাম সেই আন্টির মুখটা একটু বাঁকিয়ে হাসার ব্যাপারটা।
ছোট্ট একটা কালো স্যুটকেসে আমার যাবতীয় সম্পত্তি নিয়ে চলে এলাম বোর্ডিং স্কুলে। আমার শহরটাকে ছেড়ে। এখানে আমার মামা থাকেন। সুতরাং মামা এসে বিভিন্ন সময় আমাকে দেখে যেতে পারবেন। আর বাসায় থেকে আমি একদমই পড়াশোনা করছি না। খুব দুষ্টু হয়ে যাচ্ছি। তাই আমার এরকম স্কুল দরকার। না , কথাগুলো আমার না। কথাগুলো ছিল বাবার। গাড়ীতে আসতে আসতে আমি বাবার এই কথাগুলো লক্ষী মেয়ের মত মন দিয়েই শুনছিলাম। আর ভাবছিলাম, আন্টি তো আমাকে অনেক আদর করবে, বলেছিল বাবা। কিন্তু পুতুলের বিয়ে দিয়ে ঘর নোংরা করার জন্য ওরকম জোরে চড় মারল কেন? জানি না, আমার ছোট্ট মাথায় এত ভাবনা সয় না।
রুম নম্বর দুইশ এক, নিচের বেড। আমার নতুন স্কুল জীবন শুরু হল। ক্লাশ থ্রীর একটা বাচ্চা মেয়েকে সকাল সাতটায় উঠে কেন কেডস -মোজা পরে দৌঁড়াতে হবে, তার যৌক্তিকতা ভেবে আজো হাসি পায় আমার! জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় আমার নাকের ঠিক মাঝ বরাবর এসে বসেছিল একটা মাছি! আমি একটুও দুষ্টুমি করতে চাই নি, শুধুমাত্র হাসি পেয়ে গিয়েছিল সেদিন! কিন্তু গাওয়া শেষ হতেই রাহেলা ম্যাডাম এসে যখন দুই হাত লাল করে দিলেন, আমার কান্না পেয়েছিল। আমি কেঁদেছিলাম। আমার উপরের বেডে থাকে সুতপা আপু। ক্লাশ সিক্সে পড়ে। অনেক বড় আমার চেয়ে! সুতপা আপুর বাসা থেকে প্যারেন্টস ডে তে বক্স ভর্তি ক্যাডবেরি আসে। আর আমি সেগুলো বেডে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে খাই। বাবা কখনো আসে না প্যারেন্টস ডে তে। কিংবা তুর্না আপুর আম্মুর মত কোন ছুটির দিনে আসে না আন্টিও । যে কোন ছুটি হলে মামা এসে আমাকে নিয়ে যান। রিন্টু -বিন্টুর সাথে ওদের বাসার ছাদে খেলি আমি। ওরা আমার ঝুটি খুলে দেয়, আবার বেঁধে দেয় ওরাই! রাতের বেলায় মামি এসে জোর করে এক গ্লাস দুধ খাইয়ে যায়! আমি কিছুটা খাই, কিছুটা মুখে রেখে পরে ফেলে দিই বাইরে! মাঝে মাঝে মামা আমাকে ডেকে নিয়ে বাইরের বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে থাকে। কথা বলে না। মাথায় বিলি কেটে দেয়। আমি ঘুমিয়ে যাই মামার পাশেই।
ক্লাশ সেভেনের রেজাল্ট দিল যেদিন, সেদিনই খবর এল আমি আর এই স্কুলে থাকছি না। মামা এসে মুখ শুকনো করে বললেন, "তোর ফুপুর ওখানে থাকতে হবে রে মা। তোর বাবা বলেছে। ওখানকার স্কুলে ভর্তি করে দেবে। " সদ্য কৈশোরে পা রাখা আমি তীব্র জেদে চিৎকার করে উঠি । "কেন?", মামা কিছু বলেন না। আবারো আমার স্যুটকেস, আমি নতুন শহরে। ফুফুর বাসায় পা দিয়েই যেন বহুদিন পর পেলাম সেই ঘামের তীব্র গন্ধ। উত্তর দিকের কোণার রুমটি বরাদ্দ হল আমার জন্য। "এত বড় ধাড়ী মেয়েকে তুলে দিয়েছে আমার ঘাড়ে", ফুফুর রাগে গজ গজ করতে থাকা গলা শুনেছিলাম দিন সাতেক পরেই। কেন আমার স্কুল পরিবর্তন হল তা কিছুদিন আগেও না বুঝলে ,এখন বুঝলাম আমার জন্য পাঠানো বাবার মাসিক টাকার অংক দেখে। স্কুলের প্রতিটি দেয়াল স্যাঁতস্যাঁতে। মেয়েগুলো মাথায় জবজবে তেল দিয়ে আসে। সকাল বেলায় এখানে জাতীয় সঙ্গীত ও গাওয়া হয় না। পরীক্ষার দিন বই বেঞ্চের নিচে লুকিয়ে লিখে অনেকেই। ম্যাডামেরা গল্প করেন ক্লাশ রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে। আমার সামনেই মেয়েগুলো আলোচনা করে কোন নায়ক কত হট, তার জন্য কয়জন হাত কেটেছে তা নিয়ে। আর আমি তীব্র অস্বস্তিতে ডুবে থাকি এখানে নিজের উপস্থিতির জন্য। কোন কোন রাতে আমার রুমের দরজার বাইরে থেকে সিগারেটের গন্ধ আসে, আসে কাশির শব্দ। একদিন ধাক্কা পড়ল দরজায়। আমি তখন ক্লাশ টেনে পড়ি। ফুফুর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সশব্দে চড় এসে পড়ল গালে। জানি না, সেদিন কেন যেন কান্না পায় নি। শুধু অদ্ভুত রকম কষ্ট লেগেছিল।
