নিরীশ্বরবাদ বা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করার ধারণা খুবই প্রাচীন।তবে অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে ইউরোপে দর্শন ও বিজ্ঞানের প্রভাবে একদল ধর্মবিরোধী রাজনীতিক শক্তি নিরীশ্বরবাদের রাজনৈতিক ভিত্তি দাঁড় করান।যার নিচে পিষ্ট হয়েছে গীর্জার উৎপীড়ন।যার কারণে অনেকেই বিচার বিশ্লেষণ না করে গ্রহন করে এর ধারণা এবং সে সাথে নেমে পড়েন এর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে।অনেক ঐতিহাসিকের বর্ণণা মতে,জায়নিষ্টরা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে একে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন।ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বলতে হয় তাদের রাজনৈতিক মতবাদ যেমন আস্তাখুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে,আবার যে বিজ্ঞানের হাত ধরে তারা পুষ্ট হয়েছে সে বিজ্ঞানের হাত ধরে নাস্তিকতার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার আয়োজন চলছে।
দর্শনের ক্ষেত্রে,বিশ্বজগত হচ্ছে বস্তুর সমষ্টি এবং এ জগত অনাদিকাল থেকেই অস্তিত্বশীল বস্তুর বাইরে এ জগতে আর কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই-ডিভেরট ও বেরন ডি হোলবাখ এর মতো দার্শনিকদের এ মতবাদের উপর ভিত্তি করে দাঁড়ায় বস্তুবাদ।পরবর্তীতে,মার্কস,এঙ্গেলস,নিৎসে,দুরখেইম,ফ্রয়েড প্রমুখ বিজ্ঞানের নব নব আবিস্কারকে কাজে লাগিয়ে এর দার্শনিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলেন।
নিরীশ্বরবাদের পক্ষে সবচে বড় সমর্থনটি আসে চার্লস ডারউইনের পক্ষ থেকে।তিনি সৃষ্টির ধারণা প্রত্যাখান করেন এবং এর বিপরীতে পেশ করেন বিবর্তন তত্ত্ব।তিনি পেশ করলেন, প্রকৃতিতে এমন একটি মেকানিজম আছে যা জড় পদার্থের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করে,তবে তিনি আল্লাহ নয় তিনি হচ্ছে বিবর্তন।ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে তারা দাবী করলেন,এ জগতের কোন লক্ষ্য নেই;এর চমৎকার শৃঙ্খলা এবং ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশের অস্তিত্বের বিষয়টি স্রেফ একটি ঘটনা চক্র মাত্র(অর্থাৎ এর পেছনে কোন জ্ঞানবান স্রষ্টার হাত নেই)। তাদের এই মতবাদকে তারা এত নিঁখুত চিন্তা করলেন যে, এর মাধ্যমে মার্কস বা দুরখেইম ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানকে এবং ফ্রয়েড মনোবিজ্ঞানকে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছেন।তাদের ধারণা ছিল, বিজ্ঞানের আরো নব নব আবিস্কারের মাধ্যমে তাদের মতবাদ আরো দূঢ় হবে।
কিন্তু বাস্তবে ঘটলো এর উল্টো বিশ্বজগতে এক আর্শ্চয জটিল শৃঙ্খলা আবিস্কার করলো বিজ্ঞান,যা এক অকল্পনীয় বিশাল পরিকল্পনা তথা পরিকল্পনাকারীর প্রতি সুষ্পষ্ট ইঙ্গিত প্রদান করে।মনোবিজ্ঞানীরা ধর্মকে স্নায়ুবিক রোগ মনে করতেন; কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল,ধর্মীয় চেতনা মৌলিক মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।যদিও এখনও কোন বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবিগণ নিরীশ্বরবাদ তত্ত্বকে আকড়ে আছেন কিন্তু অত্যাধুনিক গবেষণা থেকে প্রাপ্ত বাস্তব ও গ্রহনযোগ্য উপাত্তসমূহ একজন সৃষ্টিকর্তা তথা আল্লাহর অস্তিত্বের অনিবার্যতাকেই প্রবলভাবে প্রকাশ করছে।