অ্যাপল বিলাসিতার প্রতীক। তাদের পণ্যগুলো প্রযুক্তি পণ্যের বুর্জোয়া শ্রেণি। কর ফাঁকি দিয়ে, একচ্ছত্র বাজারে স্বৈরাচারী রাজত্ব করে আর চিনের শ্রমিকদের উপর জুলুম করে ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানি আজ অ্যাপল। স্টিভ জবস আর স্টিভ ওজনিয়াকের ১৯৭৬ সালে চালু করা ছোট একটি উদ্যোগ কীভাবে এ ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে পরিণত হলো, স্টিভ জবস নামে ওজনিয়াকের সে প্রতারক বন্ধু কীভাবে প্রতারণা করে ওজনিয়াককে ইতিহাস থেকে মুছে শত তরুণের আইডলে পরিণত হলো, তা বুঝতে গেলে বুঝতে হবে অ্যাপলের সাফল্যের গোপন কথা, বিপণন ব্যবস্থা — মার্কেটিং স্ট্র্যাট্যাজি।
১৯৮৫ সালে জবস অ্যাপল ছাড়ার পর, অ্যাপলের কপালের দুর্ভাগ্যরেখা নজরে আসতে থাকে। উইন্ডোজচালিত কমমূল্যের পিসিতে তখন বাজার সয়লাব। এমন এক বাজারে অ্যাপল দূর্বল কৌশল নিয়ে ধোপে টিকেনি। জবসকে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হলো তারা। ১৯৯৬ সালে জবস ফিরেই, অলাভজনক সমস্ত পণ্য বাদ দিয়ে ঢেলে সাজালো পণ্যব্যবস্থা, যার মূলে ছিলো সিম্পলিসিটি আর প্রিমিয়াম এক্সপেরিয়েন্স। উদাহরণস্বরূপ, গুগলের গুগল প্লে মিউজিক, আবার ইউটিউব মিউজিক প্রায় একইধরণের দুটো পণ্য। ইউটিউব রেড আবার গুগল মুভিজ, গুগল হ্যাঙাউট আবার গুগল এলো, আবার গুগল ডুয়ো... গুগলের সংশয়ী এত পণ্য ব্যবহারকারীকে বিমুখই করে। যেখানে অ্যাপলের গুছানো ও সংযুক্ত পণ্যব্যবস্থা ব্যবহারকারীকে আগ্রহী করে তুলে।
নতুন কিছু আবিষ্কারের ধারে না ধারলেও, আবিষ্কৃত জিনিসকে নতুন করে উপস্থাপনে জবসের জুড়ি মেলা ভার। আইপড থেকে শুরু করে আইফোন পর্যন্ত যার প্রমাণ মেলে। অ্যাপলের সে ঐতিহ্য তারা ধরে রেখেছে এখনও। নচ আইফোন ১০-এর আগেও ছিলো। এসেনয়াশিয়াল ফোনের ছোট নচটা বেশ নজরকাড়া ছিলো। কিন্তু ভোক্তা টানেনি। আইফোন ১০-এর নচওয়ালা ডিজাইনের এমন জনপ্রিয়তার পেছনে কারণ, তাদের যৌক্তিক ও সহজ ব্যবহারযোগ্য প্রয়োগ। এখানে অবশ্য তাদের ব্র্যান্ড ভ্যালুও কাজ করেছে। তার সাথে আসে আবার তাদের সফটওয়্যার ডিজাইনও। তাদের অপারেটিং সিস্টেমগুলো, আইওএস, ম্যাকওএস, ওয়াচওএস, টিভিওএসে যে আইক্যাচি ফ্ল্যাট ডিজাইন ব্যবহার করা হয়, তার সহজবোধ্যতা ও সহজ ডিজাইন, অপ্রয়োজনীয় ফিচার বাদ দেওয়াটাও তাদের নিজস্ব একটা উপস্থাপন।
অ্যাপলের সিম্পলিসিটির একটি উদাহরণ হচ্ছে, তাদের আইফোন আর আইপ্যাড। অ্যানড্রয়েড যখন ট্যাবলেটের জন্যে ভিন্ন কোন সুবিধা বা ব্যবস্থা নেই, অ্যাপল আইপড ও আইফোনকে বেশ কিছু দিক দিয়ে ভিন্ন করে রেখেছে। ফিচারের এ ভিন্নতা, আইফোনে যেমন আইপডের ফিচার যোগ করে, বেশি ফিচারে বাজে এক্সপেরিয়েন্স না দিয়ে, তেমনি সবসময় আইপ্যাড কেনার সুযোগ করে দিয়েছে ক্রেতাকে।
