১.
১৯৮৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টায় তার এখনকার আবক্ষ মূর্তির সামনের গাছটির পাশেই গুলিবিদ্ধ হন রাউফুন বসুনিয়া। ঢলে পড়েন রাস্তায়। মোজাম্মেল বাবু লিখলেন,
"তোমার মৃত্যুতে পৃথিবীর তিনভাগ জল অশ্রু হয়ে গেছে,
রাজপথ হয়েছে আজ সাহসী মিছিল।"
মিছিলে মিছিলে উত্তাপ আনলো নতুন স্লোগান, নতুন সাহস, রাউফুন বসুনিয়া চেতনায় প্রজ্জ্বলিত সাহস। ক্ষয়ে যাওয়া মূর্তির মত স্মৃতিতেও ম্লান হয়ে যাওয়া এ রাউফুন বসুনিয়া এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অন্য অনেক ভুলে যাওয়া শহীদদের একজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র রাউফুন বসুনীয়ার জন্ম কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামে। মা ফিরোজা বেগম গৃহিণী ও বাবা নজরুল ইসলাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি পাঙ্গারানী লক্ষীপ্রিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও কারমাইকেল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে ডাকসুর তৎকালীন ভিপি জিএস মাহমুদুর রহমান মান্নার সহায়তায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। উঠেন সূর্যসেন হলে।
রাউফুন বসুনিয়া ছিলেন বাকশাল সমর্থিত জাতীয় ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক। ছাত্রলীগের তৎকালীন দলীয় কোন্দলের জন্যে আবদুর রাজ্জাক ও অন্যান্য কয়েকজনকে দায়ী করা হয়। এ ঘটনার সূত্র ধরে ১৯৮৩ সালে আবদুর রাজ্জাক দলত্যাগ করে আবারও বাকশাল গঠন করেন। তার এ নতুন বাকশালের ছাত্রসংগঠন ছিলো জাতীয় ছাত্রলীগ। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে এ ছাত্রসংগঠনের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে।
২.
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের সরকারকে হটিয়ে সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ লেফটেনেন্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। দেশে দ্বিতীয়বার জারি হয় সামরিক শাসন। ছাত্ররা এ শাসন মেনে নেয়নি। ১৯৮২ সালে মজিদ খান শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রথমে ১৫ ও পরে ৪টিসহ মোট ১৯টি সংগঠন ১০ দফা দাবি নিয়ে মাঠে নামে। ১৯৮৪ সালের ১৩ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশের সাথে ব্যাপক সংঘর্ষ হয় ছাত্রছাত্রীদের। শতাধিক আহত হয়, নিহত হয় ৫জন—জয়নাল, কাঞ্চন, মোজাম্মেল, জাফর, দীপালি; স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রথম পাঁচ শহীদ। পরবর্তী বছরগুলোতে এ লাশের সংখ্যা শুধু বেড়েছে, যদিও তাদের কারোর নামই বেঈমান বাঙালি আর মনে রাখেনি।
পুলিশ বাহিনী দিয়ে যখন ছাত্রসমাজকে দমন করা যাচ্ছিলো না, কাটা দিয়ে কাটা তোলার পরিকল্পনা নেন এরশাদ। গঠন করেন তার পেটোয়া ছাত্র বাহিনী "নতুন বাংলা ছাত্রসমাজ" (এনএসএফ)। পাশের পুলিশ ফাঁড়ি আর অস্ত্রের জোরে বেশ কিছু হল দখলও করে নেয় তারা। যার মধ্যে ছিলো পুলিশ ফাঁড়ি সংলগ্ন এএফ রহমান হলও। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছিলো কীভাবে এসব গুণ্ডাবাহিনীকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করা যায়। তারই ধারাবাহিকতায় সেদিন রাতে সূর্যসেন হলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিটিং হয়। পরদিন এরশাদের উপজেলা নির্বাচনে বাধা প্রদানের জন্য বটতলায় সবাই জমায়েত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে রাত এগারোটায় সূর্যসেন হল থেকে মিছিল বেরোই।
মিছিল হাজী মুহাম্মদ মুহসিন হলের গেট পেরিয়ে সার্জেন্ট জহুরুল হক ও এএফ রহমান হলের(আহমেদ ফজলুর রহমান হল) মাঝের রাস্তায় উঠতেই এনএসএফের দখলে থাকা এএফ রহমানের ওদিক থেকে কেউ একজন গুলি করে। লক্ষ্য ছিলো পরিচিতমুখ রাউফুন বসুনিয়া। রাস্তায় ঢলে পড়েন পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চির অটল ব্যক্তিত্বের এ মহান ছাত্রনেতা। ছাত্রলীগের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্যাগের বিশাল তালিকায় যোগ হয় নতুন নাম — রাউফুন বসুনিয়া।
৩.
বসুনিয়া হত্যার পর, আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে। নির্বাচন স্থগিত করতে বাধ্য হয় এরশাদ।
পাইকপাড়া গ্রামে তার পারিবারিক কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয় এ বীরকে। তার স্মরণে তার হত্যার স্থানে নির্মিত হয় বসুনিয়া তোরণ। তোরণে লেখা বাবুর কবিতার পঙক্তিমালা স্মরণ করিয়ে দেয় রাউফুন বসুনিয়ার মহান আত্মত্যাগকে —
"তোমার মৃত্যুতে পৃথিবীর তিনভাগ জল অশ্রু হয়ে গেছে,
রাজপথ হয়েছে আজ সাহসী মিছিল।"
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:৩৮