জেরান্ড শ্রোয়েডার এর ’দ্যা হিডেন ফেস অব গড’ গ্রন্থের ওপর লেখা এক পর্যালোচনামূলক নিবন্ধে ব্রাইস ক্রিস্টেনসেন লিখেছেনঃ ”গবেষণাগার থেকে ও বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত তথ্যসমূহ ব্যাখ্যা করতে বস্তুবাদ অক্ষম” । আসুন যেসব ধারণার উপর ভিত্তি করে তারা নিরীশ্বরবাদ দাঁড় করিয়েছেন বিজ্ঞান কিভাবে সেগুলো অপনোদন করছে।
বিশ্বজগত অনাদি ও অনন্ত এ ধারাণার অসারতাঃ
বিগ ব্যাংগ এর তথ্য চিত্র
বিংশ শতাব্দীর নিরীশ্বরবাদের উপর প্রথম আঘাতটি আসে বিজ্ঞানে বিশ্বতত্ত্ব(cosmology)নামক শাখা থেকে।এটি জগতের শুরু নেই,এটি অনাদিকাল থেকে ব্যাপ্ত।বিশ্বজগত যে অনাদি নয়,এক সময় এটি শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছিল -এ-সত্য জানা যায় ’বিগ ব্যাংগ’ তত্ত্বের আবিস্কারের ফলে।১৯২৯ সালে আমেরিকার জ্যোতির্বিদ এডইন হাবল লক্ষ্য করেন যে, বিশ্বজগতের গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে।অর্থাৎ বিশ্বজগত ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে।হাবলের আবিস্কার থেকে তখনই বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন বিশ্বজগত যে একক পয়েন্ট থেকে বা বিন্দু থেকে সৃষ্টি হয়েছে, সেটির মাধ্যাকর্ষণশক্তি ছিল অসীম এবং ভর ছিল শূন্য; আর এই ভরহীন পয়েন্ট এক প্রচন্ড বিস্ফোরণ ফলেই বস্তু ও সময়ই অস্তিত্বলাভ করে এবং সৃষ্টি হয় সম্প্রসারণশীল এ বিশ্বজগতের।অন্যভাবে বললে,এ বিশ্বজগত সৃষ্টি হয়েছে শূণ্য থেকে। বিগ ব্যাংগ তত্ত্ব কিন্তু পরবর্তী কালে বিভিন্ন সুস্পষ্ট বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের দ্বারা সত্য প্রমাণিত হতে থাকে।এসব সত্য আবিস্কারের ফলে কোণঠাসা হয়ে পড়ে নাস্তিকরা।প্রসঙ্গ ক্রমে,'Atheistic Humanism' এর লেখক ও University of Reading এর দর্শনের নাস্তিক অধ্যাপক এন্থনি ফ্রিউ-এর আগ্রহ উদ্দিপক স্বীকাররোক্তির কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।তিনি বলেছেন ঃ স্বীকাররোক্তি আত্মার জন্য ভালো বলে কুখ্যাতি আছে।আমি স্বীকার করছি যে,সৃষ্টিতত্ত সংক্রান্ত সমকালীন সর্বসম্মত মত নাস্তিকদের ভালোরকম বিব্রত করবে।কারণ, বিশ্বজগতে একটি শুরু ছিল-এ-কথাটা St Thomas -এর মতে ফিলোসফিক্যালি প্রমাণ করা সম্ভব না হলেও দেখা যাচ্ছে,সৃষ্টিতত্ত্ব বিদরা এর সপক্ষে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ঠিকই হাজির করছেন।যদিও আমি এখনও আমার বিশ্বাস সঠিক বলে বিশ্বাস করি,তথাাপি বলতে হচ্ছে যে,বিগ ব্যাংগ তত্ত্বের উপস্থিতি ওই বিশ্বাসের উপর স্থির থাকা মোটেই সহজ ও স্বস্তিদায়ক ব্যাপার নয়।”
বিশ্বজগত এমনি এমনি সৃষ্টি হয়নি;এ তত্ত্বের অসারতাঃ
নিরীশ্বরবাদীরা মনে করত,এ পৃথিবী সব পদার্থ এবং আসমানের সব বস্তু ও গ্রহ নক্ষত্র হঠাৎ করে এমনি এমনি বা দৈবক্রমে (by chance) সৃষ্টি হয়েছে।এমনকি,বিশ্বজগতে আমরা যেসব প্রাকৃতিক নিয়ম কানুন দেখতে পাই, সেগুলো পেছনেও কোন পরিকল্পনা ছিল না, ছিল না কোন পরিকল্পনাকারীর হাত।ওগুলো সৃষ্টি হয়েছে দৈবক্রমে। বিংশ শতাব্দীতে জ্যোতির্বিদ্যার শাখায় আবিস্কৃত বিভিন্ন সত্য এ ধারণাকেও নাটকীয়ভাবে বাতিল করে দিয়েছে।