আইপ্যাড কেনার কথায়, আসে তাদের ইকোসিস্টেমের কথা। অ্যাপলের ইকোসিস্টেমকে বলা হয়, এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় ইকোসিস্টেম, ইগলসের বলা সে হোটেল ক্যালিফোর্নিয়ার, য়্যু ক্যান চেক আউট এনিটাইম, বাট য়্যু ক্যান নেভার লিভ ঘরানার এক জেলখানা। অ্যাপলের ইকোসিস্টেমের মূল অস্ত্র তাদের আইপড। ২০০৭ সালে আইফোন রিলিজ হওয়ার পর, আইপড ব্যবহারকারীরা আইফোন কেনাটাকে আরও অনেক বেশি সুবিধাজনক ভাবতে লাগলো। অন্তত অ্যাপল তা ভাবালো। একই অ্যাপল আইডি থেকে ম্যাকবুক, আইপ্যাড, আইফোনে ক্রমাগত সিনক্রোনাইজেশন এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা দেয় ব্যবহারকারীকে। আইফোনের কল ম্যাকবুকে রিসিভ করা, ম্যাকবুকের ব্রাউজারে খোলা লিংক আইপ্যাডের ব্রাউজারে দেখা, আইপ্যাডে আসা আইম্যাসেজের উত্তর ম্যাকবুকে দেয়ার বিষয়গুলো আপাতদৃষ্টিতে অপ্রয়োজনীয় মনে হলেও এটি ব্যবহারকারীকে এমন এক অভিজ্ঞতা দেয়, যার জন্যে তারা অন্য কিছুর কথা ভাবতেই পারে না। তার সাথে যুক্ত হয় অ্যাপল টিভি, অ্যাপল ওয়াচ, অ্যায়ারপড । প্রতিটা যন্ত্রে ব্যবহার করা ইউজার ইন্টারফেসে এপলের নিজস্ব ফ্ল্যাট ডিজাইন সবগুলো সহজীয় ও অসাধারণ এক অনুভূতি দেয়।
এতসব কিছুর পরেও, ভাবতে পারেন, ঠিক আছে। কিন্তু এত বেশি দাম... এগুলোর জন্যেই এত দাম? না, আসলে এ বিশাল মূল্য অ্যাপল লাগিয়ে দেয় আমাদের শৌখিনতা আর জাহিরি মানসিকতাকে কাজে লাগিয়ে কিছু ব্যবসা করে নেয়ার জন্যে। অনন্য অভিজ্ঞতা, ভাল প্রোডাক্ট ডিজাইন, ওয়ান-ইন-অল অনুভূতির সাথে এ বিশাল মূল্যও অ্যাপলের আজকের অ্যাপল হওয়ার পেছনে বিশাল ভূমিকা রেখে এসেছে। বাঘের চামড়ায় বানানো বিচানা, হাতির দাতে বানানো শোকেসের মত, আজকের ধনী হওয়ার জন্যে কাছে একটি অ্যাপলের পণ্যও রাখা লাগে। ধনীর সংখ্যা যত বাড়ছে, তাই অ্যাপলের বিস্তার তত হচ্ছে।
অ্যাপল ভার্সেস মাইক্রোসফট, ম্যাকবুক ভার্সেস পিসি, আইওএস ভার্সে অ্যানড্রয়েড এমন তর্কে অনলাইন ফোরামগুলো সয়লাব, প্রযুক্তি ভিত্তিক ওয়েবসাইটে এ শিরোনামে শত শত লেখা লিখা হয়, “আঙুর ফল টক” ঘরানার মন্তব্য আসে। এসব কিছু এড়িয়ে গেলে, ভোক্তার ব্যক্তিগত পছন্দের উপরই তারা পণ্য ক্রয় করবে। আর বিশাল অংকের লয়্যাল ভোক্তা সহযোগে এপলের এ রাজত্ব অতিশিঘ্রই শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে না।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৩:১৯