১ম পর্ব
http://www.somewhereinblog.net/blog/murtala31
আগেই বলেছি যে যুদ্ধের কোর্সটি শেষ পর্যন্ত বেশ কিছু আকর্ষণীয় অভিজ্ঞতার জন্ম দিয়েছিল। মূলত এটি ছিল বেতন সহ ছুটি কাটানোর মত একটা ব্যাপার যেখানে আয়েশ করে ব্যক্তিগত গবেষণার সুযোগ পাওয়া যেত। কোর্সে সুযোগ পাওয়া আমাদের দলটি ছিল বাছাই করা অফিসারদের নিয়ে গঠিত। এদের সবারই পেশাগত ক্ষেত্রে বিপুল আগ্রহ ছিল। পুরো কোর্সের প্রস্তাবিত বিষয় এবং পাঠ্যসূচী অনুযায়ী নির্দেশনা দেবার জন্য ডিরেক্টিং স্টাফ ছিলেন। তার কাজ ছিল আমাদের গবেষণার কাজে প্রযোজনীয় পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করা। পুরো কোর্স চলাকালীন সময়ে নির্দেশিত বিষয়ের উপর আমাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব গবেষণা করতে হত। নিজস্ব গবেষণার পাশাপাশি দলগত গবেষণার বিষয়েও আমাদের প্রচুর পড়াশোনা করতে হত। আমার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল “পাকিস্তানের জনশক্তি প্রশিক্ষণ ও এর উপযোগিতা”।
জেনারেল হেডকোয়ার্টাস এর নির্দেশে আমার গবেষণাপত্রটি পাকিস্তান সরকারের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সে সময়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের নিযুক্ত একটি কমিশন এ বিষয়ে সরাসরি গবেষণা করে জাতীয় পর্যায়ের নীতিমালা প্রণয়নে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিল। কোর্সে সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমারা যে গবেষণাপত্রটি শেষ করি তার বিষয়বস্তু ছিল “পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা”।
আমাদের গবেষণা পত্রটি স্টাফ কলেজের প্রথম সারির কর্তাব্যক্তিদের কাছে পাঠান হল। তারা এটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। কোর্সের একজন সিনিয়র ছাত্র হিসেবে আমার কাজ ছিল বিভিন্ন বিষয়ে কোর্সের আলোচনা পর্বগুলো পরিচালনা করা। আমিই ব্রিগেডিয়ার আজগর (পরবর্তীতে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বেলির সদস্য এবং রাষ্ট্রপতির রাজনৈতিক উপদেষ্টা) কে এ কাজটির সমন্বয় করার জন্য সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ দেই। আমার আস্থার প্রতিদানে আজগর চমৎকারভাবে তার দায়িত্ব পালন করেছিল।
১৯৬৮ সালের অক্টোবরে আমরা কোর্সের সব সদস্য মিলে শিক্ষা সফরে বের হই। সফরের অংশ হিসেবে আমরা রাওয়ালপিন্ডিতে যাই। সেখানে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের সাথে এক ঘন্টাব্যাপী একটি আলোচনা সভার সুযোগ আমাদের দেয়া হল। আলোচনার অধিকাংশ সময়ই প্রশ্নত্তোর পর্বের জন্য নির্ধারিত ছিল। যেহেতু আমি দলে মধ্যে সিনিয়র ছিলাম, রাষ্ট্রপতির জন্য প্রশ্ন নির্ধারণের ভার আমার উপরই পড়ল। আমি দ্রুতই বেশ কিছু প্রশ্ন গুছিয়ে ফেললাম। রাষ্ট্রপতি তখন দীর্ঘদিন রোগে ভোগার পর সবেমাত্র সুস্থ হয়ে উঠেছেন। সেসময় তার অসুখ বিষয়ক সমস্ত খুঁটিনাটি অতি সাবধানে গোপনীয়তার আবরণে ঢেকে রাখা হত। সেই আবরণ ঠেলে রাষ্ট্রপতি আমাদের সময় দিলেন। যদিও তাকে দেখতে কিছুটা ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। কিন্তু তারপরও তিনি আত্মবিশ্বাসে উজ্জ্বল ছিলেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন যে খুব শীঘ্রই তাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিতে হবে। আর সেই ভাষণটি তৈরির জন্য তিনি শারীরিক দূর্বলতাকে থোড়াই কেয়ার করে সেদিন ভোর চারটার সময় ঘুম থেকে উঠেছেন। এ থেকেই স্পষ্ট যে শারীরিক দূর্বলতা সত্ত্বেও সর্বোচ্চ দক্ষতার সাথে তিনি কেমন কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন।
তিনি দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সাথে আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন। অবশেষে সর্বশেষ প্রশ্নটি আমি উত্থাপন করলাম। তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম যে, বৃটিশদের মত আমরাও বিরোধী পক্ষকে ছায়া-মন্ত্রনালয় গঠনের সুযোগ দেব কীনা? প্রশ্ন শুনে রাষ্ট্রপতি দৃশ্যতই বিরক্ত হলেন। খানিকটা সময় নিয়ে তিনি বললেন যে পাকিস্তানের বিরোধী পক্ষের গুরুত্ব খুবই কম এবং শাসন ব্যবস্থার ব্যাপারে তাদের আপাতদৃষ্টিতে কিছুই করার নেই। আমার প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে তিনি উল্টো প্রশ্ন করে বসলেন, “কোন গাধা আমাকে প্রশ্নটা করলো, জানতে পারি?”
