নয়ন আসার পর লিচুর সময় বেশ দ্রুতই যেতে লাগলো। সারাদিন প্রায় ওরা নাসিরের ওখানেই থাকে। সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরে। নূরী এখন আর লিচুকে কিছু বলে না। বরং ওরা সবাই মিলে রাতে বিবিসি শোনে, এটাই মনে হয় সবার ধ্যান হয়ে গেছে কখন সাড়ে সাতটা বাজবে। উত্তেজনা নাই, খালি শুনে যায় আর নিজের মনে চিন্তা করে।
তেইশে মার্চ পার হয়ে গেল। লিচুরা বাঙলাদেশের পতাকা উড়াল। নূরীও সাহায্য করলো। নূরীর নিজের ছোটবেলার কথা মনে পরছিল। যখন পাকিস্হান আর ভারত ঘোষনা করা হয় তখন তাদের মধ্যে যে উত্তেজনা ছিল, সেটা যেন সে লিচুর মধ্যে দেখতে পারছে। এ নিয়ে লিচুর খুব উৎসাহ লাগলো, মাও অন্তত বাঙলাদেশের পতাকার জন্য কাজ করছে। নূরী নিজের হাতে সেলাই করে পতাকা বানিয়ে দিল। ইতিমধ্যে খবর পেল নানার বাড়িতে পতাকা উড়ানো হয়নি। জানত হবে না। নানা বেঁচে থাকতে এটা করতে দিবেনা।
পরের দু'দিন ঘটনাবিহীন ভাবে চলে গেল। ছাব্বিশে মার্চ ভোর রাতের দিকে নাসির এসে হাজির। লিচুরা ঘুমে অচেতন। জাভেদ আর নূরী উঠে নাসিরকে ভিতরে এনে বসায়। নাসির ভীষন উত্তেজিত। সে ওয়ারলেসে শুনেছে ঢাকায় আর্মি নেমে গেছে, শেখ মুজিবকে মেরে ফেলেছে কিনা সেটা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। অনেক সাধারন মানুষকে মেরে ফেলেছে। উত্তেজিত কথা বার্তা শুনে লিচু আর নয়ন ঘুম থেকে উঠে গেল। ওদের সারা শরীর থর থর করে কাঁপছে। ভয়ে না রাগে বুঝতে পারছে না। কেন নিরীহ মানুষ মারা গেল, ওরা কি করেছিল, লিচু কোন উত্তর খুঁজে পায় না। সকালে নাস্তা খেয়ে নাসির চলে গেল। সবাই চুপ। ভয়ংকর এক দুঃস্বপ্ন যেন সত্যি হয়ে গেল। কারো মুখে কোন কথা নেই। অনিশ্চিত ভবিষ্যত যেন আবার সবাইকে গ্রাস করল। কি হবে, কে তাদের পথ দেখাবে, কি করবে তারা হাজার প্রশ্ন নিয়ে লিচু আর নয়ন নাসিরের ওখানে হাজির হয়।বার বার করে জাভেদ আর নূরী ওদের যেতে নিষেধ করে, কিন্তু ওরা কোন বাধাই মানে না।
অনেক ক্ষন পরে মনুরা এসে হাজির হয়। ওরা কোন কিছু শুনে নাই। সব শুনে সবাই ক্ষেপে গেল। কিন্তু পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে এনিয়ে সবাই চিন্তা ভাবনা শুরু করল। নাসির বলে উঠে আমাদের এখন খুব সাবধানে থাকতে হবে। আমার মনে হয় আর্মিরা কেবল ঢাকায় থাকবে না। সারাদেশে ছড়িয়ে পরবে। সুতরাং এখন খালি অপেক্ষা কখন ওরা আসে।
যখন আসবে, কি করব? লিচু বলে উঠে।
বল কি করা উচিৎ?
এরকম ঘটনার পর আরতো ওদের সাথে থাকার কথা চিন্তাও করা যায়না। যে কোন ভাবে ওদের তাড়াতে হবে। কিন্তু কিভাবে সেটা সম্ভব?
খুব সোজা। যুদ্ধ করে।
আমরা কি দিয়ে যুদ্ধ করব? আমাদের অস্ত্র কোথায়?
যোগার করতে হবে। সেসব নিয়ে আপাতত না ভাবলেও চলবে। আমি দেখি কি করা যায়। যাও তোমরা এখন ট্রেনিং নাও, আর কোন অজুহাত নয়। এই ট্রেনিংই অকাল মৃত্যু থেকে তোমাদের বাঁচাবে।
আজ লিচু আসার সময় মতিনকেও সংগে এনেছিল। সে খুব উৎসাহের সাথে সব কিছু শিখে ফেলল। নাসিরও ওর খুব প্রশংসা করল। লিচুর খুব ভাল লাগলো। মতিনের মাথাটা আসলেই ভাল। আহা ছেলেটা যদি পড়াশোনার সুযোগ পেত অনেক বড় হতে পারত। আচ্ছা লিচু চেষ্টা করলেই তো পারে। জাভেদকে বললেই সে মতিনকে স্কুলে ঢুকিয়ে দিবে। আজকেই বাবাকে বলতে হবে। সে মতিনের কাঁধে হাত রাখল। যেন লিচুর ছোট ভাই।
সারাদিন ট্রেনিং নিয়ে ওরা সবাই ক্লান্ত। কিন্তু সব ক্লান্তি মুছে গেল যখন শুনল আগামী কাল ওদের বন্দুকের ট্রেনিং দেওয়া হবে। সবাই পারলে আরো একবার দেখিয়ে দেয় তারা উপযুক্ত হয়ে গেছে বন্দুক ধরার। কি উৎসাহ সবার। নাসির সবার মাঝে দেশ মুক্ত করার প্রত্যয় জাগিয়ে দিতে পেরেছে, এতে সে বেশ গর্ব বোধ করে। কিন্তু সেইসংগে সে মুষড়েও পরে। যদিও ছেলেদের সে জানাতে চায় না। পাকিস্হানি আর্মি কাউকে ছেড়ে দেবে না। ওরা সবাইকে নিঃশেষ করে ফেলবে। নাসিরের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস পরে। ভবিষ্যত যে এত তাড়াতাড়ি অন্ধকার হবে সে ভাবে নি।
দিন কয়েক পরের কথা। আবার গভীর রাতে নাসির ওদের বাড়ি এসে হাজির। সে জানতে পেরেছে পাকিস্হানি আর্মিরা এখন ছড়িয়ে পরছে সারা বাঙলায়। যেখানেই যাচ্ছে মানুষ মেরে ফেলছে। বাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে, লোকজন ভয়ে পালানো শুরু করেছে। সবাইর লক্ষ্য নিরাপদ অবস্হানে সরে যাওয়া। বেশির ভাগ মানুষই সীমান্তে জড়ো হচ্ছে। যদি বিপদের আশংকা বাড়ে তখন ভারতে ঢুকে যাবে।
লিচুর শব্দভান্ডারে নতুন শব্দ যোগ হল। শরনার্থী। যারা প্রানের ভয়ে ঘর বাড়ি, ভিটে মাটি ছেড়ে এক কাপড়ে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে তাদেরকে শরনার্থী বলা হচ্ছে ভারতীয় রেডিও থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৮ দুপুর ১:২৩