বিংশশতাব্দীর সত্তরের দশকে এসে বিজ্ঞানীরা স্বীকার করতে শুরু করলেন যে,বিশ্বজগতে যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিরাজ করছে,তা মানবজীবনের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় এবং এ ভারসাম্য অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে স্থাপন করা হয়েছে।এ ক্ষেত্রে গবেষণা এখনও এগিয়ে চলল এবং একসময় আবিস্কৃত হলোঃ বিশ্বজগতের বিভিন্ন ভৌত, রাসায়নিক ও জীববৈজ্ঞানিক নিয়মসূহ; মাধ্যাকর্ষনশক্তি ও ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিজম ; অনুর গঠনশৈলী ইত্যাদি সবকিছুই এমনভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে যেখানে সৃষ্টি করার উপর মানবজীবনের অস্তিত্ব নির্ভর করে।এ যেন একটি পরিকল্পিত নকশা।প্রাশ্চাজ্যের বিজ্ঞানিরা এ অসাধারণ নকশার নাম দিয়েছেন ’এ্যানথ্রেপিক প্রিন্সিপল’। সোজা কথায় উদ্দেশ্যহীনভাবে নয় বরং মানবজীবনকে মাথায় রেখেই বিশ্বজগতের সবকিছু ডিজাইন করা হয়েছে।
যেমনঃ
*মহাবিস্ফোরণ (big bang) পরমুহুর্তে থেকে বিশ্বজগত সম্প্রসারিত হতে শুরু করেছিল ঠিক সেই গতিতে যেই গতিতে সম্প্রসারিত হওয়া ছিল অত্যাবশ্যকীয়।বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন যে,যদি ওই গতিবেগ কোটি কোটি ভাগের একভাগও কমবেশী হত তবে বিশ্বজগত আজকের অবস্থানে কখনও পৌঁছতে পারতো না।অর্থাৎ খুব পরিকল্পিত হিসাবের উপর ভিত্তি করে বিশ্বজগত সৃষ্টি।
*বিশ্বজগতে চারধরনের প্রাকৃতিক শক্তি ক্রীয়াশীল।এগুলো হলঃমাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক শক্তি,দুবর্ল পারমাণবিক শক্তি ও শক্তিশালী পারমাণবিক শক্তি। এ শক্তিগুলোর খুবই সামান্য তারতম্য ঘটলেই বিশ্বজগতে রেডিয়েশন বা হাইড্রোজেন গ্যাস ছাড়া আর কিছু থাকতো না।তখন প্রাণের অস্তিত্বও অসম্ভব হয়ে পড়ত।
*বিশ্বজগতের এমন সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয় আছে যা পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্বকে সম্ভব করে তুলেছে।সূর্যের আয়তন এবং পৃথিবী থেকে এর দুরত্বঃ পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুনাগুন; সূর্য -রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য; পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে বিভিন্ন গ্যাসের নিখুঁত আনুপাতিক হার; পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র ইত্যাদি সবকিছু পৃথিবীতে মানুষের জীবনের সহায়ক করে সৃষ্টি করা হয়েছে।
দ্যা সিমবায়োটিক ইউনিভার্স-শীর্ষক গ্রন্থে মার্কিন জ্যোতিবিজ্ঞানী জর্জ গ্রীনস্টেইন বলেছেন; ”জীবনের সঙ্গে পদার্থবিদ্যার সূত্রসমূহের সঙ্গতিপূর্ণ সর্ম্পকের ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করলে তাৎক্ষণিকভাবে মনে হয় যে, কিছু অতিপ্রাকৃতিক এজেন্সী (বিশ্বজগত সৃষ্টির পেছনে) ক্রীয়াশীল আছে। এটা কি সম্ভব হয়, ইচ্ছায় নয় বরং হঠাৎ করে আমরা এমন সব বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণের সম্মুখীন হয়েছি। যেগুলো একজন সর্বোচ্চ সত্তার অস্তিত্ব প্রমাণ করে? আমাদের সুবিধার্থে এ বিশ্বজগত অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে সৃষ্টি করেছেন কি তবে আল্লাহ-ই?’’
