মূল: মুনশি প্রেমচাঁদ
রূপান্তর(মূল হিন্দি থেকে): মোসতাকিম রাহী
......
কিন্তু তার এই আশ্বাস বাণী আমি মোটেও বিশ্বাস করতে পারলাম না। সন্দেহের যে-পোকা মনে ঢুকেছে, সেটা শুধু কেটেই চলেছে।
‘আমি আবার বললাম, ‘এটা আমি খুব ভালো করেই জানি যে, তোমার মনে কোনো কলুষতা নেই, কিন্তু লেখাজোকা করে নিলে ক্ষতি কী!’
‘কী দরকার অযথা!’
‘অযথাই না হয় করলাম।’
‘করলে পাকা দলিলই করতে হবে। আর তাতে দশলাখ টাকার হিসেবে কোর্টের ফিস আসবে প্রায় সাড়ে সাত হাজার। কোনো প্রয়োজন আছে এতোগুলো টাকা জলে ফেলার!’
আমি মনে মনে ভাবলাম, শাদা কাগজে লিখে নিলে কেমন হয়? এটা হয়তো ঠিক যে, শাদা কাগজের লেখা দিয়ে আমি আইনের আশ্রয় নিতে পারবো না। কিন্তু সমাজের সামনে, লোকজনের সামনে তাকে ধোঁকাবাজ প্রমাণ করতে,তাকে লজ্জিত করতে তো পারবো। আর লোকনিন্দার ভয় কার নেই! লোকজনের সামনে অপমানিত হওয়ার ভয়, আইনে সাজার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
‘শাদা কাগজে করলেও আমার কোনো আপত্তি নেই, ’বললাম আমি।
বিক্রম হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বললো, ‘যে-কাগজের কোনো আইনি মূল্য নেই, সেটা করে কী লাভ?’
আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে, বিক্রমের মনে শয়তানি আছে। নয়তো একটা শাদা কাগজে লিখতে অসুবিধে কী? রেগে গিয়ে বললাম, ‘তোমার মাথায় এখন থেকেই বদ মতলব ঘুরপাক খাচ্ছে।’
নির্লজ্জের মতো সে বললো,‘ তুমি বলতে চাইছো, এই অবস্থায় তোমার খেয়াল খারাপ হতো না?’
‘মোটেও না, আমি এতো নীচ নয়।’
‘আরে রাখো, কী আমার সজ্জন লোক রে! কতো দেখলাম তোমার মতো ভালো মানুষ!’
‘ এক্ষুনি তোমাকে কাগজে লিখে দিতে হবে। তোমার ওপর আমার আর বিন্দুমাত্র আস্থা নেই।’
‘আমার প্রতি যদি তোমার আস্থা না থাকে তাহলে আমিও কোনো লিখিত কাগজ দেবো না।’
‘আচ্ছা! তো তুমি মনে করেছো আমার টাকা খেয়ে হজম করতে পারবে?’
‘কিসের টাকা তোমার, কেমন টাকা?’
‘দেখো বিক্রম, শুধু বন্ধুত্বই নষ্ট হবে না, তারচেয়েও ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে বলে দিচ্ছি!’
ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠলো আমার ভেতরে।
এমন সময় হঠাৎ করে বৈঠকখানা থেকে ঝগড়ার আওয়াজ ভেসে আসায় আমার মনোযোগ সেদিকে চলে গেলো। সেখানে দুই ঠাকুর সব সময় বসে আড্ডা দেন। তাদের মধ্যে এমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো, যেটা শুধু দুই আদর্শ ভাইয়ের মধ্যে হতে পারে। একেবারে মানিকজোড়, ঠিক যেন রাম-লক্ষ্মণ! ঝগড়া দূরে থাকুক তাদের মধ্যে কখনো সামান্য কথা কাটাকাটি হয়েছে বলেও আমি শুনিনি। বড়ো ঠাকুর যা বলবেন ছোটো ঠাকুর তা মাথা পেতে নেবেন, আর ছোটো ঠাকুরের ইচ্ছে অনিচ্ছের প্রতি সম্মান দেখিয়েই বড়ো ঠাকুর কোনো সিদ্ধান্ত নিতেন। আমরা দুজন খুব অবাক হয়ে গেলাম এই বন্ধুপ্রতিম দুই ভাইয়ের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে বুঝতে পেরে। চুপিচুপি বৈঠকখানার দরোজায় গিয়ে দাঁড়ালাম দু’জন।
দুই ভাই ইতোমধ্যে নিজেদের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। চোখ লাল, হাতজোড়া মুঠি পাকানো, দাঁতমুখ খিঁচিয়ে একজন আরেকজনের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। বোঝা যায় শুধু হাতাহাতিটাই বাকি আছে।
ছোটো ঠাকুর বিক্রমকে দেখতে পেয়ে বললো, ‘যৌথ পরিবারে যা কিছু আসুক, যেখান থেকে আসুক, যার নামেই আসুক না কেন, সেটা সবার নামে সমান ভাগে হিসাব হবে।’
বিক্রমের বাবাও বিক্রমকে দেখতে পেয়েছে। এক কদম সামনে এগিয়ে এসে বিক্রমের বাবা, অর্থাৎ বড়ো ঠাকুর বললেন, ‘মোটেও না, আমি যদি কোনো অপরাধ করি তাহলে পুলিশ আমাকে এসে ধরবে, যৌাথ পরিবারকে নয়। শাস্তি আমি পাবো যৌথ পরিবারের কেউ পাবে না। এটা ব্যক্তিগত হিসাব।’
‘ঠিক আছে, এর ফয়সালা আদালতেই হবে।’
‘যাও, খুশিমনে আদালতে যাও। যদি আমার বউ ছেলে কিংবা আমার নামে লটারি ওঠে তাহলে তাতে তোমার কোনো অংশ থাকবে না। ঠিক তেমনি যদি তোমার নামে লটারি ওঠে তাহলে তাতে আমাদের কারো দাবি থাকবে না।’
‘যদি জানতাম, আপনার মনে কুমতলব আছে তাহলে আমিও আমার বউ-বাচ্চার নামের টিকেট কিনতে পারতাম।’
‘ওটা তোমার বোকামি!’
