somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাকী বিল্লাহ-এর নেহাতই আধুনিক ও অন্যান্য গল্প। প্রথমে মুগ্ধতা

০৮ ই মে, ২০০৯ ভোর ৪:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.
ঘটনা দুটোর মধ্যে একটা হতে পারে। প্রথম হাইপোথিসিস হতে পারে যে আমি অনেকদিন বাংলা বই পড়ি নাই, বিশেষ করে ফিকশন তাই বাকীর বই পড়তে শুরু করে আমি বিষমভাবে মুদ্ধতায় আক্রান্ত। ওইযে অনেকদিন কোন বিশেষ একটা খাবার না খেয়ে অনেক দিন পরে যুতসই ক্ষুধা পেটে সেটা খেলে যেরম আহাউহু মুদ্ধতা হয় সেই রকম অনেকটা। সেক্ষেত্রে খাবারটা বাড়াবাড়ি রকমের ভালো না হলেও তৃপ্তিটা বেজায় হয়। বাকীর বইটার লেখা হয়তো ততটা ভালো না, আমার খিদে ছিলো মারাত্নক। তাই পড়ে পাতায় পাতায় মুগ্ধতা।

এছাড়া অন্য হাইপোথিসিসটা হলো বাকী বিল্লাহ আসলেই এক ছুপা রুস্তম লেখক এবং সাহস করে বলেও ফেলতে পারি এই সময়ের অন্যতম ছুপা রুস্তম।

পাঠক আপনাদের দুটো হাইপোথিসিসের কোনটাই বেমক্কা বিশ্বাস করার দরকার নেই (অন্ধ বিশ্বাস সবসময়েই স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর) তবে এর মাঝামাঝি একটা অবস্থানে আপাতত নিজেকে আটকে নিন।

২.
সকালে শাহবাগে ৬ নম্বর বাসে উঠেই সিট পেয়ে বাকী বিল্লাহর বইটা বের করে পাতা উল্টে অগোছালোভাবে একটা পাতা খুলে পড়া শুরু করে দিলাম। অনেকদিন ননফিকশন পড়তে পড়তে এই বাজে অভ্যাসটা হয়ে গেছে। ঢুস করে বইয়ের মধ্য থেকে পড়ার বেয়াদবী। এইক্ষেত্রে বার্কীর গল্পগুলো প্রতিটাই এতটা ইন্টারেস্টিং যায়গার মধ্য দিয়ে যায় আমাকে ট্রেস করে করে প্রথমে চলে আসতে বাধ্য হতে হয়েছে।

রাস্তায় জ্যাম ছিলো মাশাল্লা, তারসাথে দ্রুত পড়ার অভ্যাসে প্রায় পুরো বইটাই শেষ করা গেছে এক অফিস যাত্রার শুরুতেই (একটা গল্প বাদ দিয়ে যেটা পড়ার আগেই বাস থেকে নেমে যেতে হয়েছে, প্লাস আমার পাসের সিটে ছিলেন এক খুব ইন্টারেস্টিং ফকির। তার কথায় জড়তা সত্ত্বেও তার সাথে টুকটাক কথাও বেশ কিছু সময় খেয়ে নিলো। বাসে করে ফকির তার ভিক্ষার গন্তব্যে যাচ্ছে আর আমি যাচ্ছি আমার খ্যাপ মারতে, প‌্যারালাল ঘটনা হলেও ফকিরটা বেশ ইন্টারেস্টিং আর মায়াকাড়া মানুষ ছিলো)।

যাই হোক, বাকীর বইয়ের অনেকগুলো গল্পই হঠাৎ হঠাৎ যা খুশি পাতা খুলে যা খুশি জায়গা থেকে পড়তে গিয়ে (বাকী ক্ষমা করিও এই বদভ্যাসের জন্য) শুধু আগ্রহই তৈরীই করেনি, আহাউহু টাইপ মুদ্ধতা তৈরী করেছে ভিতরে।

