উত্তরাধুনিকতা, এক তরঙ্গ এসে পালটে দিয়ে গেলো সব দর্শন, শিল্প, স্থাপত্য, সমালোচনাশাস্ত্র। রবার্ট ফ্রস্ট বলেন, আধুনিক মানুষকে যে কবিতা শোনাতে পারে তিনিই আধুনিক কবি। উত্তরাধুনিকতা আর আধুনিকতা অবশ্য এক বিষয় নয়। উত্তরাধুনিকতা অ্যাবসোলুট নলেজকে অস্বীকার করে, আপেক্ষিকতাই এর ভিত্তিভূমি। রবার্ট ফ্রস্টকে টেনে বলা যায়, উত্তরাধুনিক মানুষকে যে কবিতা শোনায় সে উত্তরাধুনিক কবি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় মালয় রায়চৌধুরীর কথা, প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাংরি আন্দোলনের একজন মালয় রায়চৌধুরী। হাঙরি আন্দোলনের সাথে বিট প্রজন্মের সাথে উত্তরাধুনিকতাকে সদৃশ করা যায় না যদিও, উত্তরাধুনিক দর্শনের মানদণ্ডও এসব আন্দোলন নয়।
"ওঃ মরে যাব মরে যাব মরে যাব
আমার চামড়ার লহমা জ্বলে যাচ্ছে অকাট্য তুরুপে
আমি কী কোর্বো কোথায় যাব ওঃ কিছুই ভাল্লাগছে না
সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাব শুভা
শুভা আমাকে তোমার তর্মুজ-আঙরাখার ভেতরে চলে যেতে দাও
চুর্মার অন্ধকারে জাফ্রান মশারির আলুলায়িত ছায়ায়
সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে
আর আমি পার্ছিনা, অজস্র কাঁচ ভেঙে যাচ্ছে কর্টেক্সে
আমি যানি শুভা, যোনি মেলে ধরো, শান্তি দাও।"
মালয় রায়চৌধুরীর প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতোর, নিষিদ্ধ করা হয় এ কবিতা। আধুনিক শিল্পের বিরুদ্ধে একটা মহল বেশ তৎপর দেখলাম। এদের কাছে জীবিত কোন কবিই কবি নয়, শিল্প চলে যাচ্ছে ভাগাড়ে, আধুনিক শিল্পের গুটিকতক উদাহরণের জের ধরে এরা রোধ করতে চাচ্ছেন শিল্পের এ পুরো গতিকেই। আমেরিকায়তো ১৯৪০-এর দশকে বামপন্থিদের রোধের নামে উত্তরাধুনিক শিল্পপ্রেমী দেখলেই তার উপর দিয়ে যেতো নির্যাতনের স্টিম রোলার। রোকোকো আন্দোলন, ধ্রুপদী শিল্প, নব্য ধ্রুপদের উদাহরণ টেনে শিল্পে বিমূর্ততার বিরুদ্ধে যুক্তি দেখায় তারা, এরা ডানপন্থি। পাঠ্যবইয়ের কথা এখানে বললাম, কারণ এরা শিল্পের গতিবিধিও নিয়ন্ত্রণ করতে চায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রণোদিত হয়ে। কবিতায় ছন্দ নেই, গদ্য কবিতাকেও মেনেও গদ্য কবিতায় কাব্যের তরঙ্গ নেই, অন্তঃমিল নেই এমন বহুবিধ যুক্তিতে পাঠ্যবইয়ের বাইরের কবিদের বাইরে তারা মুখ ফেরাননা। এদের অবশ্য সাহিত্য পাঠক বলা যায় না, তবে অনেক সুপাঠকও দেখলাম এর বিরুদ্ধে। ছন্দই যদি সব হয়, তবে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তওতো কবি হয়ে যান, কবি বলতে হয় আখতারুজ্জামান আজাদকেও। ছন্দ এখানে মূল বিষয় না, তবে ইম্প্রেশনিজমের বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে ছন্দহীনতার উপরই হামলে পড়ে তারা বেশী। শিল্পবিপ্লবপরবর্তী, বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সাহিত্যে-শিল্পে একটা তরঙ্গ আসে, মনস্তত্বে যে পরিবর্তন আসে পাঠকের-লেখকের, রূচি, জীবনদর্শনে তাকে আমরা অস্বীকার করি কীভাবে? সে আধুনিক পাঠকের জন্যে, আধুনিক লেখকের মনের কথা বলার জন্যে আধুনিক শিল্পের উদ্ভবটা খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা।
তবে এর বিপরীতও ভেবে দেখা দরকার। এ উত্তরাধুনিকতা শুধু হতাশার কথা বলে, বিষণ্নতা, তথাকথিত পুঁজিবাদী সমাজে মানুষের যন্ত্রণার কথা বলে, বিষণ্নতার কথা বলে, যন্ত্রণার কথা বলে, হতাশার কথা বলে, চর্বিতচর্বন। মার্কসবাদের রোমান্টিসিজমে আক্রান্ত এ শিল্পে কোন শিল্পী এ নির্দিষ্ট বলয়ের বাইরে ভাবে না, বৃহত্তর শিল্পী সমাজ এর বাইরে ভাবতে দেয় না। তাদের নির্দিষ্ট মতবাদের বাইরে সবাই সমাজবিরোধী। স্রষ্টা নেই এমন একটা পূর্বধারণা নিয়েই তাদের শুরু হয়, প্রশ্ন করার অবসর নেই তাদের, প্রশ্ন করার সুযোগ দেয়া হয় না অন্যদের। তাদের পূর্বনির্ধারিত পুনঃপুনঃ করা প্রশ্নের বিরুদ্ধে কেউ যাবে, এটা তারা মেনে নিতে পারে না।
উত্তরাধুনিকতা নিয়ে যতটুকু জেনেছি ভেবেছি ততটুকু আসলে জানিনি। ভুল ধারণায় ছিলাম। আরও কিছু পড়াশুনো করতে হবে, এর ভাল দিক, খারাপ দিক দুদিক নিয়েই। ভেবেছিলাম এটা নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখবো, সে আশা গুড়েবালি হলো; আপাতত।
কবির নাঈম
হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা
২২ এপ্রিল ২০১৯
(ব্যক্তিগত দিনলিপি থেকে)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০১৯ রাত ১০:৩১