নেকড়ে
মূল: ভুবনেশ্বর (भूवनेश्वर)
রূপান্তর(হিন্দি থেকে): মোসতাকিম রাহী
প্রশংসা শুনে বুকের ছাতি বড়ো হয়ে গেল আমার। যাক, যা বলছিলাম, নেকড়ের দল কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। কারণ তারা সঙ্গীদের লাশগুলো পেয়ে গিয়েছিলো খাবার হিসেবে।
হঠাৎ করে গরুগুলোর গতি বেড়ে যাওয়ায় বুঝতে পারলাম নেকড়েগুলো আবার কাছে এসে পড়েছে।
দুশো গজের মতো আসার পর বাবা বললেন,‘‘ জিনিসপত্র বের করে ফেলে দে,গাড়ি হালকা কর।’’
বেদেদের মধ্যে আমাদের গাড়িটি ছিলো সবচে’ সেরা। গৃহস্থালি জিনিসপত্র ফেলে দিয়ে গাড়িটি হালকা করার পর আরো দ্রুত ছুটতে শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যে মনে হলো নেকড়ের দল পিছু ফেলে আমরা অনেকদূর চলে এসেছি। কিন্তু একটু পরই সেই ভুল ধারণার অবসান হলো।
বাবা বললেন,‘‘এবারতো মনে হয় একটা গরুই ছেড়ে দিতে হবে,খারু !’’
‘‘কী বলছো, বাবা ?’’ চমকে উঠলাম আমি।‘‘দু’টা গরু কি গাড়িটাকে জোরে টেনে নিয়ে যেতে পারবে ?’’
‘‘তাহলে একটা বাঈজিকে ফেলে দে,’’ নির্বিকার গলায় বললেন বাবা।
চাচা আপন প্রাণ বাঁচা! আমি তিনজনের মধ্যে সবচে’ মোটা মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলাম।
মেয়েটা প্রথমে গাড়ির পিছুপিছু দৌড়ে আসার চেষ্টা করলো কিছুক্ষণ, কিন্তু যখন বুঝতে পারলো দৌড়ে কোনো লাভ নেই,তখন মেয়েটা ঘুরে দাঁড়ালো নেকড়েগুলোকে মোকাবেলা করতে। সামনের একটা নেকড়ের পা ধরে, মাথার উপর উঠিয়ে ছুঁড়ে মারার চেষ্টা করলো, কিন্তু পেছনের নেকড়েগুলো একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার যুদ্ধংদেহী ভাবের অবসান ঘটিয়ে দিলো মুহূর্তে।
ওজন কমে যাওয়ার ফলে গাড়ি আরো জোরে ছুটছে। তবে তাতেও কোনো ফললাভ হচ্ছিলোনা।
‘‘আরেকটা ফ্যাল,’’ বললেন বাবা।
এবার আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো, বললাম,‘‘মানুষের চেয়ে গরু কি বেশি দামি হয়ে গেল ? একটা গরুই না হয় এবার ছেড়ে দাও।’’
ছেড়ে দিলাম একটা গর“। লেজ উঁচিয়ে,হাম্বা-হাম্বা চিৎকার করতে করতে গর“টা মোড় ঘুরে আরেকদিকে ছুটতে শুর“ করলো। নেকড়ের দলও ছুটলো গর“টির পিছুপিছু। বাবা কেঁদে ফেললেন গর“ হারানোর দুঃখে।
কাঁদতে-কাঁদতে বললেন,‘‘বড়ো প্রিয় গর“ ছিলো রে,খার“ !’’
‘‘জীবনের চেয়ে তো আর বেশি প্রিয় নয়,’’ বললাম আমি। ‘‘আমরা তো বেঁচে গেছি।’’
কিš‘ কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার শোনা গেল সেই অমানুষিক গর্জন।
‘‘কেয়ামত মনে হয় আজই হয়ে যাবে !’’ বিড়বিড় করে বললাম।
সর্বশক্তি প্রয়োগ করে গর“গুলো আরো জোরে ছোটানোর চেষ্টা করলাম। লাভ হলো এটুকু, হাতের চামড়া ছিলে গিয়ে রক্ত গড়াতে শুর“ করলো। বেনোজলের মতো নেকড়ের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
‘‘আরেকটা মেয়ে ফেলে দে, খার“,’’ চিৎকার করে বললেন বাবা।‘‘আর কোনো রাস্তা নাই রে ,বাপ!’’
আমি কিছু বলার আগেই, দুজনের মধ্যে মোটা মেয়েটা কাঁপাকাঁপা হাতে রূপার নোলকটা খুলতে শুর“ করলো। তোমাকে হয়তো বলিনি,মেয়েটা আমার বড়ো পছন্দের ছিলো। তাই তাকে বাদ দিয়ে অন্য মেয়েটাকে বললাম,‘‘তুই বেরো !’’