‘হ্যাঁ, কারণ আপনি আমার বড়ো ভাই, বিশ্বাস করেছিলাম আপনাকে।
‘এটা হচ্ছে একধরনের জুয়াখেলা, তোমার বোঝা উচিৎ। জুয়ার হারজিতের সাথে পরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই, থাকতে পারে না। তুমি যদি কাল রেসের বাজিতে পাঁচ-দশ হাজার টাকা হেরে যাও তোমার পরিবার তো তার জন্যে দায়ী হতে পারে না।’
‘ভাইয়ের হক খেয়ে আপনি সুখী হতে পারবেন না।’
‘শকুনের প্রার্থনায় কি আর গরু মরে ভাই!’
বিক্রমের মা ভেতর থেকে দৌড়ে এলেন দুই ভাইয়ের মধ্যে ঝগড়া লেগেছে শুনে। এসে দু’জনকে বোঝাতে লাগলেন।
ছোটো ঠাকুর রেগেমেগে বললেন,‘আমাকে নয়, তুমি তাঁকে বোঝাও। আমি তো একটা মাত্র টিকেট কিনেছি, তার কোনো ভরসা নেই। উনি চার চারটি টিকেট কিনে বসে আছেন। আমার চেয়ে লটারি পাওয়ার চান্স তাঁর চারগুন বেশি। এরপরও যদি তার খেয়াল খারাপ হয়ে যায়, এরচেয়ে লজ্জার, দুঃখের কথা আর কী হতে পারে!’
ঠাকরুন দেবরকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, ‘ আচ্ছা ঠিক আছে, আমার টাকা থেকে আমি তোমাকে অর্ধেক দিয়ে দেবো। খুশি তো?’
বড়ো ঠাকুর বউয়ের কথা শুনে ধমক দিয়ে উঠলেন, ‘কেন অর্ধেক দেবো, কোন হিসেবে দেবো? আমরা যদি ভালো মানুষি দেখিয়ে দেইও, সে পাবে পাঁচভাগের এক ভাগ। কোন যুক্তিতে তাকে অর্ধেক দেবো শুনি? ধর্মমতে বলো আর আইনমতে বলো।’
ছোটো ঠাকুর মুখ ভেংচে বললেন, ‘হ্যাঁ, দুনিয়ার যাবতীয় আইনতো সব আপনিই জানেন!’
‘নয়তো কী, ত্রিশবছর ধরে ওকালতি করছি!’
‘ওকালতি সব বেরিয়ে যাবে যখন কলকাতার ব্যারিস্টার এনে সামনে দাঁড় করিয়ে দেবো।’
‘কলকাতার হোক আর লন্ডনের, আমি থোড়াই কেয়ার করি।’
‘অর্ধেক ভাগ আমি নেবোই। সম্পত্তিতে যেমন আমার অর্ধেক অংশ আছে লটারিতেও আমার অর্ধেক চায়।’
এমন সময় বিক্রমের বড়ো ভাই প্রকাশ হাতে মাথায় ব্যান্ডেজ, আর দোমড়ানো মোচড়ানো কাপড়চোপড়ে তাজা রক্তের দাগ নিয়ে একেবারে হাসিমুখে এসে আরামকেদারায় ধপাস করে বসে পড়লো। বড়ো ঠাকুর ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, ‘এ কী হয়েছে তোর? চোট পেলি কী করে? কারো সাথে মারপিট করে আসছিস না তো?’
প্রকাশ আরামকেদারায় শোয়া অবস্থায় সামান্য আড়মোড়া ভেঙে বললো,‘জি না, ঘাবড়ানোর কোনো কারণ নেই, আমার কিছু হয় নি, আমি ভালো আছি।’
‘কী বলছিস কিছু হয় নি! মাথা আর হাতে চোট লেগে রক্ত বেরুচ্ছে! ব্যাপারটা কী, রাস্তায় কোনো দুর্ঘটনা হয়নি তো!’
