একটা প্রশ্নের উত্তর পেলাম না আজও।
কেন পহেলা বৈশাখে ঘটা করে পান্তা-ইলিশ খেতে হয়? ইলিশের সাথে বাঙালির স্বয়ংসম্পূর্ণতার ইতিহাস জড়িত থাকতে পারে। যেমন বলা হয়, মাছে-ভাতে বাঙালি। তবে ইতিহাসবিদরা এটাকে স্রেফ প্রবাদই মনে করেন। কারণ বাংলা অঞ্চলের অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল- ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ (অন্নদামঙ্গল)। দেবীকে সন্তুষ্ট করতে পারলে যদি দুমুঠো খাবার পাওয়া যায়, সেই আশায় উদ্ভব হল মঙ্গল কাব্যের। একথা তো প্রায় সবারই জানা।
কিন্তু পান্তা ভাতের রহস্য কী...?
গ্রামের দরিদ্র কৃষক অথবা দিনমজুর খুব সকালে কাজে বেরিয়ে পড়ে- সূর্য ওঠার আগেই। সে-সময় বাড়ির গৃহিনীরা থাকে ঘুমিয়ে। আগের দিন দুপুরের রান্না-করা ভাত রাতে পানি দিয়ে নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করা হত, সকালে খাওয়ার জন্য। কারণ তিন বেলা রান্না করার মতো সামর্থ্য বা মানসিকতা কখনওই তাদের ছিল না। যাদের অবস্থা ‘দিন আনে দিন খায়’ গোছের তাদের আবার শহরের সাহেবদের মতো গরম ভাত- এত বড়লোকি কপালে নাই- এমনটাই ভাবনা গ্রামের কৃষকদের।
পান্তা ভাতের প্রাসঙ্গিকতাও তাদের ক্ষেত্রেই বেশি প্রযোজ্য। অথচ আমরা শহুরে শিক্ষিতজনরা তাদের নিত্য অপরিহার্যতাকে একদিন উৎসবের দোহাই দিয়ে যে কৃত্রিমতার পরিচয় দিচ্ছি, তা কি নিছক তামাশা হয়ে গেল না? কিংবা তাদের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শনের এই মহোৎসব নিয়ে কেউ কি একটুও সচেতন? প্রশ্ন রইল নিজ বিবেক ও জাতির কাছে?
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সম্রাট আকবর প্রথম বাংলা সন চালু করেন প্রশাসনিক কাজ-কর্ম পরিচালনার সুবিধার্থে। আর পহেলা বৈশাখকে কৃষক-প্রজার বহুদিনের বকেয়া খাজনা পরিশোধ করার সুযোগ দানের জন্য ধার্য করেছিলেন।
আজো গ্রামে-গঞ্জে বাকি টাকা তোলার জন্য পহেলা বৈশাখে ‘হালখাতা’ নামক অনুষ্ঠান করা হয়। ঐদিন কৃষকগণ খাজনা দিতে দরবারে যেতেন। আর দরবারের কর্মচারীরা তাদেরকে মিষ্টিমুখ করাতেন। কৃষকের দেনাশোধের আনন্দ আর সম্রাটের খাজাঞ্চিখানা টইটম্বুর হবার মাঝে মিষ্টিমুখটা দরবারের একটা কূটনৈতিক চালই বটে। কিন্তু তখন পান্তা-ইলিশের কোনো নামগন্ধও ছিল না।
কালক্রমে বাঙালি মধ্যবিত্ত পান্তা-ইলিশ ভোজ প্রথাকে আনন্দের হাতিয়ার হিসেবে লুফে নেয়। কিন্তু কেন এবং কী কারণে এই পান্তা এবং বহুমূল্যের ইলিশকে বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার সাথে যুক্ত করা হল, বোধগম্য নয়।
অথচ বর্তমানে বাঙালির একটা বড় অংশ (বিশেষত শিক্ষিত) পান্তা-ইলিশ প্রথাকে বাঙালি সংস্কৃতির নিদর্শন মনে করে। মধ্যবিত্ত বাঙালি সাধারণত অনুষ্ঠানপ্রিয়, আনন্দপ্রিয় এবং বিশেষ করে ভেড়ার পালের মতো অনুকরণপ্রিয়। নাট্যকার বাদল সরকারের “এবং ইন্দ্রজিৎ” নাটকের একটা উক্তি মনে পড়ছে এ প্রসঙ্গে।
“সব্বাই করে বলে সব্বাই করে তাই”
অর্থাৎ সবাই করছে আমাকেও করতে হবে। কী অদ্ভুত! বাছ-বিচার নেই, জানাশোনার কোনো বালাই নেই। (অনেকে মনে করতে পারেন, আমি খুব বেশি জানি! আসলে তা নয়। আমি আমাদের জাতীয় চরিত্র উল্লেখ করেছি মাত্র। তবে এ গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে একটু সৎ ও সচেতন মানসিকতাই যথেষ্ট।)
...যেখানে কলের চাকার মতো জীবনটা কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে কর্মক্লান্ত যান্ত্রিক নিয়মের মাঝে সেখানে এতকিছু বিবেচনা করার সুযোগ কোথায়? নিত্য চলমান জীবনের ফাঁকে নিজস্ব বিচারবোধকে আড়াল করে সবকিছুর মাঝে উৎসব খোঁজাই আজ মধ্যবিত্তের ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।... এটাই যদি হয় মধ্যবিত্তের মুক্তির পথ, তাহলে আগামী প্রজন্মের জ্ঞানপঙ্গু হয়ে যাবার আশঙ্কা রয়েই যায়।