কিš‘ মেয়েটা যেন বেহুঁশ হয়ে গেছে। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার পরও যেভাবে পড়েছিলো সেভাবেই পড়ে রইলো। গাড়ি আরো হালকা হয়ে যাওয়ায় গতি আরো বেড়ে গেল। কিš‘ পাঁচ মিনিটের মধ্যে নেকড়ে আবার আমাদের নাগাল পেয়ে গেল।
বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,‘‘আল্লাহ, এ তোর কেমন বিচার ! অভাব-অনটনের বেদেজীবন শেষ করে ধনী হতে যাচ্ছিলাম,সব শেষ করে দিলি !’’
যে-মেয়েটাকে আমি ফেলি নি, তার দিকে তাকিয়ে বললাম,‘‘ তুই নিজে লাফ দিবি, না আমি ধাক্কা দেবো ?’’
মেয়েটা নাকের নোলকটা খুলে আমার হাতে দিলো, তারপর দু’হাতে চোখ চেপে ধরে লাফ দিলো গাড়ি থেকে।
গাড়ি এখন হাওয়ায় উড়ছে। গর“গুলো ক্লান্তির শেষ পর্যায়ে,কিš‘ তারপরও ছুটছে মরিয়া হয়ে।এখনও অনেকটা পথ যেতে হবে,বস্তি আরো ত্রিশ মাইল দূরে।
আর কোনো উপায় না দেখে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে নেকড়েগুলোর মাথায় মারতে শুর“ করলাম। কিš‘ তাতে কোনো হেরফের হ”িছলো না । বাবাকে দেখলাম ঘেমেনেয়ে একেবারে একাকার হয়ে গেছেন। শেষমেষ বাবা বললেন,‘‘ গর“ আরো একটা খুলে দে,খার“ !’’
‘‘পাগল হয়েছো, বাবা ? সেধে মৃত্যু ডেকে আনার কোনো মানে আছে !’’ চিৎকার করে বললাম আমি। ‘‘ আমাদের একজনকে তো অন্তত বেঁচে থাকতে হবে। একটা গর“ কি গাড়িটাকে টেনে নিয়ে যেতে পারবে ?’’
‘‘ঠিক বলেছিস,’’ বাবা বললেন।‘‘ আমি বুড়ো হয়ে গেছি, ক’দিন আর বাঁচবো, তোর বেঁচে থাকা জর“রি। আমি লাফিয়ে পড়ে কিছুক্ষণ নেকড়েগুলোকে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি।’’
চমকে উঠলাম আমি ! কিš‘ নির্মম সত্যটাকে না মেনে উপায় নেই বলে কথা বাড়িয়ে আর সময় নষ্ট করলাম না।
‘‘মন খারাপ কোরো না ,বাবা,’’ বললাম আমি। ‘‘আমি বেঁচে থাকলে একটা নেকড়েকেও রেহাই দেবো না।’’
‘‘তুই আমার বড়ো আদরের ধন রে, খার“,’’ কান্নাভেজা গলায় আমার দু’গালে চুমু খেতে খেতে বললেন বাবা। তারপর দু’হাতে দুটো বড়ো ছুরি তুলে নিলেন, এবং গলায় ভালো করে কাপড় পেঁচিয়ে নিলেন। লাফ দিতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বাবা বললেন,‘‘দাঁড়া, আমার পায়ের জুতাগুলো একেবারে নতুন, ভেবেছিলাম কমসেকম দশবছর পরবো,’’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললেন,‘‘দেখিস তুই এগুলো আবার পরিস না যেন, মরা মানুষের জুতা পরতে নেই। তুই জুতাজোড়া বেচে দিস কারো কাছে।’’
জুতাজোড়া খুলে গাড়ির ভেতরে ছুঁড়ে মারলেন বাবা। তারপর লাফ দিয়ে পড়লেন গাড়ির পেছন পেছন দৌড়ুতে থাকা নেকড়েগুলোর একেবারে মাঝখানে।
পিছু ফিরে চাইতে মন সায় দিলো না। বাবা লাফ দিয়ে পড়ার সাথে সাথে শুধু তার চিৎকার শুনতে পা”িছলাম : আয় ! আয়, হারামজাদা নেকড়ের বা”চারা ,আয় !
বাবার সাহসিকতায় সেদিন বেঁচে গেলাম। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে, অনেকগুলো নেকড়ে মেরে আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন বাবা।’
এইটুকু বলে খার“ আমার দিকে তাকালো। ভয়ে রক্তশূন্য হয়ে যাওয়া আমার মুখের তাকিয়ে হঠাৎ হো-হো করে হেসে উঠলো সে। খকখক করে কেশে মাটিতে থুথু ফেললো একদলা। তারপর বললো, ‘এর পরের বছর অইপথে যাওয়ার সময় আরো ষাটটা নেকড়ে মেরেছি আমি।’
বলতে বলতে শীতল চোখজোড়া ধক করে জ্বলে উঠলো তার। তারপর হাসতে হাসতে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত,ক্ষুধার্ত,জোড়াতালি দেওয়া কাপড় পরা খার।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০০৮ বিকাল ৫:২৪