এক.
যেই মানুষ ভাবলো বৃষ্টি হ। আন্তরিকভাবেই ভাবল বৃষ্টি হ, তাতে বৃষ্টি হতে বাধ্য। এমনকি শালিক পাখিও যদি ভাবে বৃষ্টি হ, তাতে বৃষ্টি হতে বাধ্য। এমনকি পিঁপড়েও যদি ভাবে বৃষ্টি হ, তাহলেও বৃষ্টি হতে বাধ্য।
- বিনয় মজুমদার
আসলেই, বৃষ্টি হতে বাধ্য। না আকাশ ভেঙ্গে, মেঘের দেশ থেকে নেমে আসা পানির ফোটার বৃষ্টি না, অন্যরকম বৃষ্টির কথা বলা হোক। বৃষ্টিটা প্রতীকি। প্রতীকে এমন এক বৃষ্টির কথা হোক যে বৃষ্টি ছুয়ে গেলে, চুইয়ে গেলে জন্ম হয় অন্যরকম এক সবুজের, জন্ম হয় অন্য এক সতেজতার। বিনয় মজুমদারের এই কবিতা গদ্যে ’আন্তরিক’ শব্দটাই সবচে শক্তিশালী। মানুষ যখন আন্তরিকভাবে ভাবে কোন কিছু - (আর ভাবনার আরেক নামই স্বপ্ন , কেউ বলে দিবাস্বপ্ন) মানুষ যখন আন্তরিকভাবে স্বপ্ন দেখে কোন কিছুর, আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে তার স্বপ্নে তাহলে নেমে আসতে বাধ্য বৃষ্টি। স্বপ্ন ও আকাংখা তখন রূপ নেয় করে সত্যিকারের করে দেখানো কাজে।
দুই.
কথা হচ্ছিলো কয়েকজন সমমনা বন্ধুর সাথে, বিষয় স্বপ্নময় কাজের রূপায়ন এবং সেইরকম কাজের পেছনে সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে। প্রত্যেকের সাধ্য হয়তো অল্প কিন্তু মিলিতভাবে সেই সাধ্যটা অনেক বড় রূপ নিতে পারে। আন্তরিকভাবে স্বপ্ন দেখে সেই স্বপ্ন রূপ দেওয়ার মানুষগুলো আমাদের সমাজে খুব একটা দেখা যায় না। তাই খুঁজতে হয়, আর খুঁজে পাওয়ার পরে হারিয়ে যেতে দিতে নেই হেলাফেলায়। তার অংশ হতে হয়।
আমরা কেউ কেউ কখনো কখনো খুঁজি এরকম আন্তরিক স্বপ্নময় কাজ ও সেই কাজের রূপকার কাউকে। উদ্দেশ্য থাকে প্রথম কাজটা সম্পর্কে জানা, অন্যকে জানানো এবং সাধ্যমতো কিছুটা সাহায্য করা। সেই সুত্রেই জানা হলো রুবেলের উদ্যোগে গড়ে ওঠা ’আমাদের পাঠশালা’ স্কুলটার কথা। এই জানাজানির পেছনে সামহোয়্যার ইনের অনেকের সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা। পরে কথাও হলো রুবেলের সাথে।
বিনয় মজুমদার যে আন্তরিকভাবে ভাবার কথা উল্লেখ করেছেন, রুবেলের উদ্যোগে তৈরী এই আমাদের পাঠশালা সেইরকম এক আন্তরিকভাবে ভাবা, আন্তরিকভাবে স্বপ্ন দেখা ও সেই স্বপ্নকে করে দেখানোর চমৎকার এক মডেল।
তিন.