৩.
বাকী বিল্লাহর লেখার মধ্যে একটা ব্যক্তিগত ব্যাপারটা আছে যা প্রথমেই মন টেনেছে। আগেই বলেছি আমার অনেকদিন বাংলা ফিকশন পড়া হয় নাই, সুতরাং আজকালের লেখকদের লেখার সাথে আমার সখ্যতা কম। কিন্তু তাতে বাকীর লেখার ভালোলাগার সম্পর্ক নেই বললেই চলে।

বাকী চমৎকার সুরিয়্যালিজম আনতে পারে যা আমাকে গল্পগুলোর ফরম্যাটের রীতিমতো ফ্যান করেছে। পরাবাস্তবতার ব্যাপারটাও জোস। অন্যদিকে সমাজের খুব নিবীড়, ভিতরের কতগুলো দিক বাকী তুলে আনে তার গল্পের মালমসলা হিসেবে যা সব লেখক এত স্মার্টভাবে তুলে আনতে বহুত কাঠখড় পোড়াতে হয়। সাহসী লেখক খুব বেশী দেখা যায় না। ছুপা রুস্তম বাকীর সেই সাহসটা আছে। বিশেষ করে গল্পের ফরম্যাট আর বিষয় নির্বাচনের এক্সমেরিমেন্টটা দারুন।

এক্সপেরিমেন্টের জন্য বাহবা।

৪.
বইটাতে মোট ৯টা গল্প আছে।

কোনটাতে তীব্র শ্লেষ, কোনটাতে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মেশামেশি, রাজনৈতিক দর্শনকে নিয়ে ব্যাঙ্গ, বিভিন্ন সমাজবন্ধ মানুষের স্বপ্নভঙ্গ, কোনটাতে মানুষের অসহায়ত্ব নিয়ে দু:খ মিশানো হাসি - এই নিয়েই বাকী বিল্লাহর নেহাতই আধুনিক ও অন্যান্য গল্প বইটা।

প্রায় সবগুলো গল্পতে বাকী নিজেই খলনায়ক অথবা গল্পের একেবারে প্রথম পুরুষের ন্যারেটর। যেভাবে অনেক সময়ে খবর পরিবেশনের ঢংয়ে বাকী তার গল্প শুরু করে তাতে পাঠক যেন অনেকটা সিরিয়াস হয়ে যায় শুরুতেই, তারপরেই বাকী শুরু করে তার চমকগুলো। রিয়েলিজমকে কখন সুরিয়ালিজমে বাকী মিশিয়ে ফেলবে সেই মিশ্রনের জায়গাটা আমার খুব মজা লেগেছে। লেখক হিসেবে সেটা বাকীর কৃতিত্ব্।

৫.
বইটা সবার ভালো লাগার কথা না। একেবারেই নিশ্চিতভাবেই এটা বলা যায়। এর স্বাদ আর মেটাফোর, এর সুরিয়ালিজম অথবা র-নেস অনেকের ভালো না লাগারই কথা। সব জামা সবার গায়ে বসানো ঠিক না, তাই আশা করাও ঠিক না যে একই মুদ্ধতা সবাইকে ছুয়ে যাবে।

আমার ভালো লাগার অন্যতম একটা কারন এক্সপেরিমেন্টাল ফরম্যাট, পরাবাস্তববতা এবং অবশ্যই অন্যরকম একটা চমক তৈরী করা। এই চমকের জায়গাটায় বাকী রীতিমতো শিল্পী। ভাষার ব্যাবহারে বাকীর কাজ অনেকটা সালভাদর দালির সুরিয়ালিস্ট চিত্রকর্মের মতো। দর্শকের মাথা যা এক্সপেক্ট করে, যেভাবে করে দুম করে ক্যানভাস জুড়ে তার বীপরীত রিয়েলিটি তৈরী করতে দালির জুড়ি ছিলো না।

৬.
বাকীর গল্পের নমুনা:

একটি বানানো সত্যি গল্প এভাবে শুরু হয়েছে:
"হঠাৎ করে মরে যাওয়া, মরণ পরবর্তীকালে মালুম করতে না পারা কখন মরলাম, কীভাবে মরলাম এবং সর্বোপরী একটি আস্ত পরকালের সামনে পড়া - এই পুরো ঘটনাচক্র একজন মার্কসবাদী তরুণের জন্য নি:সন্দেহে হতাশাজনক। ঘটনার সূচনালগ্নে অনুভূত হচ্ছিলো একটি তীব্র গোলকধাধা যেখানে একই সাথে অসীম পরিমাণ অন্ধকার এবং দুর্বোধ্যতা বিরাজমান ছিলো। ..."