যদিও পদস্থ সেনা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমাদের সর্বদা ব্যস্তই থাকতে হত। তারপরও জাতির রাজনৈতিক পটভূমিতে যে পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে তা আমাদের কারোরই নজর এড়ায়নি। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার বীজ ততোদিনে বোনা হয়ে গেছে। জুলফিকার আলী ভুট্টো সাহস করে রাষ্ট্রপতি প্রণীত নীতিমালার বিপক্ষে কথা বলতে শুরু করেছেন। ভুট্টোকে সহযোগিতা করছে ড. মাহবুবুল হক এর “বাইশ পরিবার” শ্লোগান যার মূল কথা হল- ধনীরা আরো ধনী এবং গরিবেরা আরো বেশি গরিব হয়ে যাচ্ছে। তারা সমাজতান্ত্রিক আওয়াজ তুলে সম্পদের সমান বন্টন দাবী করলেন। অর্থনৈতিক বিষয় ছাড়াও ভুট্টো রটিয়ে দিলেন যে “তাশখন্দ চুক্তি” আসলে সরকারের বিশ্বাসঘাতকতারই প্রমাণ।
ভুট্টো হুমকি দিলেন যে উপযুক্ত সময়ে জাতির সামনে তিনি সরকারের কু-কীর্তির সব বিবরণ ফাঁস করবেন। এই ঘোষণার ফলে রাজপথে আন্দোলনরত মানুষ আর ছাত্রদের কল্পনার আগুনে ঘিয়ের ছিটে লাগল। এভাবেই সেসময় রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানকে রাজনীতির দাবার দানে দু’দিক থেকেই কোনঠাসা করে ফেলা হয়েছিল। সুচতুর রাজনৈতিক কলা-কৌশলের যথোপযুক্ত ব্যবহার করে ভুট্টো তখন রাজনৈতিক অস্থিরতার পক্ষে বিরাট এক বাহিনী গড়ে তুলেছেন যারা শুধু তার নির্দেশের অপেক্ষায়। সুকৌশলে নিজেকে জনসাধারণের নেতা হিসেবে তুলে ধরার সাথে সাথে তিনি “রোটি, কাপরা অউর মাকান”(রুটি, কাপড় আর ঘর) শ্লোগানে আকাশ বাতাস ঝাঁঝিয়ে তুলতে লাগলেন।
ইতিমধ্যে, অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আজগর খানও রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের বিপক্ষে কথা বলা শুরু করেছেন। দৈনিক পত্রিকার “সম্পাদকের কাছে খোলা চিঠি” বিভাগে তিনি তার মতামত তুলে ধরতে লাগলেন। যার ফলে অচিরেই তিনি সরকার বিরোধী আন্দোলনের প্রথম কাতারে চলে এলেন। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি তার নিজের রাজনৈতিক দল “তেহরিক-ই-ইশতিকলাল” গঠন করে ফেললেন। আজগর খানের দলকে কোন ছাড় না দিয়ে বা তার নতুন গড়া দলের সাথে কোন ধরনের জোট না বেধে ভুট্টো তার রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলেন। এবং পরিস্থিতিকে সুচতুরের মত ব্যবহার করে আজগর খানের সরকার বিরোধী আন্দোলনের পূর্ণ রাজনৈতিক ফসল নিজের ঘরে তুলতে সক্ষম হলেন। আউয়ুব সরকার বিরোধী আন্দোলনে ভুট্টোর ভূমিকার বিষয়ে অন্তত তখন এবং পরবর্তীতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এমনটিই ধারনা করেন।
