গতকাল পিনাকী এবং ফরহাদ মজহার সাহেবের একটি কথোপকথন ইউটিউবে দেখলাম। ফরহাদ সাহেবের কিছু প্রশ্নের কিংবা উদ্বেগ যাই বলি, তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিহ্বল না হয়ে পারলাম না। কথোপকথনের তিন মিনিট থেকে এগিয়ে যেতে থাকলে, ওনার বক্তব্যের মূল উদ্বেগ হিসেবে আমরা কিভাবে শুধুই লেবার বা শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যাই (যেটা নাও হতে পারতো) সেই প্রশ্নটি রেখেছেন। উনি আরও বলেছেন, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে একটি নিওলিবারেল ইকোনমি তৈরি হয়েছে, যার ফলে বাংলাদেশ গ্লোবাল ইকোনমির কলোনি হয়েছে। তার ভাষ্যমতে, বাংলাদেশকে বহুজাতিক কোম্পানির কলোনি বানানো হয়েছে।
কথাগুলো অসত্য নয়। কিন্তু এর ব্যত্যয় হওয়া কি সম্ভব ছিল? মুক্তবাজার অর্থনীতি এ ক্ষেত্রে কী বলে? আবার যদি মুক্তবাজার অর্থনীতিতে আমরা যুক্ত না হতাম, তবে আমাদের অর্থনীতির পরিণতি কী হতো?
উনি আরও বলেছেন, এই অবস্থাকে ‘সরিয়ে দিয়ে সত্যিকারের উদ্যোক্তাদের আমাদের সমাজে সামনে নিয়ে আসা উচিত, যাদের অবদান আছে, যারা প্রযুক্তি ডেভেলপ করেছেন, বিজ্ঞানকে নিয়ে আসছেন, যারা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারেন...’ (তার বক্তব্যটি আরেকটু বড় ছিল, আমি সংক্ষেপ করেছি)। বক্তব্যটি খুবই আশাবাদী এবং সুন্দর। কিন্তু এই শ্রেণিটি কি বাংলাদেশে আছে? যদি থাকে, তবে তারা কারা?
আমি তাঁর কথার সাথে সহমত পোষণ করে যদি বলি, এটা তো সত্যি যে বাংলাদেশ থেকে যারা বিদেশে কাজের জন্য যান, তাদের বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের মানুষ, যাদের আমরা লেবার বা শ্রমিক বলি। যদিও টেক কোম্পানিতে যারা কাজ করেন, তারাও শ্রমিকই। হয়তো হোয়াইট কলার জব করার কারণে তাদের শ্রমিক বলছি না। কিন্তু আমরা এই ব্লু কলার শ্রমিক কেন হলাম? এর উত্তর তো স্বাধীনতা-উত্তর সক্ষম, শিক্ষিত, আমলা, রাজনৈতিক নেতা, যারা বিদেশে পড়ালেখা করতেন, সুশীল, বুদ্ধিজীবী সমাজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ভালো দিতে পারবেন। আমরা এখানে তাদের কাছে একটা প্রশ্ন রাখতে পারি।
কারণ হিসেবে একটা উদাহরণ টানা যায়, স্বাধীনতার পরে যখন বাংলাদেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি করার জন্য মিল-কারখানা চালু হতে শুরু করল, তখন কেন কোনো মেশিন তৈরির (ক্যাপিটাল মেশিনারিজ) কারখানা স্থাপিত হলো না বা হয়নি? ধরে নিলাম সত্তর দশকে আমাদের জনশক্তির সে সক্ষমতা ছিল না। কিন্তু আশির দশক বা তার পরেও কেন হলো না? যদি ক্যাপিটাল মেশিনারিজ তৈরি কারখানা হতো, তবে অনেকেই প্রকৃত অর্থে প্রকৌশলী বা বুদ্ধিভিত্তিক জনশক্তি হতে পারতো, তাই না? আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ যা কাজের মাধ্যমে প্রকাশিত হবার একমাত্র উপায় বা পথ ছিল, সেটাই। বিগত ৫০ বছরে আমরা হয়তো বেশ কিছু হোয়াইট কলার শ্রমিক পাঠাতে পারতাম, যারা ‘মালয়েশিয়ায় সাপের কামড়ে বা মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমিতে’ মারা যেত না।
কিন্তু আপনারা কেন করলেন না কাজটা? এই দায়ভার কাদের? এটা কি আমার পূর্ববর্তী প্রজন্মের দায় নয়?
যদি আপনারা তৈরি পোশাক শিল্পের ক্যাপিটাল মেশিনারিজ তৈরি না করেন বা না করে থাকেন, তবে তো হোয়াইট কলার শ্রমিক তৈরি করতে পারবেন না। প্রকৌশলী তো তৈরি হবে না, হবে দর্জি। তাই হয়েছে।
এই একইভাবে প্রতিটি শিল্পের উদাহরণ দেয়া সম্ভব বা আমরা নিজেরাই খুঁজে নিতে পারি। কৃষি থেকে ওষুধ, শিক্ষা থেকে রাজনীতি—সবকিছুই তো ফর্মুলেটেড ছিল শুধু লেবার তৈরির জন্য।
এর দায়ভার কার।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৫