৭.
"গল্পটি টলস্টয় লিখেছিলেন" একটা চমৎকার প্লট। খুব সম্ভবত আমার সবচে প্রিয়। এটাতেও সুরিয়্যালিজম (নাকি পরাবাস্তবতা, নাকি উত্তর আধুনিকতা - বিশেষন যেটাই হোক) এর একটা মজা আছে। এর প্রধান চরিত্র গামেন্টস মালিক মোয়াজ্জেম তরফদার তারই গামেন্টসের এক ২৪ বছর বয়সী তরুনীর দেহে নিজেকে আবিস্কার করে। যাকে খুন করা হবে খুনী নিজেকে তার দেহে বন্দী আবিস্কার করা অভিজ্ঞতাটা খুব সুখকর নয় বলাই বাহু্ল এবং লেখক পুরো কাহিনীটা রস করেই তৈরী করেছেন। খুব ভালো লেখার কাজ এবং গতি।

গল্পের একটা জায়গা এরকম:
"ডিক্লাসিফিকেশন অব সেক্সুয়ালিটি বলে একটা ধারনা তরফদারের বন্ধু মহলে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সম্প্রতি। .. ধারনাটিকে একটা সমস্যা বা লক্ষন বলে চিহ্নিত করা যায়। ঘরের সুন্দরী বউ বা উচ্চমূল্যে কেনা উচ্চ শ্রেনীর নারী (কলগার্ল) মোটা দাগে নিজেদের শ্রেনীতে যৌনচর্চায় চরম অনীহা এ লক্ষনের প্রথম ধাপ। লক্ষনের দ্বিতীয় ধাপের একটি সাধারন বৈশিস্ট সবার ক্ষেত্র অভিন্ন হচ্ছে - অপুষ্টিজনিত রোগাপটকা গামেন্টসের মেয়েগুলোর প্রতি আগ্রহ। ভালা করে খেতে না পেয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মেয়েটি, যার হাত পা গুলি লম্বা লম্বা কাঠির মতো, খালি পায়ে নির্জীব হাটার সময় পেছন থেকে যাকে কোনমতেই যুবতী নারী হিসেবে সনাক্ত করা যায় না - এরকম একটি মেয়েই হয়ে উঠছে যৌন উত্তেজনার আধার। বাংলায় একে কী বলা যায়? শ্রেণীচু্ত যৌন প্রেষণা?"

... বাকীর গল্পে এরকম মজার কমেন্টারী প্রচুর পাওয়া যায় যা গল্প পড়ার জায়গা ছাড়াও লেখকের মাথায় ঢুকতে খুবই সাহায্য করে। অনেকটা জায়গার বাকীর নিজস্ব রাজনৈতিক সচেতনতা এবং তা থেকে বেরিয়া আশা শ্লেষ ধরা যায় স্পষ্ট ভাবে। বাকী বিল্লাহ লেখক স্বত্বার বাইরেও যে একজন ভাবিয়ে (ভাবেন ও ভাবান) তাতে সন্দেহ থাকেনা।

এ সব মিলিয়েই বাকী বিল্লাহর বইখানা "নেহাতই আধুনিক ও অন্যান্য গল্প" এর প্রথম মুদ্ধতা। বইটা মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত। ২০০৯ এর ফ্রেব্রুয়ারীতে।


* লেখক বাকী বিল্লাহর প্রতি নোট: কৌশিকের ব্যক্তিগত কপি লইয়া রিভিউ করলাম। আমার জন্য একখান অটোগ্রাফ সহ কপি রাখিয়েন। কিনিয়া লইব, সংগ্রহে রাখার আগ্রহ। কসম ভালো লাগছে, শক্তিশালী লেখা। বাড়তি যেটা মনে হলো তা হচ্ছে আপনার লেখা খুব ভালো নাটক হইতে পারে। আমি আলাপ করবো এক নাটক বানিয়ের সাথে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০০৯ রাত ১১:২৫
১০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×