এই সময়েই (নভেম্বর ১৯৬৮), সম্পূর্ণ পৃথক ভাবে দুটো ঘটনা ঘটেছিল। প্রথম ঘটনায় সরকার বিরোধী আন্দোলকারী রাওয়ালপিন্ডি পলিটেকনিকের একজন ছাত্র পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। দি¦তীয় ঘটনায় একজন বিক্ষোভকারী রাষ্ট্রপতি আউয়ুব খানকে গুলি করতে সমর্থ হয়। রাষ্ট্রপতি তখন পেশোয়ারে এক জনসভায় বক্তব্য দিচ্ছিলেন। সাধারণভাবে দেখলে এ দুটো ঘটনা পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক উত্তেজনাকে আরো ঘনিভূত করলেও প্রকৃতপক্ষে আগুনকে উস্কে দিল সরকারের অন্য একটি সিদ্ধান্ত। চিনির দাম কেজি প্রতি ৫০ পয়সা বাড়ানোটাই সরকারের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। এই সিদ্ধান্তের জেরে শুরু হয়ে গেল সরকার বিরোধী দাঙ্গা। রাওয়ালপিন্ডি, লাহোর হয়ে বন্য দাবানলের মত এই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল পশ্চিম পাকিস্তানের বড় বড় শহরগুলোতে।
এর মধ্যে আর্মি ওয়ার কোর্সে অংশগ্রহকারীদের ঢাকায় পাঠান হয়। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সমস্যা সরজমিনে দেখা ও বিশ্লেষণ করা। প্রায় ১৫ দিন অবস্থানকালে সেখানকার গর্ভনর আবদুল মোনেম খানের সাথে আমাদের সৌজন্য স্বাক্ষাত হয়। স্বাক্ষাতে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে বিরাজমান শান্তিপূর্ণ পরিবেশের জন্য নিজের কৃতিত্ব দাবী করেন। তার এহেন দাবীতে আমরা বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। ক্রমশ দানা বেধে ওঠা সঙ্কটের যে পূর্বাভাস পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকালে আমরা খেয়াল করেছিলাম তা তার নজর এড়িয়ে গেছে সেটি বিশ্বাস করতে কষ্ট হল। পশ্চিম পাকিস্তানে তখন সরকার-বিরোধী দাঙ্গা পুরোদমে ছড়িয়ে পড়েছে এবং অবস্থা দেখে মনে হল পূর্ব পাকিস্তানে কেবল সলতেয় আগুন দিতে বাকি। সেই আগুনের জন্য বেশিদিন অপেক্ষা করতে হল না। আমাদের ঢাকা সফরের অল্পদিনের ভেতরেই পাকিস্তানের পূর্ব-পশ্চিম দুটো অংশই দেখতে দখতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল।
ঢাকায় যাবার কিছুদিনের মধ্যেই অবিভক্ত পাকিস্তানের দুই অংশের ভেতর স্পষ্ট বিভাজন দেখে আমি চমকে উঠলাম। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালিরা প্রকাশ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিশেষ করে পাঞ্জাবীদের প্রতি সমালোচনায় মুখর ছিল। অধিকাংশ বাঙ্গালি বিহারীদের প্রতিও একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করত। তাদের চোখে আমরা ছিলাম বিদেশী দখলদার যারা স্থানীয়দের পেছনে ঠেলে সামাজিক ও পেশাগত প্রতিটি প্রতিযোগীতামূলক ক্ষেত্রেই জোর করে এগিয়ে ছিল। আমরা জানতে পারলাম বেশির ভাগ বাঙ্গালীই পশ্চিম পাকিস্তানিদের এবং দেশভাগের পরে আসা বিহারী অভিবাসীদের “শালা পাঞ্জাবী” বা “শালা বিহারী” গালিতে সম্বোধন করে থাকে। (চলবে)
৫/০৮/১২
সিডনি,অস্ট্রেলিয়া ।