‘একেবারে মামুলি আঘাত, বাবা, দু’-একদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। ভয়ের কিছু নেই।’
প্রকাশের ঠোঁটে মুচকি হাসি। আশ্চর্য শান্ত তার হাবভাব। রাগ কিংবা অপমানের কোনো চিহ্ন তার চেহারায় নেই। প্রতিশোধ নেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার মধ্যে দেখা যাচ্ছিলো না।
বড়ো ঠাকুর অস্থির হয়ে গেলেন তার আচরণে। বললেন,‘কিন্তু কী হয়েছে সেটা বলছিস না কেন? কেউ মারধোর করে থাকলে বল, থানায় গিয়ে রিপোর্ট করে আসি।’
প্রকাশ হালকা মেজাজে বললো, ‘মারপিট কারো সাথে হয় নি, বাবা। তুফান বাবার আস্তানায় গিয়েছিলাম একটু। আপনি তো জানেন, উনি লোকজন দেখলেই পাথর নিয়ে তাড়া করেন। আর ভয় পেয়ে যদি কেউ দৌড় দেয়, তাহলে ঐ বেচারা মরেছে! আর যে ইট-পাটকেল খেয়েও বাবার পিছে লেগে থাকবে, তার কপাল খুলে যাবে। পরশপাথর যে সে পাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আসলে উনি এভাবে লোকজনকে পরীক্ষা করেন।
‘আজ আমি ওখানে গিয়েছিলাম। প্রায় পঞ্চাশজন লোক আজ উপস্থিত ছিলো। কেউ মিষ্টি, কেউ কাপড়, কেউ দামি উপহার নিয়ে গেছে বাবার কৃপাদৃষ্টিলাভের আশায়। তুফান বাবা তখন ধ্যান করছিলেন। চোখ খুলে যখন সমবেত লোকদের দেখতে পেলেন, ব্যস, পাথর নিয়ে দৌড়ে এলেন আমাদের দিকে। শুরু হয়ে গেলো দৌড়ঝাঁপ। যে যেদিকে পারে ছুটে পালালো। মুহূর্তের মধ্যে খালি হয়ে গেলো বাবার আস্তানা। একা আমি দাঁড়িয়ে রইলাম ঝিম মেরে। উনি আমাকে পাথর ছুঁড়ে মারলেন। প্রথমটা এসে লাগলো মাথায়। ওনার নিশানা একেবারে অব্যর্থ। মাথা ফেটে রক্ত পড়তে শুরু করলো। কিন্তু আমি নড়বার পাত্র নই। এরপর উনি দ্বিতীয় পাথরটা মারলেন, হাতে এসে লাগলো ওটা। যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলাম। যখন হুঁশ ফিরে এলো, দেখলাম বাবার আস্তানায় কেউ নেই, একেবারে নীরব হয়ে আছে চারিদিক। তুফান বাবাকেও কোথাও দেখতে পেলাম না। মনে হয় গায়েব হয়ে গেছেন। কাকে ডাকবো? কার কাছে সাহায্য চাইবো? মাথার ক্ষত থেকে তখনো রক্ত গড়াচ্ছে, অসহ্য ব্যথায় মনে হচ্ছে হাত ছিঁড়ে পড়ে যাবে। কোনোমতে হাঁচড়েপাচড়ে উঠে দাঁড়ালাম, সোজা চলে গেলাম ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার দেখে বললেন হাড় ভেঙে গেছে। ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে বললেন, গরম সেঁক দিতে। হাড় ভেঙেছে এটা এমন বড়ো কিছু নয়, লটারির টিকেট যে আমার নামে উঠবে এটা এখন নিশ্চিত। তুফান বাবার মার খেয়েছে কেউ, কিন্তু মনোবাসনা পূরণ হয় নি, এমনটা কখনো হয় নি। আমি লটারি পেয়েই বাবার আস্তানা পাকা করে দেবো।’
বড়ো ঠাকুরের চেহারায় খুশির ছায়া খেলে গেলো। ত্বরিত বিছানা তৈরি হয়ে গেলো বিক্রমের জন্যে। প্রকাশ শুয়ে পড়লো সেই বিছানায়। ঠাকরুন তাড়াতাড়ি বিক্রমকে পাখা করতে লাগলেন। ছেলের সফলতার আশায় তার চেহারায়ও খেলা করছিলো এক অদ্ভুত প্রসন্নতা। সামান্য আঘাত সয়ে দশলাখ টাকা পেয়ে যাওয়া মোটেও সহজ কথা নয়!
খিদের ঠ্যালায় ছোটো ঠাকুরের নাড়িভুঁড়ি হজম হয়ে যাচ্ছিলো। তবু এক পা-ও নড়ছিলেন না তিনি সেখান থেকে। যেই বড়ো ঠাকুর খাওয়ার জন্যে ভেতরে গেলেন আর ঠাকরুন প্রকাশের জন্যে খাবারের ব্যবস্থা করতে গেলেন, অমনি ছোটো ঠাকুর ছুটে এসে প্রকাশকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, তুফান বাবা কি খুব জোরে পাথর মারেন?’
(ক্রমশ...)
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০০৭ রাত ৯:০৮