লিচুদের সময় কাটতে লাগল খুব ধীরে। একেবারে অজপাড়া গাঁয়ে চলে এসেছে। বাজার বলতে হাটে যাও। তাও মাত্র সপ্তাহে একদিন, রবিবার।যার যত কেনাকাটা হাটের অপেক্ষায় থাকে। বাইরের দুনিয়ার খবর বলতে লিচুর রেডিও ভরসা। তাও ব্যাটারি প্রায় ফুরিয়ে আসছে, লিচু সারাদিন রোদে ব্যাটারি দিয়ে রাখে, রাতে বিবিসি শোনার জন্য। এর মধ্যে ক্যাপ্টেন নাসির এসে দাওয়াতে খেয়ে গেল। খুব খুশি সে আর তার লোকজন। নূরী অনেক যত্ন করে রান্না করে খাওয়াল। লিচুর সাথে নাসিরের ভালই জমে উঠল।
লিচুর ঘরে পুরোন পত্রিকা দেখে সেও পড়ল। অনেক আলাপ করল দেশের ভূত ভবিষ্যত নিয়ে। জাভেদেরও খুব ভাল লাগলো নাসিরকে। এখানে বেচারি পরিবার বিচ্ছিন্ন অবস্হায় রয়েছে। সীমান্তে থাকাকালিন পরিবার আনতে পারবে না। বাড়িতে মা বাবার কাছে বউ আর ছোট্ট মেয়ে, সুখীকে রেখে এসেছে। কি সুন্দর নাম রেখেছে। লিচুর খুব ভাল লাগে নামটা। মানিব্যাগ খুলে ওদের ছবিও দেখাল। বরিশালে তার গ্রামের বাড়ি। জাভেদ আর নূরীদের ওর বাড়িতে যাওয়ার জন্য দাওয়াত দিয়ে রাখল। ওর সরলতায় সবাই হাসে, জানে সেটা কোনদিন পূরন হবে না। তবে ভাবে কেউ প্রকাশ করে না।
দুপুরের খাওয়া শেষ করে নাসির আর লিচু পুকুর ঘাটে গিয়ে বসে। নাসির সিগারেট ধরায়। লিচুকেও একটা দেয়, সে মাথা নাড়ে, খায় না। নাসির একটু অবাক হয়। এবয়সি ছেলেরা সিগারেট লুফে নেয়, পারলে বড়দের কাছ থেকে চুরি করে, আর লিচু খায় না। বলেই ফেলে আরে তুমিতো এখনো বাচ্চা আছ, সিগারেট খাও না। শোন সিগারেট খাওয়া হল পুরুষের কাজ। তুমি যদি না খাও লোকজন তোমাকে সব সময়ই বাচ্চা মনে করবে। বিরাট লেকচার দিল।নাসির খুব গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞাসা করে লিচু তুমি কি ভাবছ আমাদের রাজনৈতিক অবস্হা নিয়ে?
লিচু থতমত খেয়ে গেল। কি বলবে বুঝছে না। তাকে কেউ কখনও বড়দের মত করে জিজ্ঞাসা করে নি। সে একটু আমতা আমতা করে। কি বলে নাসির বুঝে না। একই দিনে এত কিছু একসাথে ঘটছে, লিচুর তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। নাসিরের মত লোক তার বন্ধু, সিগারেট খাওয়ার জন্য মনটা আঁকিবুকি করছে, কি করে সে! আচ্ছা একটা সিগারেট ধরাবে নাকি। সে মন্ত্রমুগ্ধের মত হাত বাড়ায়। নাসিরের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ধরাতে চায়, পারে না। পুরা সিগারেট ঠোঁটে রাখতে রাখতে ভিজে গেল, ধরান হল না। দিয়াশলাই ধরাতে আরেকটু হলে সে তার ভুরু পুরিয়ে ফেলত। নাসির তার সিগারেট ধরিয়ে বুদ্ধি দেয়, আস্তে করে টান, নাহলে। লিচুর আর শোনা হয় না নাহলে কি হবে। সে জেনে গেল। জোরে টান দিতেই গলার ভিতরে ধোঁয়া গিয়ে তার কাশি শুরু হয়ে গেল। চোখ দিয়ে পানি পরতে লাগল। নাসির বোকা হয়ে তাকিয়ে থাকল। কি করবে বুঝে উঠে না। পরে সে দৌড় মেরে লিচুদের বাড়ি গিয়ে পান সুপাড়ী নিয়ে আসল। পুকুর থেকে পানি নিয়ে লিচুর মুখ ধুয়ে পান খেতে দেয়। একটু পরে বলে তুমি ঠিক আছ এখন?
