বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণাগারের কম্পিউটারগুলো নিয়ে বন্ধুদের একরাশ অভিযোগ, “আরে কিছু করা যায় নাকি এগুলো দিয়ে! এর চেয়ে বরং অ্যাপলেরঅ্যাপলের ল্যাপটপ(ম্যাকবুক)-ই ভাল(!)।” অভিযোগের পেছনে কারণ থাকলেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ কারও নেই। কেউ কেউ একটু মুচকি হেসে জানায়, আরে এগুলো লিনাক্স, হ্যাকারদের জন্যে, লিনাক্স এরকমই হয়। এক কাঠি সরেস যারা, তারা লিনাক্সকে অপারেটিং সিস্টেমই দাবী করে বসে। প্রযুক্তি সম্পর্কে আমাদের ধারণা যে খুব কম, তা নয়। মাইক্রোসফট ওয়ার্ড(জনপ্রিয় একটি টেক্সট এডিটর), এক্সএল(একটা স্প্রেডশিট প্রোগ্রাম) বিশেষজ্ঞ অহরহ এদিকে। তবে দক্ষতা থাকলেও, প্রযুক্তিজ্ঞানে আমরা খুব দুর্বল। অনলাইনে বাংলা কন্টেন্ট সার্চ দিলে হতাশ হতে হয়, রিচার্ড স্টলম্যানকে বিশ্বের সেরা দশ ক্র্যাকার, যাদের ওরা হ্যাকার বলে, এর তালিকায় আনা, লিনাক্সকে অপারেটিং সিস্টেম বলা, কালি লিনাক্স নিয়ে অহেতুক বাড়াবাড়ি এমন অনেক ভুল তথ্য দেখে হতাশ হতে হয়। তবুও লিনাক্স কি, এজাতীয় অনেক লেখা আছে, ভাল ভাল লেখাও আছে কিছু। আমার এ লেখাটিও আলাদা কিছু নয়। আমি কিছু সাধারণ ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছি। অস্বীকার করার জো নেই যে আমার লেখায়ও তথ্যগত ভুল থাকতে পারে। এমন ভুলের ক্ষেত্রে ধরিয়ে দিলে কৃতজ্ঞ থাকবো।
প্রথম বিষয় যেটি, তা হচ্ছে লিনাক্স কোন অপারেটিং সিস্টেম না। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, লিনাক্স তথাকথিত কঠিন বা কীবোর্ড থেকে সব টাইপ করে কমান্ড দিয়ে করতে হয় না। এবং তৃতীয় কথা, লিনাক্স কেমন তা কোন দেখার বিষয় নেই। লিনাক্স ডিস্ট্রোগুলো বহুরূপী ও বহুমুখী হতে পারে, নমনীয়তায় মনজয়ী এসব অপারেটিং সিস্টেম ম্যাক ওএস থেকে মাইক্রোসফট উইন্ডোজ সব রূপই নিতে পারে।
উবুন্টু লিনাক্স
অপারেটিং সিস্টেম হচ্ছে সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যারের মধ্যে সংযোগ প্রদানকারী প্রোগ্রাম। যেমন, আমাদের বহুল ব্যবহৃত মাইক্রোসফট উইন্ডোজ, অ্যানড্রয়েড, উবুন্টু এগুলো অপারেটিং সিস্টেম। একটি অপারেটিং সিস্টেমের মূল বা এর হৃদয় হলো এর কার্নেল। যেমন — উইন্ডোজে ব্যবহৃত এনটি কার্নেল, ম্যাকওএসের হাইব্রিড এক্সএনইউ কার্নেল। বুটলোটারের পর এটিই প্রথম লোড হয়, যার কাজ মেমরি ম্যানেজমেন্ট, টাস্ক ম্যানেজমেন্ট ও ডিস্ক ম্যানেজমেন্ট। লিনাক্স লিনুস তোরভালদস নামক এক ব্যক্তির বানানো একটি মনোলিথিক ওপেন সোর্স কার্নেল।
লিনুস তোরভালদস কাজে ব্যস্ত
লিনাক্সের কথা যেহেতু এসেছে, ওপেন সোর্স কথাটি একটু ব্যখ্যা করা যাক। ওপেন সোর্স মানে হচ্ছে উন্মুক্তদ্বার ও উন্মুক্ত প্রবেশ। অন্ধ ভিক্ষুকের থালার মত। কত টাকাকড়ি হয়েছে, আপনি দেখতে পাচ্ছেন। কিছু টাকা কড়ি নিজেও দিতে পারছেন। ওপেন সোর্সের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে গুগলের বানানো এন্ড্রয়েডে অপারেটিং সিস্টেম। তাদের উন্মুক্ত সোর্স কোড যেকেউ নিজের মত করে ব্যবহার করতে পারছে। যেখান থেকে এন্ড্রয়েড ডেরাভেটিভ শাওমির মিইউআই, হুওয়ায়ের ইএমইউআই আসছে। লিনাক্স ওপেন সোর্সের সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ। লিনাক্স কার্নেল অনেকগুলো আলাদা আলাদা ডেভেলপারের যৌথ প্রচেষ্টা ও মেধায় বানানো।
