সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। বঙ্গোপসাগরের মধ্যে অবস্থিত এই দ্বীপ তার সুন্দর প্রবাল প্রাচীর, নীল জলরাশি এবং সামুদ্রিক জলজ জীব বৈচিত্র্যের জন্য আকর্ষণীয় হলেও, এই আদর্শিক এবং কাল্পনিক সমুদ্র বিলাসের মুখোশের নিচে একটি গুরুতর পরিবেশগত সংকটে রয়েছে। দ্বীপটি প্লাস্টিক এবং মাইক্রো প্লাস্টিকের বোমায় পরিণত হয়েছে। এই সত্যটি আমরা অস্বীকার করতে পারি কিন্তু বস্তবতা একেবারেই আলাদা।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পর্যটক যে এলাকাগুলোয় ভ্রমণ করে সেন্ট মার্টিন সেগুলোর একটি। ভরা মৌসুমে প্রতিদিন পাঁচ থেকে আট হাজার পর্যটক এই দ্বীপে আসেন দেশের নানান প্রান্ত থেকে। এখানে আসার একমাত্র ব্যবস্থা হলো জলজ পরিবহন যেমন ফেরি বা নৌকা। এই ফেরিগুলো কক্সবাজার, টেকনাফ এবং বিগত কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রাম থেকেও ছাড়ে। এছাড়া স্থানীয় কাঠের নৌকাতে যাতায়াত করা যায় টেকনাফ এবং শাহপরীর দ্বীপ থেকে। স্পিডবোটেও যাতায়াত করা যায়। তবে সংখ্যা এবং পর্যটক বহন করার সক্ষমতার দিক থেকে বেশ অপ্রতুল বলা ভালো। কিন্তু চলাচল করে।
এই দ্বীপে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পর্যটক আসে ফেরির মাধ্যমে। ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতন কেয়ারি সিন্দাবাদ নামের ফেরিতে করে পর্যটকরা দ্বীপটিতে যাওয়া-আসা শুরু করে। এর আগে শুধু মাত্র স্থানীয় নৌকাই যাতায়াতের মাধ্যম ছিল। বর্তমানে, ২০ বছর পরে এই ফেরির সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮ থেকে ১২ টি। এক একটি ফেরিতে যে কতজন পর্যটক যাতায়াত করবেন তার সংখ্যা আমি ব্যক্তিগতভাবে বিগত ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকেও লিখতে পারছি না। কানায় কানায় পরিপূর্ণ যেমন দেখেছি আবার কিছুটা ফাঁকা ফাঁকাও দেখেছি। যদি গড়ে ৫০০ জন করে ধরে নেওয়া হয় তবে কমছে কম হাজার পাঁচেক মানুষ শুধু ফেরি দিয়ে দ্বীপটিতে আসে বা আসতে পারে।
এই সংখ্যাগুলো জরুরি। কেননা অনেক দিন থেকে শোনা যাচ্ছে সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার জন্য সরকারিভাবে নিবন্ধনের চিন্তাভাবনা চলছে। এতে করে পর্যটকের সংখ্যা হ্রাস করা যাবে বলেও ধরে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর প্রয়োগের কোনো উদাহরণ দেওয়া যাচ্ছে না। বলা যেতেই পারে এটা এখনও প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বরাত দিয়ে প্রচারিত সংবাদগুলো দ্বীপটিতে যাওয়ার জন্য নিবন্ধনের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হচ্ছে জানানোর কয়েক ঘন্টা পরেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের সংশোধনী হিসেবে জরুরি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। তাতে বলা হয় সরকার এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়নি।
এখন কথা হলো সেন্ট মাটিন দ্বীপের মতন ছোট্ট একটি দ্বীপের বিপর্যয় ঠেকাতে কি কি সিন্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে আর এর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ কোনো উদাহরণ আছে কি না। উত্তর হলো আছে। গালাপাগোস দ্বীপের নাম আমাদের অজানা নয়। কিছুটা পরিচিত ঠেকলেও যদি বিবর্তনবাদের কথা বলা হয় তবে আমাদের ঠিকই মনে পড়বে। চার্লস ডারউইন ১৮৩৫ সালে এই দ্বীপ পরিদর্শন করেন যা তার বিবতর্নবাদের তত্ত্বে (ওন দ্য অরিজিন অব স্পিসিস) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পর্যটন ব্যবস্থাপনা গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ থেকে শিক্ষণীয়।গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের কার্যকরী কৌশলগুলো সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পর্যটন ব্যবস্থাপনার উন্নতির জন্য মূল্যবান পাঠ প্রদান করতে পারে।গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের পর্যটন ব্যবস্থাপনায় যেসব কৌশল নেওয়া হয়েছিল–
১. পর্যটন সীমাবদ্ধকরণ: গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে পর্যটনকে সীমিত করা হয়েছে। এই পদ্ধতিটি কৌশলগতভাবে পর্যটনের চাপ কমাতে এবং স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের (ইকোলজি) উপর প্রভাব কমাতে সহায়ক। সেন্ট মার্টিন দ্বীপেও পর্যটনের সংখ্যা সীমিত করে, পর্যটকদের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করে এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে বিধিনিষেধ আরোপ করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা যেতে পারে।