সংক্ষেপে বললে,উদ্দেশ্যহীন এলোমেলো বিশ্বজগতের ধারণা যা কিনা সম্ভবত নাস্তিকতাবাদের সবচেয়ে শক্তিশালী স্তম্ভ ছিল-ইতিমধ্যে বাতিল হয়ে গেছে।বিজ্ঞানীরা এখন প্রকাশ্যে বস্তুবাদের পতনের কথা বলছেন।আল কোরআনে এই কথাই ব্যক্ত করেছে: ’’আমরা আসমান ও জমিন এবং উভয়ের মাঝখানের কোনকিছুই অকারণে সৃষ্টি করি নাই।অবিশ্বাসীরাই কেবল এই ধারণা পোষণ করে’’ ৩৮ঃ২৭।
কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা এবং দৈব জ্ঞানের অস্তিত্ব আবিস্কারঃ
পরমাণুর তথ্যচিত্র
আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের গুরত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নিয়েছে কোয়ান্টাম পদার্থ বিদ্যা।বস্তুর ক্ষুদ্রতর অংশ নিয়ে কাজ করে কোয়ান্টাম পদার্থ বিদ্যা অর্থাৎ পরমাণু। অবাক করা বিষয় এই পরমাণুর ৯৯.৯৯৯ শতাংশ জায়গাই খালি।বস্তুত পক্ষেই যে অংশটুকু বস্তু তাও বস্তু নয় বলা যায় জমাটবাঁধা শক্তি।আর পরমাণুর ভিতরের এই বস্তুসমূহ বলা যায় সক্রিয়ভাবে কাজ করে।মনে হয়,জন্মগতভাবে ওগুলো একধরণের মন-এর অধিকারী।সহজ করে বললে বলা যায়,বস্তুর অস্তিত্বের পশ্চাতে কাজ করে তথ্য।আর তথ্য তথা জ্ঞান বস্তুজগত অস্তিত্বশীল হবার পূর্ব থেকেই অস্তিত্বশীল ছিল।পদার্থ বিদ্যা ও জীববিদ্যা উভয় বিষয় নিয়েই কাজ করছেন জ্যারান্ড শ্রোয়েডার এবং তিনি তার বিখ্যাত বই ’দ্যা হিডেন ফেইস অব গড’-শীর্ষক বিখ্যাত বইতে উল্লেখ করেছেন”..বস্তুর ভিত্তি হচ্ছে শক্তি এবং বস্তু আসলে জমাটবাঁধা শক্তি-এ সত্য আবিস্কার করতে মানবজাতিকে অপেক্ষা করতে হয়েছে হাজার বছর।অপেক্ষা করতে হয়েছে আইনষ্টাইনের জন্মের।আমরা হয়তো আরও একটু বেশি দেরিতে আবিস্কার করবো যে,শক্তির চেয়ে অধিক মৌলিক কোন অবস্তু-ই শক্তির ভিত্তির রচনা করেছে।” তিনি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে তার বইয়ের ২৮ পৃষ্টায় উল্লেখ করেছেন ’’বিজ্ঞান সম্ভবত এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে যাচ্ছে যে, গোটা বিশ্বজগতেই তথ্য, জ্ঞান বা একটি ধারণার বহিঃপ্রকাশ,” তিনি আরো বলেন ”..যেন একটা মেটাফিজিক্যাল সাবস্ট্রেইট ফিজিক্যাল সাবস্ট্রেইটের এর আদলে প্রকাশিত হয়েছে।”
বিজ্ঞানের এ আবিস্কার বস্তুবাদের গোটা প্রাসাদকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয় এবং প্রমাণ করে যে আমরা যে-বস্তুজগতকে পর্যবেক্ষণ করছি তা এক অতিপ্রাকৃত পরম সত্ত্বার ছায়া বৈ আর কিছু নয়।আসলে আমরা সম্ভবত বস্তুজগতের সঙ্গে আধ্যাত্মিক জগতের বৈজ্ঞানিক মিলন প্রত্যক্ষ করছি।কুরআনে বলা হয়েছে: ”তোমাদের ইলাহ তো কেবল আল্লাহই, যিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নাই।তাঁহার জ্ঞান সর্ববিষয়ে ব্যাপ্ত।”(কুরআন,২০ঃ২৮)।
