somewhere in... blog

যাও পাখি বল, হাওয়া ছল ছল, আবছায়া জানলার কাঁচ [গল্প]

১৩ ই জানুয়ারি, ২০১০ দুপুর ২:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লোকটির নাম সামছু। ছামছু বা সামসু হল না কেন, ছোটবেলা থেকেই এ প্রশ্নের তেমন কোন সদুত্তর দিতে না পারলেও সবসময়ই শুনতে হয়েছে এই প্রশ্নটা। সরকারি চাকরিজীবি বাবার সূত্রে পাওয়া তার চাকরিটাও সরকারি। সব বাবা-মায়ের মতই তার বাবা-মায়ের ইচ্ছে পূর্ণ হয়েছে, পদমর্যাদায় সামছু তার বাবার চাইতে উপরে। বাবা সালেক মোল্লা রেলওয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মকর্তা, তার সন্তান হিসেবে সামছু মিঞার তৃতীয় শ্রেণীর পদমর্যাদা অবশ্যই উপরের স্তরের!! পাঠক, আপনারা যারা এতক্ষণ ধরে সামছু আর তার বাবার বিস্তারিত পড়ে ভাবছেন গল্প শুরু হয়ে গিয়েছে, তাদের জন্য দু:সংবাদ!! গল্পের এখনো শুরুই হয় নি। আসুন, গল্প শুরুর আগে সামছু মিঞার পরিবারের আরো কয়েকজনের সাথে পরিচিত হই।

সামছু মিঞার স্ত্রীর নাম মৃণাল। ভাল নাম রোখসানা আমিন। কিন্তু, কোন এক বিচিত্র কারণে সামছু কেন যেন তাকে মৃণালই ডাকে। যদিও মৃণাল তাকে মাঝে মাঝে সামছু মিঞাদের পৈত্রিক ভিটার অবস্থান হিন্দু পাড়ায় হওয়ায় কোন এক অচেনা নারীকে ইংগিত করে খোঁচা দিতে ভোলেন না!!

তিন মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে সামছু মিঞার সংসার। পরপর তিন মেয়ের পর চতুর্থবারের বার সামছু মিঞার পুত্র সন্তান লাভ। একে তো সবার ছোট, তায় আবার ছেলে। সবার আদরের। যথারীতি যা হয়, রাজার সেই বিখ্যাত বাঁদরকে যেমন লাঠির বাড়ি না দেয়াতে তার মাথায় উঠে তবলা বাজিয়েছিল, তার মত না হলেও অনেকটা সেরকমই!! ইতিমধ্যেই ছেলের নামে প্রচুর অভিযোগ একে ঘুঁষি, তাকে গালে চড়, ওকে কনুইয়ের গুতো!! পাঠক যারা এবার নড়েচড়ে বসেছেন, হ্যাঁ, এইতো লাইনে এসে পরছে, পোলাপাইনকে নিয়াই কাহিনী আগাইবো। বিশেষত, ছেলেটাকে নিয়ে। তাদের জন্য সুসংবাদ এবং দু:সংবাদ। কাহিনী মোটামুটি তাদের নিয়েই, তবে কেবল ছেলেটিকে নিয়ে নিশ্চয়ই না।

ও, ইতোবৎসরে একটা কথা জানিয়ে রাখা ভাল, সামছু মিঞা আরেক দিকেও তার বাবাকে ছাড়িয়ে। তার বাবা যেখানে এখনো গ্রামেই পরে রইলেন, সামছু মিঞা ইদানীং রাজশাহী শহরের বাসিন্দা। শহরের নিমতলা চৌমাথা ছাড়িয়ে গজ পঞ্চাশেক এগুলেই হাতের বাঁ পাশে যে টিনের ঝুপড়িগুলো আছে, সেখানে তার বাস। বাসস্থান নিয়ে সামছু মিঞার বক্তব্য বেশ মজার। ”বাসার সামনে একটা নামফলক বসানো ’দরিদ্র পুর্নবাসন প্রকল্প’; যার ভিত্তিপ্রস্তরে প্রধান অতিথির নাম প্রতি পাঁচবছরে একবার করে বদলায়, সাথে করে বদলায় ভাড়া নেলেওয়াদের চেহারা আর নাম, শুধু বদলায় না এখানকার ভাড়াটেরা।” দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময়ে ৭জনের সংসার সামলাতে তার স্ত্রীই যথার্থ। গুণে গুণে কাঁচামরিচ কেনা মহিলা!! তাও সবদিক সামলিয়ে চলা দায়। তাই পরিবারকে গ্রামে রেখে তিনি থাকেন শহরে একা। বিশেষ কোন পাড়ায় যান না, কোন কিছুর অভ্যাস নেই, কোন কিছুর চাহিদাও নেই তেমন।

কদিন আগে হঠাৎ বাড়ি থেকে স্ত্রীর ফোন। ”সবাই একবার শহরে আসতে চাই। সক্কলে মিল্লা একলগে বাজার করমু। ঈদের কেনাকাটা।” মাছি তাড়ানোর মতই হাত ঝাড়িয়ে স্ত্রীর কথা উড়িয়ে দেন তিনি। মৃণালও কম যাননা। আগে থেকেই তৈরি!! মোক্ষম অস্ত্রটা তূণ থেকে বের করেন; ছেলের হাতে মোবাইল ধরিয়ে দেন!! ফলাফল? সপ্তাহ না ঘুরতেই নিমতলার বাসার ঘরটির লোকসংখ্যা এক থেকে বেড়ে চারে উন্নীত!!

