আমার বইটি নিয়ে ইনাম আল হক সাহেব একটি রিভিউ লিখেছেন আজকের কালেরকণ্ঠ পত্রিকায়। হুবহু তুলে দেয়া হল।
অভিযাত্রী মুনতাসির মামুনের লেখা ‘পৃথিবীর পথে বাংলাদেশ’ বইটি পড়লাম। শিরোনাম দেখে মনে হয়েছিল, মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের শুভযাত্রা নিয়ে একটি বই; কিন্তু বিকল্প শিরোনাম ‘সাইকেলে আলাস্কা থেকে টরোন্টো’ পড়ে বুঝলাম, তা নয়। লেখক ও তাঁর তিন বন্ধু সাইকেল চালিয়ে উত্তর আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়ার সংকল্প করেছিলেন। আলাস্কা থেকে যাত্রা শুরু ২০১৪ সালের জুনে; তিন মাসাধিককাল পর অন্টারিওতে সমাপ্ত হয়েছিল।
৯৫ দিনের ছোট ছোট কুমড়ার ফালি করে ভ্রমণকাহিনিটি লেখা হয়েছে প্রতিদিনের সুখ-দুখের সংক্ষিপ্ত বয়ান দিয়ে। নাতিদীর্ঘ বাক্য; ঝরঝরে বাংলা; সুখপাঠ্য বই। লেখক এবং ‘অস্ট্রেলীয় নাগরিক সারাহ-জেন সল্টমার্শ’ একসঙ্গে চালিয়েছেন একটি সাইকেল, যার নাম ‘ফ্যামিলি ট্যান্ডেম ট্রাভেলার’। আরেকটি সাইকেল চালিয়েছেন লেখকের ‘প্রিয় মানুষ কনক ভাই’।
অভিযান শেষে লেখক স্মরণ করেছেন, এই মহাসড়কেই পাঁচ হাজার ৩৭৩ কিলোমিটার দৌড়ে গিয়েছিলেন ক্যান্সারে পা হারানো অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব টেরি ফক্স। বিনয়ের সঙ্গে লেখক বলেছেন, ‘আমরা এই সাইকেল নিয়ে যা করছি তা নিতান্ত ছেলেখেলা।’
বইয়ের পুরোটাই আলাস্কা ও কানাডার জনহীন, অন্তহীন ও অজানা হাইওয়ে ধরে একনাগাড়ে তিন মাস সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার রোজনামচা। এখানে লেখক কোনো বীরত্বের দাবি না করে পথের কষ্ট, অনিশ্চয়তা এবং যৌক্তিক ও অযৌক্তিক ভয়ের অকপট বয়ান দিয়েছেন। তিনি অসংকোচে তাঁর কাস্টমসের ভয়, ভল্লুকের ভয় ইত্যাদি শঙ্কার সরস বর্ণনা দিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন, ‘আমার মতো ভীতু মানুষ আর পাওয়া যাবে না। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দিত ঝিঁঝিপোকার আওয়াজ। রক্তে হিম ধরে যেত।’ ঝোপের ওপর কালো পলিথিন দেখে ভল্লুক বলে ভয় পাওয়ার কাহিনিটা আরো মজার, কারণ লেখকের সহযাত্রী তরুণী সারাহ-জেন ভীত না হয়ে বরং ভল্লুক দেখার প্রত্যাশী ছিলেন। লেখকের কথায়, ‘সারাহ-জেন উত্ফুল্ল জন্তুজানোয়ার দেখলে; আমি পেয়ে যেতাম ভয়।’
বিদেশবিভুঁইয়ে পেডাল মেরে লেখক তিনটি মাস পার করেছেন, কিন্তু এক দিনের জন্যও দেশকে ভোলেননি। আকাশে বুনো হাঁস দেখে তাঁর টাঙ্গুয়ার হাওরের কথা মনে পড়েছে। কানাডার বন্য প্রাণী ট্রাপারের কথায় তিনি সুন্দরবনের পচাদ্দি গাজীর কথা স্মরণ করেছেন। লেখকের মনে হয়েছে, ‘ট্রান্স-কানাডা মহাসড়কটা ঠিক কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভের মতোই।’ অনেক উষ্ণতা ছড়িয়েছে লেখকের ফেলে আসা জীবনের তাৎপর্যহীন ঘটনার স্মৃতিচারণা। উইনিপেগে গিয়ে তাঁর মনে পড়েছে সোবহানবাগের যোগেশ নাপিতের ছিন্নভিন্ন দোকানের কথা। দ্য কলামস নামের ব্রেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্টের দোরে দাঁড়িয়ে তিনি স্মরণ করেছেন শৈশবে ‘বগুড়া শহরের জলেশ্বরীতলা থেকে হেঁটে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল স্কুলে’ যাওয়ার কথা। মেপল-সিরাপ-কুকি কিনে তাঁর ‘চুকনগরের চুইঝালের গোশতের’ কথা মনে পড়েছে এবং ম্যানিটোনিং থেকে ফেরিতে উঠে তাঁর মনে পড়েছে উত্তরবঙ্গের পথে ‘ফেরির রেলিংয়ে হেলান দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাদের মুড়িমাখা খাওয়ার’ কথা।
শ্বেতাঙ্গের দেশে লেখকের মতো একজন অশ্বেতাঙ্গর গায়ে বৈষম্যের কিছু ছেঁকা যে লাগবে সেটা অনুমেয়। লেখকের এক সঙ্গী কনক ছিলেন কালা আদমি এবং অপর সঙ্গী সারাহ-জেন শ্বেতাঙ্গী। তাই আপদে-বিপদে অচেনাজনের সাহায্য প্রার্থনার জন্য সারাহ-জেনের শুভ্র করতলই ছিল একমাত্র ভরসা। লেখকের কথায়, ‘আমি ও কনক ভাই যতবার কোনো গাড়ি থামাবার চেষ্টা করেছি প্রায় প্রতিবারই বিফল। কেউ থামেনি। শুধুমাত্র সারাহ-জেন সাহায্য চাইলে তবে পাওয়া যায়।’ একইভাবে বাফেলোর এক অভিজাত শ্বেতাঙ্গর গৃহে ক্ষণিকের অতিথি হয়ে লেখক আবহমান বর্ণবাদের অন্তঃপ্রবাহ প্রত্যক্ষ করে লিখেছেন, ‘সারাহ-জেনের সাথে সবাই যেভাবে কথা বলছে, আমার সাথে সেভাবে বলে না।’ আরো কুণ্ডলিত ছিল অশ্বেতাঙ্গ-অশ্বেতাঙ্গ বৈষম্যের কুচুটে ফল্গুধারাটি। শ্বেতাঙ্গের দেশে শিকড়-মেলা অশ্বেতাঙ্গরা হলেন এক ধরনের অনারারি শ্বেতাঙ্গ। কোনো নবাগত কালা আদমি শ্বেতাঙ্গসুলভ আচরণ করলে তাঁরা আহত ও ক্ষিপ্ত হন। সাইকেলে পেডাল মেরে মহাদেশ পার হওয়াটা শ্বেতাঙ্গর জন্য বিনোদন, কিন্তু কালা আদমির জন্য সেটা শো-অফ।
নতুন দেশে পথ চলতে গিয়ে সজাগ অভিযাত্রীরা সবচেয়ে মূল্যবান যে জহরত কুড়িয়ে পান তার নাম অভিজ্ঞান। আপদে-বিপদে কানাডার পথে-প্রান্তরে অচেনা মানুষের সহায়তা পেয়ে লেখক বলেছেন, ‘যারা পথ চলতে থাকে তারা সহায়তা পেয়ে থাকে।’ নিজেকেই তিনি প্রশ্ন করেছেন, ‘মনুষ্যত্বের উপকরণ আর উদাহরণ রাস্তায় যত মেলে, অন্য কোথাও মেলে কি?’ তিনি উপলব্ধি করেছেন, ‘দিনশেষে যে কথাগুলো মনে থাকে তা হল মানুষের ব্যবহার।’ থান্ডার বে যাওয়ার পথে সাইকেল মেকানিক ইরানি বংশোদ্ভূত ফারজাম ইতেমাদির সাহায্য পেয়ে লেখক বলেছেন, ‘এ মানুষগুলোর সাথে হয়তো আর কোনদিন দেখা হবে না। এ পরিমাণ ঋণ কবে শোধ করতে পারব, জানি না।’
ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড বইটি প্রকাশ করেছে ২০২২ সালের অক্টোবরে। প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার বইটিতে ৩০টি আলোকচিত্র এবং কনক আদিত্যর আঁকা কিছু আকর্ষণীয় ইলাস্ট্রেশন উপভোগ করেছি; কিন্তু অভাব বোধ করেছি যাত্রাপথের একটি নকশা ও সূচিপত্রের এবং চার অভিযাত্রীর আলোকচিত্র ও জীবনকাহিনির।
শিলালিপি | বই আলোচনা | ১১ অক্টোবর, ২০২৪ | কালের কণ্ঠ | view this link
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১০:০০