বিশ্বজগতের একটি তথ্যচিত্র
কোয়ান্টাম থিয়োরি আমাদের সামনে যেমনি অনেক সত্য নিয়ে এসেছে তেমনি স্ট্রিং থিত্তরি আমাদের সামনে আরো অনেক সত্য প্রমাণ করতে যাচ্ছে। আমরা বস্তুজগতের বস্তুসমূহকে থ্রি ডাইমেনশন দৈর্ঘ্য,প্রস্থ ও উচ্চতা এর মাধ্যমে বিবেচনা করতাম।আইনস্টাইন এর সঙ্গে সময়কে যোগ করে ফোর ডাইমেনশন করলেন।যা আমাদের অনেক জিনিস ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হয়। স্ট্রিং থিয়োরী মতে সুপার ডাইমেন টেন থেকে টুয়ান্টি সিক্স পযর্ন্তু হতে পারে। তার থিয়োরি অনুযারী টেন ডাইমেনশানের কোন সত্ত্বা পরমাণুর ভিতরে অবস্থিত যে বিশাল ফাঁকা জায়গা অর্থাৎ একটি নিশ্চিদ্র দেওয়াল (যা আপাতত দৃষ্টিতে আমাদের কাছে মনে হয়) তার ভিতর দিয়ে অসায়েসে চলতে পারবে।যদিও এখনও থিয়োরিটি প্রমাণিত নয়। যদি এটি প্রমাণিত হয়ে যায় তবে খুব সহজে জ্বীন জাতি এবং ফেরেশতাদের চলাচল অথবা আমাদের মধ্যে তাদের অবস্থান খুব সহজে ব্যাখ্যা করা যাবে।তাদের দেওয়া তত্ত্ব মতো এই মহাবিশ্বের মতো আরো অনেক মহাবিশ্ব থাকতে পারে।যেখানে পরমাণুসমূহ ভিন্ন আচরণ করতে পারে। যদি বিজ্ঞানীরা এটা এখনও প্রমাণ করতে সক্ষম হয়নি তবে তাদেরকে সম্ভবনা দেখাচ্ছে কোরআন।যেখানে আল্লাহ বলেছেন,তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন।
ডারউইনবাদের পতনঃ
ডারউইন ও তার তত্ত্বের সংক্ষিপ্ত তথ্যচিত্র
নিরীশ্বরবাদীদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল ডারউইনবাদ।যদিও সেটা ছিল শুধু একটা মতবাদ, প্রমাণিত কোন সত্য নয়।বিজ্ঞান ডারউইনবাদকে আস্তাখুড়ে নিক্ষেপ করেছেন।
*জিবাশ্ম পর্যবেক্ষনঃ-তার পর্যবেক্ষন মতে, পৃথিবীর সব প্রাণী সৃষ্টি হয়েছে একটি একক ও সাধারণ পূর্ব পুরুষ থেকে, দীর্ঘকাল ধরে ছোট ছোট পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে। ডারউইন ধারণা করেছিলেন, ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন ফসিল আবিস্কারের মাধ্যমে তার ধারণা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি লাভ করবে। কিন্তু ঘটেছে উল্টো, ক্রমান্বয়ে পরিবর্তনের মাধ্যমে কোন প্রাণী অন্য প্রাণীতে রুপান্বরিত হলে তাদের মধ্যবর্তী কোন প্রজাতির ফসিল পাওয়া যাওয়া কথা।কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল উল্টো, আবিস্কৃত বিভিন্ন ফসিল বা জীবাশ্ম রের্কড থেকে বরং এটা স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, সব প্রজাতি হঠাৎ করে পূর্ণাঙ্গ আকৃতি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে-বির্বতনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে পূর্নাঙ্গ রুপ পায়নি।
জীববিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণঃ ডারউহন কিছু বৈশিষ্ট্য মিলিয়ে যেমন মাছ খেকো ভালুককে তিমিতে রূপান্তরের কথা বললেন।বিজ্ঞান তাকে হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। বরং বিজ্ঞানের বক্তব্য- প্রাকৃতিক বা কৃত্রিমভাবে কোন প্রজাতির দৈহিক গঠনে খানিকটা পরিবর্তন ঘটা সম্ভব হলেও সে পরিবর্তন কোন অবস্থাতেই নির্দিষ্ট বংশগতির সীমানা অতিক্রম করে না। আজকাল নব্য-ডারউইনবাদীরা মিউটেশন বা জীনগত বিশৃঙ্খলাকে বিবর্তনের মেকানিজম হিসাবে চালিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান সে-দাবীকেও অগ্রহণযোগ্য বলে রায় দিয়েছেন।
প্রাণের উৎপত্তিঃ একটি নির্দিষ্ট প্রাণ থেকে প্রাণের উৎপত্তি বললেও এই নির্দিষ্ট প্রাণটা সম্পর্কে তার যুক্তিও হাস্যকর।তিনি তার ’লাইফ এন্ড লেটার অব চার্লস ডারউইন’ শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন যে,পৃথিবীতে প্রথম জীবকোষটি কোন একটি ছোট উঞ্চ জলাশয়ে এলোমেলো রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন হয়ে থাকতে পারে।তার এ ধরণের যুক্তির বিপরীত নিরশ্বরবাদী নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ফ্রেড হোয়েল বলেন ’’একটি টর্নেডোর ধাক্কায় হঠাৎ করে প্রয়োজনীয় উপাদান সমূহ একত্রিত হয়ে একটি বোয়িং তৈরী হয়ে যাবার সম্ভাবনা যতটুকু, আলোচ্য উপায়ে জীবকোষ সৃষ্টির সম্ভাবনাও ঠিক ততটুকু।”
ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইনঃ মানব থেকে প্রাণী ও জীবজগতের সমস্ত বস্তসমূহ এতো অনন্য সাধারণ ডিজাইনে তৈরী হয়েছে যা একজন পরিকল্পনাকারীর ইঙ্গিত বহনকরে।পবিত্র কোরআনে অনেক জায়গা এই কথা বলা হয়েছে, চিন্তাশীলেরা অবশ্য স্রষ্টার সৃষ্টির মধ্যে নির্দশন খুজে পাবেন।
ফ্রয়েডেবাদের পতন ও ধর্মের গ্রহনযোগ্যতা অজর্ন:
ফ্রয়েডের দাবী অনুযারী ধর্মীয় বিশ্বাস একটি মানসিক অসুস্থতা এবং মানবজাতির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় বিশ্বাস ও একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