রুবেলের পাঠশালা সম্পর্কে লিখতে গেলে অনেক কিছুই লেখা যায়। পাঠশালার প্রকাশিত প্রকাশনা প্রাণের হাটের ভূমিকা থেকে উদ্ধৃত করছি কিছু দরকারী কথা: ”আমাদের পাঠশালা বঞ্চিত শিশুদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তবে বঞ্চিত শিশুদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বললেই যে মলিন, ছিন্ন ভাব আমাদের মনের মধ্যে জাগে আমাদের পাঠশালা ঠিক সেরকম নয়। একটু অন্যরকম। বিকল্প বলতে ভয় হয়, বিকল্পের নামে প্রকল্প বাগানোর এতো আয়োজন চারিদিকে যে খানিকটা লজ্জাও লাগে। আর বিকল্পের নামেতো সেই এক গৎবাধা পুরানো জিনিস চলছে মোড়ক বদলিয়ে বদলিয়ে।
বঞ্চিত শিশুদের জন্য মানসম্মত মানবিক শিক্ষা’র স্লোগান নিয়ে ২০০৮ এর জানুয়ারী থেকে যাত্রা শুরু করে আমাদের পাঠশালা। যেখানে আধিপত্যকারী ধারণা হলো গরিবের জন্য গরিবী শিক্ষা, সেখানে পাঠশালা সবসময়েই সম্ভব সবচে ভালো শিক্ষার লক্ষ্যে কাজ করছে।”
অন্য আর একশটা স্কুল থেকে আমাদের পাঠশালার পার্থক্য অনেক। না স্কুল বিল্ডিংয়ের দেয়াল, চেয়ারটেবিল অথবা ছাদ দেখে সেই পার্থক্যটা বোঝা যাবে না। যেমনটা আগেই বলা হলো যে আমাদের পাঠশালার প্রচেষ্টার প্রধান হাইলাইট হলো বঞ্চিত শিশুদের জন্য সবচে ভালো শিক্ষার নিশ্চয়তা, প্রচেষ্টা। অর্থাৎ বড়লোকের জন্য বড়লোকি শিক্ষা আর গরীবের জন্য গরীবি শিক্ষা; বড়লোকের ছেলে মেয়েদের হাতে চকমকে বই আর গরীবের ছেলেমেয়ের হাতে ছেড়া বই, ছেড়া খাতা, ভাঙ্গা পেন্সিল এই বৈষম্যের জায়গাটাকে চ্যালেঞ্জ করতেই আমাদের পাঠশালা। শুধু তাই নয় পুরো শিক্ষাদানের দর্শন অনেক আলাদা এখানে। এটা এমন এক ইস্কুল যেখানে কোন হোমওয়ার্ক নেই, যেখানে ছেলেমেয়েরা ছুটির বদলে উল্টো স্কুলে আসতে চায়, বলে ’ছুটি ভালো লাগে না স্যার’ - এটা এমন এক স্কুল যেখানে সবার জন্য পুরুস্কার থাকে; যেখানের ছাত্ররা বলে ’এই ইশকুলটায় যাইতে খুব ইচ্ছা হয়।’
চার.
কিভাবে গড়ে উঠলো আমাদের পাঠশালা? পেছনের গল্পটা কি? কিভাবে এটা চলে, কারা চালায়? কে পড়ায়, কি পড়ায়? কেমন দেখতে আমাদের পাঠশালা? বঞ্চিত শিশুরা কেমন দেখতে, ওরা কি আসলেই পড়াশুনা করে নাকি এটা স্কুলের নামে ধান্দাবাজী? পাঠশালা গড়ে তোলা, প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহ এটাকে চালাতে যে পরিমান শ্রম আর ধৈর্য্য লাগে সেই শ্রম আর ধৈর্য্য যারা ধারন করে তাদের চেহারাটা কিরকম? যদি ভালো লাগে আমাদের পাঠশালা তবে কি করে আমরাও সাহায্য করতে পারি, হতে পারি এর ভলান্টিয়ার অথবা বান্ধব অথবা মুখপাত্র?
এরকম অনেক প্রশ্ন আর তার উত্তর জানতে আমাদের পাঠশালায় একটা ব্লগীয় আড্ডার আয়োজন করছি আমরা। অনেকদিন নাকি ব্লগবাসীদের বিশুদ্ধ আড্ডা হয় না (ব্লগের মজাটাইতো নেটওয়ার্কিং, চেনা জানা আর অফলাইনের আড্ডা, সেটা না থাকলে এইসব উবু হয়ে কম্পুটার স্ক্রীনে বসে থাকে কোন উজবুক!)। এবার তাই এবং তার সাথে কিছু স্বপ্নের কথা, কিছু আন্তরিক ভাবনার কথা। আসবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বেশ কিছু নেশারু ব্লগার।
এই মুড়ি আর পিয়াজুর (মেনু পাল্টে জেতে পারে) অতিথি হতে আপনাদের নিমন্ত্রন করছে রুবেল এবং তার আমাদের পাঠশালার সকলে, যার মধ্যে আছে সব ছাত্রছাত্রী। দিনক্ষন শনিবার (৯ই মে)। দুপুর ১১টা। (দিনক্ষন পাক্কা, নড়চড় করা যাবে না, যাদের অফিস আছে, অফিস কামাই করেন বুকের পাটা থাকলে, নাইলে উপায় নাই। শনিবারই আমাদের পাঠশালার শেষ দিন, তারপরে গ্রীষ্মের ছুটিতে যাচ্ছে পিচ্চুরা। শুক্রবার ছাত্রছাত্রীদের আসতে বলা যাবে না, কারন বিবিধ)
পাঁচ.
আইলে তো আইলাম, কিন্তু কি হইবো ওইখানে?