২. পর্যটক শিক্ষা এবং সচেতনতা: গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে পর্যটকদের পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করার জন্যে ব্যাপক প্রচারাভিযান চালানো হয়। স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে পর্যটকদের শিক্ষা দেওয়া হয়, যাতে তারা পরিবেশের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পর্যটকদের পরিবেশের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বাধ্যতামূলক প্রচারাভিযান এবং কর্মসূচি প্রবর্তন করা উচিত।
৩. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পুনঃচক্রণ: গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পুনঃচক্রণ ব্যবস্থাগুলো উন্নত করা হয়েছিল। এ দিক বিবেচনায় সেন্ট মার্টিন দ্বীপের কার্যকরী কোনো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আছে বলে মনে হয় না। এমন একটি দ্বীপ থেকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রথম এবং প্রধান উদ্যোগটি হতে হবে বর্জ্য অপসারণ। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রধানতম প্রতিবন্ধকতা হলো বর্জ্য সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করা। যেহেতু এই দ্বীপটি আকারে খুব ছোট তাই সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ যৌক্তিক ভাবে খুব কঠিন নয়। বিগত কয়েক বছরে বর্জ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হলেও তা মূলত নতুন বর্জ্য গুলোর জন্যেই প্রযোজ্য। এ ছাড়া সংগৃহীত বর্জ্যকে যদি মূল ভূখণ্ডে স্থানান্তর না করা হয়, তবে তা সংগৃহীত হবার কোনো সুফল নিয়ে আসে না। বিগত ১৪ বছর ধরে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখতে পেয়েছি এই দ্বীপর মূল বর্জ্য মূলত প্লাস্টিক জাতীয়। তার মধ্যে বোতলজাত প্লাস্টিকগুলো পুনঃবিপণনযোগ্য হওয়ার কারণে এর সংগ্রহ করার প্রবণতা বা সংগৃহীত হবার সম্ভবনা বেশি থাকে। কিন্তু পাতলা প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্যগুলোর পুনঃবিপণন যোগত্যা থাকে না বলে একে অনেক বা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফেলে রাখা হয়। যার একটি বাস্তব উদাহরণ হতে পারে এই দ্বীপের মিঠা পানির যত পুকুর বা জলাধার ছিল তার বেশির ভাগ এখন এই ধরণের প্লাস্টিকে পূর্ণ হয়ে গেছে। যে কোনো ধরণের প্লাস্টিক বর্জ্যকে মূল ভূখণ্ডে নিয়ে আসা না হলে এই সমস্যার সমাধান হবে না।
৪. স্থানীয় বাসিন্দাদের অংশগ্রহণ: গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের মডেল অনুসরণ করে, স্থানীয় এবং পর্যটকদের পর্যটন ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে অর্ন্তভুক্ত করা। স্থানীয় জনগণের সহযোগিতা এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে যে তারা পর্যটনের সুবিধা এবং চ্যালেঞ্জের অংশীদার হতে পারে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের স্থানীয়দের (সাধারণ জনগণ, প্রশাসন, ব্যবসা বাণিজ্য, হোটেল, মোটেল) অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা উচিত, যাতে তারা পর্যটন ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে।
৫. প্লাস্টিক নিষিদ্ধকরণ: গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। সেন্ট মার্টিন দ্বীপেও প্লাস্টিকের ব্যাগ, স্ট্র এবং অন্যান্য একবার ব্যবহারযোগ্য সামগ্রীর নিষিদ্ধকরণ করা হলে প্লাস্টিক বর্জ্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সমস্যা নানাবিধ। মাত্রাতিরিক্ত পর্যটন যেমন মূল কারণ, তেমনি স্থানীয়দের বদলে যাওয়া জীবনযাপন পদ্ধতি, অধিক সংখ্যক হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট নির্মাণ, অনুপস্থিত পয়ঃনিষ্কাশন এবং স্থানীয় প্রশাসনের অবহেলাকেও দায়ী করা যেতে পারে।
বিগত বেশ কয়েক বছর থেকে আলোচনায় থাকা নিবন্ধন করে পর্যটক সংখ্যা কমানোর যে বার্তা দেওয়া হচ্ছে তা হয়তো কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নয়। কেননা বাংলাদেশে আইন করে পলিথিনের ব্যাগ বন্ধ করা হয়েছে, ঘুষ বন্ধ করা হয়েছে, জনপরিসর ও গণপরিবহনে ধূমপান বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এসবের বাস্তবতা একেবারে আলাদা। আইন করা হলেও তার প্রয়োগ এবং তা কার্যকরী করে তোলার জন্যে যে ধরনের প্রশাসনিক সক্ষমতার প্রয়োজন তা আমাদের আছে কি না সেটাও ভেবে দেখা উচিত। যদি তা না থাকে তবে আইনের কোনো সুফল আসবে না বা আসেও না। তাই যদি পর্যটন সীমাবদ্ধতাকে আক্ষরিক অর্থে মানতে হয় তবে নৌযানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ হতে পারে একমাত্র উপায়। প্রতিদিন কতগুলো ফেরি, নৌকা, স্পিড বোট যাতায়াত করবে, তা যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায় তবেই কেবল এর সুফল পাওয়া সম্ভব
Published : 07 Sep 2024, 08:57 PM Updated : 07 Sep 2024, 11:07 PM [view this link]
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ৯:০৪