বিগত ২৫ বছরে মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে গবেষণা হয়েছে তা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ,ধর্ম মানসিক রোগ নয় বরং মানসিক স্বাস্থ্য ও সুখের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোর অন্যতম। গভেষনা দেখা গেছে যে,যারা ধর্মে বিশ্বাস করে এবং ধর্মচর্চা করে; তারা আত্মহত্যা,পানভ্যাস,মাদকাসক্তি.তালাক ও বিষন্নতা প্রভৃতি সমস্যায় অনেক কম ভোগেন এবং এসব সমস্যার ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্তই গ্রহন করেন।
চিকিৎসা বিদ্যার ক্ষেত্রেঃ অনেক গবেষণায় সুস্পষ্টভাবে এটা ফুটে উঠেছে অপেক্ষাকৃত ধর্ম অনুসারী এবং এর চর্চাকারীরা অন্যদের তুলনায় বেশ কিছু রোগে কম আক্রান্ত হয়। পেট্রিক গ্রাইন বলেছেন:সাম্প্রতিককালের চিকিৎসা বিদ্যা স্পষ্টতেই নিঁখাদ বস্তগত চিকিৎসার বাইরেও যে চিকিৎসা পদ্ধতি থাকতে পারে তা স্বীকার করতে যাচ্ছে ” । কোরআন আল্লাহ পাক বলেন ,”আল্লাহ তথা স্রষ্টার স্মরণেই কেবল অন্তর শান্তি পেতে পারে।”(১০:১৮)
সমাজবিজ্ঞানঃ
নিরীশ্বরবাদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক কমিউনিজমকে পুরো বিশ্ব দেখেছে। ছয় কোটির উপর মানুষকে তারা হত্যা করেছে।মানুষকে পরিণত করেছে শৃঙ্খলহীন বন্দি। ফলে তারা নিজেরাই নিজেদের হত্যা করেছে। ফ্যাসিবাদের পতন ঘটেছে একই পন্থা। হিপ্পিদের পতন ঘটেছে আত্মহত্যার মাধ্যমে।
এ পযর্ন্ত যে সমস্ত তথ্য প্রমাণ তুলে ধরেছি,তাতে এটা স্পষ্ট যে, নিরীশ্বরবাদ নিশ্চিতভাবেই পতনের শেষ প্রান্তে চলে এসেছে।অনেক নিরীশ্বরবাদী এখনও সরাসরি ঈশ্বরকে স্বীকার না করলেও একটি অতিপ্রাকৃতিক সত্ত্বা স্বীকার শুরু করেছে।অন্যভাবে বললে,মানবজাতি স্রষ্টারদিকে মুখ ফিরাচ্ছে এবং ভবিষ্যৎ ফেরাতে থাকবে। তাই তাদের সাথে রুক্ষ নয় বরং যোক্তিকতার সাথে সত্য তুলে ধরুন। আল্লাহ যদি চাহেন, তবে তারা অবশ্য সত্যের দিক মুখ ফিরাবে।আপনার কাজ দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া। সর্বশেষ কোরআনের একটি বাণী দিয়ে শেষ করছি, ”তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর আলো নিভিয়ে দিতে চায়।অবিশ্বাসীরা অপ্রীতিকর মনে করলেও আল্লাহ তাঁর আলোর পূর্ণ উদ্ভাসন ব্যতীত আর কিছু চান না।”(৯ঃ৩২)।
সর্ব বিষয়ে আল্লাহর জ্ঞান পরিব্যাপ্ত;তিনি যেন আমাদের ত্রুটিসমূহ মার্জনা করেন।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি, তুর্কি গবেষক হারুন ইয়াহিয়া-এর A Turning point in History:The Fall of Atheism ও এর অনুবাদক আলিমুল হক এর প্রতি এবং সে সকল বিজ্ঞানীদের প্রতি যারা সত্য উদঘাটনে প্রতিনিয়ত কঠোর শ্রম ও মেধা দিয়ে যাচ্ছেন।
ছবিসূত্রঃ-নেট।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১২:৩৭