তুমি কি ভাবছ আর্মিরা এখানেও আসবে? নাসিরের উদ্দেশ্যে বলে উঠে জাভেদ।
ওরা সব জায়গায় যাবে। কাউকে রেহাই দেবেনা। তবে এখনই এখানে আসবে না, আগে ওরা বড় বড় শহরগুলিতে যাবে তারপর একে একে, নাসির কথা শেষ করে না। কিন্তু সবাই বুঝে যায় তারপর কি হবে। নূরী ভয়ে আতংকে জমে যায়। সে কোনরকমে বলে তোমরা যে এসব করছ ওরা যদি জেনে যায়, তাহলেতো তোমাদের সবার আগে মেরে ফেলবে?
দুর আপা ওরা আসা পর্যন্ত আমরা এখানে থাকব নাকি! গা ঢাকা দিয়ে ফেলব। ওসব নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমি যতক্ষন আছি ছেলেদের নিয়ে কোন চিন্তা নাই।
চিন্তা নাই বললেই তো আর হল না। নূরী আর জাভেদের দুঃশ্চিন্তা শুরু হল। ওরা এবার কোথায় যাবে? লিচুতো নাসিরের এত অন্ধভক্ত হয়েছে ওকে কোথাও যাওয়ার কথা বললেই বলে তোমরা যাও, আমি এখানেই থাকব। নূরী জীবন থাকতে কখনো ছেলেকে ছেড়ে যাবে না। জাভেদও তাই। ওরা খালি দিন গুনতে থাকে কখন কেয়ামত নাজেল হয়।
এপ্রিলের মাঝামাঝি হয়ে গেল, পাকিস্হানি আর্মি ওদের গ্রামে আসলো না। এর মধ্যে ওরা শুনে ফেলেছে বাঙলাদেশের জন্য মুক্তি সংগ্রাম সংগঠিত করা হচ্ছে। অনেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম লিখিয়েছে। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষন দেওয়া হচ্ছে। লিচু আর নয়ন এর মাঝে কয়েক বার ভারতীয় সীমানায় চলেও গেছে। ওদের সীমান্ত এলাকায় এখনও কোন শরনার্থী শিবির খোলা হয় নি। কারন এই দিক দিয়ে শরনার্থীরা এখনও দলে দলে আসতে শুরু করেনি। ওদের এলাকা শান্ত, নিঝুমপুরীর মত। গ্রামের লোকেরা নিজেদের কাজ কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও শহরে কি হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নাই।
এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে পাকিস্হানি আর্মির দেখা পাওয়া গেল। ওরা আসলো ট্রেন আর ট্রাক ভড়ে। লিচুর নানাবাড়িতে প্রথম আর্মি হানা দেয় মাঝরাতে। ট্রেন থেকে নেমেই গ্রামের মানুষের বাড়িতে চড়াও হয়ে হত্যাযজ্ঞ চালান শুরু হয়। লিচুর বড় মামার পরিচয় পাওয়ার সাথে সাথে উনাকে বন্দী করে নিয়ে যায়। বড় মামার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। আশেপাশের বাড়িতেও হানা দিয়ে ছেলেদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এখবর পাওয়ার সাথে সাথে নাসির ছেলেদের নিয়ে সীমান্তের ওপারে চলে যায়। ইতিমধ্যে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ক্যাপ্টেন কুমার আর ক্যাপ্টেন নিয়োগীর সাথে নাসিরের পরিচয় হয়। ওরা নাসিরকে সর্বাত্নক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। লিচু ইতিমধ্যে মতিনের মাধ্যমে মা বাবার সাথে যোগাযোগ করেছে। ভালই আছে নূরী আর জাভেদ। খালি লিচুর জন্য দুঃশ্চিন্তায় অস্হির। মাকে দুঃশ্চিন্তা করতে না করে লিচু। নূরীর মন মানে না।
লিচুর সাথে দেখা হয় না কতদিন। নূরী দিন গোনে এইতো আর মাত্র কয়েকদিন। তারপরই লিচু চলে আসবে, মাকে ছেড়ে লিচু থাকতেই পারবে না। মতিনের কাছে শোনে লিচু অনেক বড় মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে, সবাই ওকে মান্য করে, ওর কত বন্ধু। লিচুর সময় নাই এখন মায়ের কাছে আসার। ওর আরো বড় কাজ বাকি, দেশ স্বাধীন করে একবারে ফিরবে।
ভরা শ্রাবনে অপারেশন থেকে ফেরার পথে লিচু আরো মুক্তিযোদ্ধাসহ পাক বাহিনীর হাতে ধরা পরে। লিচুকে ওরা নদীর ধারে নিয়ে গুলি করে। লাশ নদীর স্রোতে ভেসে কোথায় চলে যায় কেউ জানে না। নূরীর কাছে যখন খবরটা আসে সে তখন ছেলের জন্য ইলিশ মাছ রান্না করছিল। মাঝে মাঝে ক্যাম্পে লিচুর জন্য মতিনের হাতে দিয়ে খাবার পাঠায় । এই রান্নাটা নূরীর শেষ হয় নি।
(শেষ)
বিঃদ্রঃ চরিত্রগুলো সব কাল্পনিক। শুধু লিচুরটা ছাড়া। আম্মার কাছে লিচুর গল্প শুনেছি।গল্পের মত সে নিরীহ ছিল না। গ্রামের অত্যন্ত দুরন্ত ডানপিটে কলেজ পড়ুয়া কিশোর ছিল। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সে খুব নাম করেছিল। জুলাই মাসে তার মৃত্যুবার্ষিকি ছিল।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৮ সকাল ৯:০৬