যাই হোক। আম্রা মূল গল্পে প্রবেশ করি। গল্পের প্রেক্ষাপট জানা গেল। গ্রাম থেকে আসা স্ত্রী, ২ ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ঈদ কেনাকাটায় বেরুনো এক লোকের গল্প।
সপরিবারে বেড়িয়ে তিনি রিকশা নেন না মৃণালের বাধায়। হাঁটতে হাঁটতে পৌছে যান শহরের মধ্যবিত্তদের বাজার বলে পরিচিত নিউমার্কেটে। প্রথমবাবের মত শহরে এসে ছেলেমেয়ে দু'টোরই চোখ ছানাবড়া!! যা-ই দেখে তাতেই তারা অবাক! এটা কিনবে, ওটা কিনবে, সেটা কিনবে, বাইরের রং-চং দেখে তারা উতলা। মৃণালের চোখও জ্বলজ্বলে। আজীবন ফেরিওয়ালার ঐ কাঁচের বাক্সের ভেতরে থাকা তিব্বতের স্নো আর পাউডার ব্যবহার করে অভ্যস্ত যে নারী, তার চোখ একটু পরপরই আটকে যায় ল্যাভেন্ডার, জর্ডানা বা লিভনের লোভনীয় শারীরিক কাঠামোর বোতলগুলোর দিকে।
বায়না করে বাচ্চাগুলো। ঈদের বাজার। কাপড়-চোপড়ে সয়লাব। দোকানে, দোকানের বাইরে, যাদের দোকান নেই তারা একটা টুল-টেবিল নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসে। হই-হুল্লোড়ের মাঝে দোকানে ঢুকে বাচ্চাদের জন্যে কাপড় পছন্দের পালা শুরু। মৃণাল আর বাচ্চাদের উপর যাচাই-বাছাইয়ের ভার দিয়ে একটু আড়ালে গিয়ে আনমনে পকেটে হাত দিয়ে কাগজের টুকরোগুলোর অস্তিত্ব অনুভব করেন। আর, অবচেতনভাবেই ভ্রু দু'জোড়া একটু কুঞ্চিত হয়। "বাবা, বাবা", বাচ্চাদের ডাকে বাস্তবে ফিরে আসেন। আবার হাসিহাসি মুখোশ লাগিয়ে তাদের দিকে ফেরা।

পাঠকরা যারা এখন একটা "হ্যাপি এন্ডিং" এর প্রাত্যাশায় আছেন, তাদের জন্যে দু:সংবাদ। এটা গল্প, গল্প হলেও "গল্পের গরু গাছে উঠে গিয়ে তা-ধিন-ধিন নাচবে" এমনটা না।

তাই, ছেলের জন্যে শার্ট, মেয়ের জন্যে কামিজ দেখা হয়, দাম জিজ্ঞেস করে আবার প্রথমে পছন্দ হওয়া শার্ট/ কামিজ ছেলে-মেয়েকে মানাবে না এই বলে দোকান থেকে খালি হাতে বেরিয়েও আসা হয়। এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে, চলতেই থাকে একবার, একাধিকবার, বার বার। ছেলে-মেয়ের উচ্ছলতা কমতে থাকে, মৃণালের চোখের রঙিন চমশা ধূলি-ধূসরিত হতে থাকে। আর, সামছু মিঞার মুখোশ আস্তে আস্তে ছিড়তে থাকে। তার, কষ্টক্লান্ত মুখ আর ঢাকা থাকে না কোন মুখোশে। কেমন যেন একটা অবসাদের ছায়া ফুটে ওঠতে শুরু করে। আর, একটা সময়ে সেটা পুরো মুখটাকেই গ্রাস করে নেয়।

পাঠক, আমরা এবার বরং তাদের ছুটি দেই। তারা তাদের নিজের ঈদের বাজার নিজেরাই করুক।
৪৫৬ বার পঠিত
৪৬টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এক্স লইয়া কি করিব

লিখেছেন আনু মোল্লাহ, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৫১

যাচ্ছিলাম সেগুনবাগিচা। রিকশাওয়ালার সিট কভারটা খুব চমৎকার। হাতে সেলাইকরা কাঁথা মোড়ানো। সুন্দর নকশা-টকশা করা। নর্মালি এররকম দেখা যায় না। শৈল্পিক একটা ব্যাপার। শুধু সিটকভার দেইখাই তার-সাথে কোন দামাদামি না কইরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইলিশনামা~ ১

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭


১৯৮৫ সালে ডক্টর মোকাম্মেল হোসাইন ‘ ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে যেই রিসার্চ পেপারটা( থিসিস – এম এস এর জন্য) জমা দিয়েছিলেন সেটা এখানে মিলবে;
[link|https://open.library.ubc.ca/cIRcle/collections/ubctheses/831/items/1.0096089|Spawning times and early life history of... ...বাকিটুকু পড়ুন

৯০% মুসলমানের এই দেশ? ভারতে কতগুলো মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির করা হয়েছে? গতকালও ভারতে মসজিদের পক্ষে থাকায় ৩ জন মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৪২

সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার | SAD

লিখেছেন আজব লিংকন, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৩



শীতকালীন সর্দি-কাশি, জ্বর, হাঁপানি, অ্যালার্জিক রাইনাইটিস, কনজাংকটিভাটিস, নিউমোনিয়া কিংবা খুশকি মতো কমন রোগের কথা আমরা জানি। উইন্টার ডিসঅর্ডার বা শীতকালীন হতাশা নামক রোগের কথা কখনো শুনেছেন? যে ডিসঅর্ডারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

চট্টগ্রাম আদালত চত্বরের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে লিখছি

লিখেছেন শান্তনু চৌধুরী শান্তু, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:৪৮



আজ চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তা নানান গুজব ও ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা এড়াতে প্রকৃত ঘটনাটি নিরপেক্ষভাবে একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে লিখছি।

চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×