বাংলা উইকিপিডিয়া, ওপেন সোর্স সফল প্রকল্প
বন্ধুদের অভিযোগের কম্পিউটারগুলোতে লিনাক্স চলতো না। চলতো লিনাক্স কার্নেলের উপর ভিত্তি করে নির্মিত অপারেটিং সিস্টেম উবুন্টু। লিনাক্স কার্নেল যেহেতু ফ্রি ও ইউনিক্স-সদৃশ হওয়ায় বেশ নমনীয় দুনিয়ার তাবৎ অপারেটিং সিস্টেমের ৯০%ই লিনাক্স কার্নেলের উপর ভিত্তি করে নির্মিত। এখানের মধ্যে শখের অপারেটিং সিস্টেম, আমাদের রিজওয়ানের ম্যাগপাই ওএস থেকে, খাটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নির্মিত উবুন্টু, সুয্যে এন্টারপ্রাইজ লিনাক্স, রেড হ্যাট এন্টারপ্রাইজ লিনাক্স ইত্যাদি রয়েছে। লিনাক্স কার্নেলের হাড়ে মাংস জুড়ে বানানো এসব দেহকে অর্থাৎ অপারেটিং সিস্টেমকে বলা হয় লিনাক্স ডিস্ট্রিবিউশন।
ডিস্ট্রিবিউশনগুলোকে বিভক্ত করা হয়, তাদের ব্যবহৃত প্যাকেজ মানেজারের উপর ভিত্তি করে। প্রত্যাকেরই ভিন্ন ভিন্ন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আমাদের পরিচিত অধিকাংশ ডিস্ট্রিবিউশনই ডেবিয়ান ভিত্তিক। যে দলে আছে উবুন্টু, ব্যাকস্ল্যাশ লিনাক্স, কালি লিনাক্স, এলিমেন্টারি ওএস। ডেবিয়ানের সহজ ইন্সটলেশন প্রক্রিয়া এ জনপ্রিয়তার কারণ। আবার আরপিএম ভিত্তিক ডিস্ট্রিবিউশনগুলো বেশিরভাগই এন্টারপ্রাইজকে লক্ষ্য করে নির্মিত। ফেডোরা, সেন্টওএস, সুয্যে লিনাক্স এ দলে আছে। অন্যদিকে প্যাকম্যান প্যাকেজ ম্যানেজারের আর্চ ও পোর্টেজের জেন্টু তাদের কঠিন ইন্সটলেশন প্রক্রিয়ার জন্যে যেমন কম জনপ্রিয় তেমনি উচ্চমাত্রার নমনীয় কনফিগারেশনের জন্যের বিখ্যাত। ম্যাগপাই ওএস আর্চ ডেরাভিটিব। গুগলের অপারেটিং সিস্টেম ক্রোমিয়াম জেন্টু ভিত্তিক অপারেটিং সিস্টেম।
ম্যাগপাই ওএস, বাংলাদেশ থেকে একটি আর্চ ভিত্তিক ডিস্ট্রো
ইউনিক্স-সদৃশ অন্য অপারেটিং সিস্টেমগুলোর মত লিনাক্স ডিস্ট্রোগুলোতে ডেস্কটপ এনভায়রনমেন্টে থেকে শুরু করে, উইন্ডো ম্যানেজার সবই পরিবর্তন করা যায়। ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত পছন্দের উপর আইক্যাচিং প্যানথিয়ন থেকে শুরু করে একেবারে হালকা এলএক্সডিই পর্যন্ত সবই নির্বাচন করা যায়। অনেকগুলোতে ডিস্ট্রোতে পূর্ব থেকেই এগুলো কনফিগার করা থাকলেও আর্চ লিনাক্সে তার পছন্দের উপর নির্বাচন করতে পারে যে কেউ।
অধিকাংশ লিনাক্স ডিস্ট্রিবিউশনই ফ্রি ও অত্যন্ত নমনীয়। ব্যবহারকারী নিজের মত করে যেকোন কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ও পুনবিতরণের অধিকার রাখে। যা লিনাক্সক্ব সার্ভার কম্পিউটিঙের একচ্ছত্র অধিপতিতে পরিণত করেছে। কিছু নিরাপত্তা ত্রুটি থাকলেও, অন্য দুটো পিসির জনপ্রিয় অপারেটিং সিস্টেমের চেয়ে লিনাক্স ডিস্ট্রোগুলো অনেক বেশি নিরাপদ। কালি লিনাক্স বা প্যারোট ওএসের মত ইথিক্যাল হ্যাকিং এর উদ্দেশ্যে বানানো ডিস্ট্রোগুলোর বন্ধ করা পোর্ট একে যেকোন আক্রমণ থেকে রক্ষিত একটি দূর্গে পরিণত করে। টাকা দিয়ে উইন্ডোজ কিনে বা অনিরাপদ পাইরেটেড উইন্ডোজ চালিয়ে, বিশাল অংকের অর্থ ঢেলে ম্যাকওএসসংবলিত যন্ত্র কেনার চেয়ে লিনাক্স ডিস্ট্রোগুলো সবসময়ই ভাল একটি পছন্দ ছিলো।
ভাইরাসাক্রান্ত পাইরেটেড উইন্ডোজ
সফটওয়্যার হোক মুক্ত, এমন ধারণা থেকেই জন্ম নেয়া গ্নু/লিনাক্সই প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ। পুরো প্রযুক্তিজগতে রাজ করে, পিসিতেও আসছে লিনাক্স।