মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আবু কায়েস মাহমুদ, মোঃ মোহসীন দুলাল, জাকির হোসেন, মাহমুদুল হোসেন চৌধুরী প্রমুখের নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এ এলাকার বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ আনিছুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা নিম চন্দ্র ভৌমিক, সাহাবউদ্দিন মিন্টু ও স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খসংগঠিত করার কাজ শুরু হয়।
এপ্রিলে পাকিস্তানি বাহিনী নোয়াখালীতে প্রবেশ করার কিছুকাল পরও গোপালপুর রয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের দূর্জয় ঘাঁটি হিসাবে; পরিণত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটিং সেন্টারে। চলতে থাকে যুদ্ধের প্রাথমিক কলাকৌশলের ট্রেনিং। সময়ের সাহসী সন্তানেরা দলে দলে প্রাথমিক ট্রেনিং সমাপ্ত করে চূড়ান্ত ট্রেনিং গ্রহণের জন্য গোপনে চলে যেতো বজরার বগাদিয়া আফানিয়া হয়ে ভারতের দিকে। গোপালপুর এভাবেই পালন করে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে এক অগ্রণী ভূমিকা। এ খবর পৌঁছে যায় জামাত, মুসলীম লীগ ও শান্তি কমিটির মাধ্যমে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কাছে। তারা কয়েক দফা চেষ্টা চালায় এ এলাকার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের খুঁজে বের করার জন্য। দেখতে দেখতে চলে আসে বর্ষা।
সময়টা ১৯৭১ সালের আগস্ট মাস। প্রচুর বৃষ্টি হয় সেবার ১৮ আগস্ট রাতে। ভোররাতে বেগমগঞ্জ লক্ষীপুর সড়কের কাছে বাংলাবাজার শামসুননাহার হাইস্কুলে এসে অবস্থান নেয় বেশ কিছু পাকিস্তানী মিলিশিয়া ও রাজাকার। ১৯ আগস্ট সকাল বেলা - সূর্য তখনো মেঘের আড়ালে ঢাকা। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। সকাল আনুমানিক আটটা নাগাদ গোপালপুর বাজারে পৌঁছে যায় প্রায় কয়েকশ পাকিস্তানী আর্মি ও রাজাকার। তারা দুভাগে বিভক্ত হয়। রাজাকারদের কুড়ি/পঁচিশ জনের একটি দল বাজারের পশ্চিমদিক দিয়ে এবং বাকীরা মূল রাস্তা দিয়ে এসে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে। সকাল থেকেই বাজারের প্রায় অর্ধশতাধিক দোকান অগণন মানুষের প্রাণচাঞ্চল্যে মুখরিত ছিলো। কেউ চা পানে রত। আবার কেউ গতরাতে আশেপাশের কোন কোন এলাকায় গোলাগুলি হয়েছে তার অবস্থান নির্ণয় নিয়ে বিতর্করত। এমন সময় অতর্কিত হানা দিলো পাকিস্তানী হায়েনার দল। যারা পালাতে পারলো তারা বাঁচলো। যারা পারেনি এরকম অর্ধশতাধিক দূর্ভাগা নিরীহ গ্রামবাসী ও দোকানী শিকার হল নির্মম হিংস্রতার। একে একে ওদের সবাইকে ধরে এনে এক লাইনে দাঁড় করানো হয় বাজারের পূর্বপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট খালটির পাড়ে। এ দলে ছিলেন ঐ এলাকার শান্তি কমিটির নেতা। তার অপরাধ তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিতেন। তাঁর কাছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কমান্ডিং অফিসার জানতে চায়- আনিস ডাক্তার, সুবেদার মেজর জবেদ আলী কোথায়? কোনো দেশপ্রেমিক মুক্তিপাগল মানুষ তাদের এ প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নয় এবং তারা এর কোন জবাব কোনদিনই পায়নি। বাজারের দোকানে দোকানে তল্লাশি করে খুঁজতে থাকে স্বাধীন বাংলার পতাকা। জনৈক ছিদ্দিকউল্যাহর দোকানে ওরা পেয়ে যায় স্বাধীন বাংলার একটি পতাকা।- ক্রোধে ফেটে পড়ে ওরা। লাইনে দাঁড়ানো কয়েকজন মুসল্লিকে ছেড়ে দেয়া হয়। বাকী প্রায় পঞ্চাশজন নিরপরাধ নিরস্ত্র মানুষকে ব্রাশফায়ার করে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ব্রাশফায়ারের পরও যারা বেঁচেছিলো তাদেরকে বেয়নেট চার্জ করে পৈশাচিক উল্লাস প্রকাশ করার পর পাকিস্তানী পশুরা হত্যা করে। মানুষের তাজা রক্তে সয়লাব হয়ে যায় খালের পানি। রক্ত আর পানিকে পার্থক্য করা যায়নি। এই হতভাগ্য মানুষদের অপরাধ ছিলো- তারা বলেনি কারা এলাকার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, কারা মুক্তিযোদ্ধা। তাদের অপরাধ, দোকানে পাওয়া যায় স্বাধীন বাংলার পতাকা।
এই হত্যাকান্ড জঘন্য বর্বরতা। মানবতাবিরোধী। নোয়াখালীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গোপালপুরের এই গণহত্যা এক কালো অধ্যায়। এই ঘটনায় যারা শহীদ হন তাদের পঁচিশ জনের নাম পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়:
১. মাহবুবুল হায়দার চৌধুরী [নশা মিয়া] (গোপালপুর)
২. দীন ইসলাম (তুলাচরা)
৩. হাবিব উল্যাহ (তুলাচরা)
৪. ইসমাঈল মিয়া (তুলাচরা)
৫. অহিদউল্যাহ (সাহাদাপুর)
৬. মোহাম্মদউল্যাহ (সাহাদাপুর)
৭. মোহাম্মদ উল্যাহ (সাহাদাপুর)
৮. দুলাল মিয়া (সাহাদাপুর)
৯. সামছুল হক মাস্টার (আটিয়াকান্দি)
১০. মজিবউল্যাহ (আটিয়াকান্দি)
১১. বশিরউল্যাহ (আটিয়াকান্দি)
১২. আবুল কাশেম (মির্জানগর)
১৩. আবুল বশর ছিদ্দিক (মির্জানগর)
১৪. হারিছ মিয়া (দেবকালা)
১৫. ছিদ্দিক উল্যাহ মিয়া (সিরাজউদ্দিনপুর)
১৬. মমিনউল্যাহ মিয়া (মুহুল্লাপুর)
১৭. মন্তাজ মিয়া (মহল্লাপুর)
১৮. নূর মোহাম্মদ (মহল্লাপুর)
১৯. আবদুল মন্নান (মহল্লাপুর)
২০. মোবারক উল্যাহ (পানুয়া পাড়া)
২১. মোহাম্মদ উল্যাহ দর্জি (চাঁদ কাশেমপুর)
২২. আবদুর রসিদ (আমিরাবাদ)
২৩. আবদুল সাত্তার (বারাহীনগর)
২৪. আবদুল করিম (হীরাপুর)
২৫. ডা: মোহাম্মদ সুজায়েত উল্যাহ (দশঘরিয়া, চাটখিল)
১৯৭১ সালের ১৯ আগস্টের এই নিষ্ঠুর গণহত্যার স্মরণে গোলাম ছাত্তার নোমান, তপন কুমার ভৌমিক প্রমুখের প্রচেষ্টায় ১৯৮০ সালে শহীদদের নাম খোদাই একটি স্মৃতিস্তম্ভ ও শহীদ স্মৃতি সংসদ গড়ে উঠে। প্রতি বছর এই দিনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।
[লেখক: গোলাম আকবর, সদস্য সচিব, নোয়াখালী মানবাধিকার জোট]