ভার্সিটির ক্যাফেতে বসেছিলাম। এক সপ্তাহ হলো ক্লাশ শুরু হয়েছে। কেন জানি আজ পিছনের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। ইশ , এখন কত স্বাধীন আমি! হলের ছোট্ট রুমটায় আমার নিজের বিছানাটার কথা ভাবলেই মনে পড়ে যায় সেই বোর্ডিং স্কুলের কথা! কিভাবে এখানে এলাম আমি? বোধ হয়, আমার রেজাল্টের কারনেই বাধ্য হয়ে বাবা এখনো পড়াশোনা করাচ্ছেন আমায়। কিন্তু এখনো প্রতি মাসে টাকা আসতে মাসের অর্ধেক পার হয়ে যায়। ছুটিতে বাড়িতেই যেতে হয়। মামার ওখানে আর যাওয়া হয় না। আর বাড়িতে গিয়েই পেতে হয় আমার আন্টির "আদর"। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালাম। ক্যাফের বাইরে আসতে না আসতেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হল। হায়, আমি তো ল্যাব রিপোর্ট ও আনি নাই! একটু পরেই ল্যাব। রিকশাটা দেখা যেতেই আমি যখন মরিয়া হয়ে ডা্কলাম, তখন একই সাথে ওপাশ থেকে আরেকটা কণ্ঠ ও ডাকল রিকশাটাকে! মুখের দিকে তাকাবার আগেই চোখ গুলোর দিকে দৃষ্টি চলে গেল! এত সুন্দর বিষন্ন চোখ হয় কারো! "আপনিই উঠুন ", কথা বলল পাশের কণ্ঠটা। রিকশা দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম ভিজতে ভিজতে দৌঁড়ে যাচ্ছে ছেলেটা! নিজের মনেই হাসলাম কিছুক্ষন!
তোমার সাথে যতটা সময় আমি কাটিয়েছি তার বেশিরভাগ সময়ই যে আমি শুধু তোমার চোখের ভাষাটাই খুঁজে ফিরেছিলাম, তা কি তুমি জান শুভ? মনে হয় না! আমার কল্পনা গুলো সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল একটা নির্দিষ্ট বৃত্তে, শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্যই যেন বেঁচে থাকা ছিল আমার। শুভ তোমার হাত ধরে আমি বুঝেছিলাম, আরো
কিছু আছে বোধ হয় জীবনে! তোমার সাথে সারা সন্ধ্যা কাটিয়ে যখন হলে ফিরেছিলাম, তখনই টেবিলের উপর পড়ে থাকতে দেখলাম চিঠিটা। "তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। তোমার ফুপাতো ভাইয়ের সাথে। রায়হান কে তো তুমি চেনোই। বাসায় চলে এসো তাড়াতাড়ি"। আর কিছু লেখেন নি বাবা। আমার মনে পড়ে গেল বন্ধ দরজা, সিগারেট আর দরজায় ধাক্কার শব্দ। "তুমি আমাকে বিয়ে করতে পারবে? আজ?", স্পষ্ট করেই শুভকে প্রশ্নটা করেছিলাম পরদিন সকালে। আমি তোমার উত্তরটা বুঝে গিয়েছলাম তোমার নত দৃষ্টি থেকেই।
আবারো স্যুটকেস হাতে আমি। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি। ট্রেনে ওঠার পর একবার ইচ্ছে হল দু'চোখ যতদূরে যায় ততুদূরে খুঁজে দেখি সেই চেনা চোখ দুটো দেখা যায় কিনা। না , দেখা যাচ্ছে না। ট্রেন চলছে। আমিও চলছি । আমার সেই বৃত্ত পথেই ফিরে এসেছি আমি। অবাক লাগছে না, খারাপ ও লাগছে না। শুধু একটা শূন্য অনুভুতির ভেতর ডুবে যাচ্ছি।
অন টপিকঃ দিন কয়েক আগেই লেখা আমার একটা গল্পকেই কেন জানি অন্য দৃষ্টি ভঙ্গী থেকে দেখার ইচ্ছে হল! তাই এই লেখা! ওখানে ছেলেটার গল্প শোনা হয়েছে! আজ আমি শুনলাম মেয়েটার গল্প! গল্পটা- একদিন অথবা অন্যদিনের গল্প
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১২ সকাল ৭:১৫