লজ্জায় লিচুর কথা সরে না। সে কোনরকমে ঘাড় নাড়ে, ঠিক আছে।
শোন যা বলছিলাম, তুমিতো সারাদিন বসেই থাক। কাল আমার ওখানে আস। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিব। তারপর আলাপ করব। এখানকার ছেলেদের নিয়ে একটা কিছু করা দরকার, খুব শীগগির। না হলে দেরি হয়ে যাবে, হাতে সময় একদম নাই। তাহলে তুমি কাল আসছ! লিচুর কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে, প্রত্যেকদিন একটু একটু করে সিগারেট খাওয়া অভ্যেস করলেই হবে। আমি প্যাকেটটা রেখে যাচ্ছি। আজ চলি।
পরদিন লিচু সকাল থেকেই তৈরি। নাসির গাড়ি পাঠাবে তারজন্য। বাড়ির সবাইকে সে হাজারবার বলে রেখেছে। জাভেদ আর নূরী হাসে লিচুর কান্ড দেখে।সকাল পার হয়ে দুপুর হয়ে গেল, গাড়ির দেখা নেই। বিকালও প্রায় শেষ নাহ গাড়ি এলো না। লিচুর ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। যেটা তার সবসময়ই হয়। সে নাসিরকে অন্যদের থেকে আলাদা ভেবেছিল, আসলে সবাই একরকম। কেউ তাকে তেমন করে পছন্দ করে না। নূরীকে বলে লিচু হাঁটতে বেরোয়। সারাটা দিন অপেক্ষা করে করে তার মাথাটাই ঝিমঝিম করছে।পুকুর পাড় দিয়ে যাবার সময় তার গতকাল দুপুরের কথা মনে হয়। মুখে হাসি ফুটে লিচুর। আচ্ছা নাসিরের কি হল? কোন বিপদ হল নাতো? হঠাৎ করে তার চিন্তা শুরু হল। এরকম তো হওয়ার কথা না, নিশ্চয়ই কোন অসুবিধা হয়েছে।
তারপরের দিনও নাসির এলো না। তিনদিনের দিন নাসির নিজেই এসে হাজির। রান্নাঘরে ঢুকে নূরীকে বলে আপা চা দিলে ভাল হয়। নিজেই নূরীর হাত থেকে চা নিল। কি লিচু খুব রাগ হয়েছে আমার উপর না! কি করব বল, হঠাৎ করে এমন ঝামেলা শুরু হল। সে বেফাঁস কিছু বলার আগেই মুখ সামলে নিল। যাই হোক চল যাই। নূরীকে বলে আপা লিচুকে নিয়ে যাচ্ছি, রাতে পাঠিয়ে দিব। দুলাভাই আসি।
নাসিরের সাথে গাড়ি করে যেতে লিচুর ভালই লাগছে। খুব জোড়ে গাড়ি চলছে। নাসির কিছু একটা বলছে লিচু ঠিকমত শুনছে না। যাক পরে শুনলেই হবে। ওদের ক্যাম্প দেখে লিচু হতাশ। একি এখানে মানুষ কি ভাবে থাকে। ছোট ছোট খুপরির মত ঘর। একটার মধ্য আবার অফিস। তার ওপাশে রাস্তা। বেশ দূরে দুটা লম্বা তক্তা দেওয়া রাস্তার মাঝে। ওপাশেই ভারত। লিচু ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকল। এ আর এমন কি। আমাদের মতনই। তবে ওদের ওখানে পাহাড় আছে। দেখতে ভালই লাগে।ওপাশে কিছু লোকের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। এপাশ থেকে নাসির ওদেরকে হাত দেখায়।ওরাও পাল্টা জবাব দেয়। কি বিজাতীয় ভাষায় কথা বলে লিচু বুঝে না। ঠিক উর্দু না, অন্যরকম। লিচু অবশ্য উর্দুও পারে না।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০০৮ বিকাল ৪:১২