আড্ডা, আবার কি? সঙ্গে মুড়ি আর ইয়ে তো থাকবেই।
আর কিছু না হোক মুড়ি আর ইয়ের লোভেই চলে আসুন, সঙ্গে একজন দুইজন বন্ধু বান্ধবীকেও আনুন যার ভিতরে একটা বড় কলিজা আছে, যে স্বপ্ন দেখতে এখনো ভোলেনি, যে ভালো কাজ দেখলে অন্যদিকে উদাস মুখ করে হেটে যায় না - চকচকে চোখে আগ্রহ করে এগিয়ে আছে আর যে হাত বাড়াতে জানে।
ছয়.
কি করে পৌছানো যাবে আমাদের পাঠশালায়?
আমাদের পাঠশালার ঠিকানা হচ্ছে:
বাড়ি ৪০, লাইন (লেন) ২৫, ব্লক ডি, সেকশন ১২ (প্রচলিত নাম সাড়ে এগারো), পল্লবী, মিরপুর। ঢাকা।
ঠিকানা একবারে খুঁজে পাবেন এই ভরসা না করাই ভালো, যদিনা ওদিকটা অনেক পরিচিত থাকে। সাড়ে এগারো, ব্লক ডি কে রেফারেন্স ধরে মানুষকে জিজ্ঞেস করে এগিয়ে এসে লাইন ২৫ বের করে বাড়ির নম্বর খুঁজলে পাবেন আশা করি। না হলে হোস্টকে একটা ফোন দিন। রুবেলের ফোন নাম্বার: ০১৭২১৬২৩৬২৭।
সাত.
আমাদের পাঠশালার যারা অন্তরঙ্গ বন্ধু তাদের দাবী যে আমাদের পাঠশালায় একটা সিন্দুক আছ, সিন্দুক ভারা প্রাণ-আনন্দ-ভালোবাসা-স্বপ্ন। এবং এই সিন্দুকের কোনো তালা নেই।
আমি একটু আড়িপেতে দেখে এসেছি একদিন সেই সিন্দুক। সিন্দুক আসলেই আছে। এবার নিমন্ত্রন রইলো আপনাদের সেই সিন্দুকের দর্শনে।
আট.
না গেলে কি আসে যায়?
নূরুল আলম আতিকের গ্রন্থনায় প্রকাশিত একটা ছোট্ট বই, নাম 'নতুন সিনেমা, সময়ের প্রয়োজন'। সেই বইটার একদম শেষ মলাটে তিনটে লাইন থেকে উত্তরটা দেওয়া যেতে পারে যারা হইতো ভাবছেন, সময় কোথায় এইসব ছাইপাশ স্কুলে যাওয়ার, সময় কোথায় এইসব টুটাফুটা ফকিরনীর বাচ্চাগোর কারবার দেখতে, যেতে পারি কিন্তু আমি কেন যাবো? এই গরমে দুপুর এগারোটা, উফ না একদম না - ইত্যাদি হাজারটা ফালতু বায়ানাক্কা।
তাদের জন্য নুরুল আলম আতিকের সেই বইতে খুব সহজ ভাষায় এভাবে বলা আছে:
প্রথমত: সময় নাই।
দ্বিতীয়ত: এখনই সময়।
তৃতীয়ত: তুমি না থাকলেও ব্যাপারটা ঘটবে, তবু তোমাকেই চাই।
যা বলতে চেয়েছি তার প্রায় সব বলা হয়ে গেছে। যারা আসতে পারবেন আগামী শনিবার তারা একটু আওয়াজ দিয়েন মন্তব্যে বা ইমেইলে। ব্লগীয় দলাদলি থেকে এই আড্ডা মুক্ত। আমরা কাজের মানুষদের আড্ডা চাই, যে আড্ডায় উদ্যোগের জন্ম নেয় সেই আড্ডা চাই, আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করতে চাই, যারা আন্তরিকভাবে কাজ করছে তাদের বলতে চাই 'এই আমার বাড়ানো হাত'। ব্যস। দলাদলি, চুলাচুলি, এ গেলে আমি নাই, অমুকে অন্য পার্টির ইত্যাদি এটিচুড নিয়ে রাজনীতিকরা ব্যস্ত থাকুক (এবং মরুক) । আমরা এবার কাজ করি।
প্রথমত: সময় নাই।
দ্বিতীয়ত: এখনই সময়।
তৃতীয়ত: তুমি না থাকলেও ব্যাপারটা ঘটবে, তবু তোমাকেই চাই।
তোমাকেই চাই।
অনেকদিন পর সামহোয়্যারইনে আসা, সবাইকে নিরন্তর শুভেচ্ছা।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০০৯ রাত ১১:০৮