খবর দেওয়ার সাথে সাথে গাড়োয়ান মুন্তালি এসে হাজির হল। তালুকদার সাহেবের পুরোন লোক। অনেক মান্য করে নূরীদের। সে খুব খুশি বড় বুবু তার গাড়ি করে শ্বশুড় বাড়ি যাবে। অনেক যত্ন করে গরুগুলোকে গোসল করিয়ে এনেছে। রোকেয়া বেগমের কাছে পুরোন তোষক চাদর বালিশ নিয়ে গাড়িতে সুন্দর করে বিছানা তৈরি করল। বুবু বড় ঘরের মানুষ, তাকে খালি খটখটে গরুর গাড়িতে বসানো যায় না। সে জন্য বিছানার ব্যবস্হা করে ফেলে। একটু পরে রান্না ঘরে গিয়ে উঁকি মারে, যদি বেগম সাহেব একটু খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেন। সে জানে এবাড়ি আসলে কিছু না কিছু খাবার জুটবেই, তার উপর সে আজ বড় বুবুকে নিয়ে যাবে, তার কদরই আলাদা।
রোকেয়া বেগম তাকে দেখেই রুবাকে বললেন খাবার বাড়তে। কত দূর যাবে, কত কষ্ট করে গরুর গাড়ি চালানো। মুন্তালির ভাল করে খাওয়া দরকার। না হলে ক্লান্ত হয়ে যাবে, সাথে পুরুষ মানুষ আর কেউ নাই। যদি কোন আপদ বিপদ হয়, কে সামলাবে। মরুক বাঁচুক মুন্তালিকেই সব করতে হবে। ওর জন্য আলাদা করে খাবার হাঁড়িতে দিয়ে দিলেন। সাথে আবার দুটো দইয়ের হাঁড়িও। মুন্তালি গামছা পেঁচিয়ে বিড়া বানিয়ে দইয়ের হাঁড়ি বসিয়ে নিল। সব গোছগাছ শেষ প্রায়, এখন রওনা দিলেই হয়।
নুরী তালুকদার সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গরুর গাড়িতে গিয়ে উঠল। লিচু ভিতরে ঢুকবে না, সে মুন্তালির সাথে গরু সামলাবে! জাভেদ ভিতরে ঢুকে গুটি মেরে শুয়ে পরল। মতিন গাড়ির সাথে হেঁটে চলল, সে পরে গাড়িতে উঠবে। লিচু কয়েকবার গরু সামলাতে চেষ্টা করেও পারল না, কারন সে কিছুতেই গরুকে লাঠি দিয়ে মারবে না। মুন্তালি অনেক বোঝাল গরুকে না মারলে গরু বুঝবে না কোথায় যেতে হবে। নিরীহ গরুর প্রতি মুন্তালির পৈশাচিক অত্যাচারে লিচু ভীষন কষ্ট পেয়ে গাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল। তার চোখ মুখ থমথমে। সে তার সময় কাটানোর জন্য কতগুলি পত্রিকা নিয়ে এসেছিল, তাই পড়তে থাকে।
নূরীর চোখ প্রায় ধরে এসেছে। গাড়ি এখন নদী পার হয়ে চড়ের দিকে যাচ্ছে। ধু ধু বালি খালি দেখা যায়। দুরে দূরে কিছু গ্রাম, কিছু সুপাড়ির গাছ সারি বেঁধে আছে। হঠাৎ করে মনে হয় পৃথিবীতে বোধহয় আর কোন জনপ্রানী নেই, শুধু এই কয়জন ছাড়া! দেশে যে এত কিছু ঘটে যাচ্ছে এখানে এসবের কোন চিন্হ নেই। সব শান্ত। সুমসাম। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, একটু ঠান্ডা লাগা শুরু করছে।
ক্যাচ ক্যাচ করে গাড়ির চাকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ তাও বন্ধ হয়ে গেল। গাড়িটা কাত হয়ে গেল। অশ্রাব্য ভাষায় মুন্তালির গালি শোনা গেল। বেদম পিটাচ্ছে গরুগুলোকে। লিচু জোর করে হাত থেকে লাঠি নিয়ে নেয়।ঘটনা জানতে চায়, চাকা ভেংগে গেছে গরুর কি দোষ! যেন গরুগুলো ষড়যন্ত্র করে চাকা ভেংগে ফেলেছে। হায় রে বোকা মুন্তালি, তাকে কে বোঝাবে, কার কথা সে শুনবে। এখন কি হবে, এতগুলি লোকের জানমালের ভরসা তার উপর, এখন সে কি করে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, বোবা হয়ে গেছে সে। জাভেদ বলে উঠে তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেন! আমাদের গ্রামতো আর বেশি বাকি নাই। আমি মতিনকে নিয়ে এগুই, লিচু আর তুই এখানে থাক। যত দেরিই হোক আমি চলে আসব। কি তোমরা ভয় পাবা নাত! নূরীর উদ্দেশ্য বলে উঠে। না ভয় পাব না, লিচু আছে, মুন্তালি আছে। তোমারতো অনেক হাঁটতে হবে।
আরে আমার অভ্যাস আছে, আমি গেলাম।
জাভেদ আর মতিন ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটা শুরু করল।ওরা মুন্তালির কাছ থেকে হ্যারিকেন নিয়ে এসেছে। বালিতে জোরে পা চালিয়ে হাঁটা যায় না, চোরাবালিও থাকতে পারে। জাভেদের মাথায় হাজার চিন্তা। কখন সাহায্য নিয়ে পৌছাবে নূরীর কাছে। বাবা চলে গেলে লিচু শুয়ে থাকে চুপচাপ। নূরীর মুখের দিকে তাকায় মাঝে মাঝে। খুব বলতে ইচ্ছা করে কেমন মজা এখন! খুব ভাল হয়েছে। সুখে থাকলে ভূতে কিলায়। নাহ উনার লিচুকে নিয়ে সব ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে হবে। এখন থাক, রাত বিরাতে চরে বসে থাক।
নূরী চিন্তা ভাবনায় অস্হির হয়ে উঠে। কেন এরকম ঝামেলা হল কে জানে! যদি জানতে এরকম বিপদে পরবে তাহলে ঘুনাক্ষরেও শ্বশুড় বাড়ি যাবার নাম নিতো না। মুন্তালি তার বরাদ্দের খাবার খাওয়া শুরু করে। তার আবার একটুতেই খাই খাই স্বভাব। মেজাজ খিঁচরে থাকাতে খাওয়াটা শান্তি লাগলো না।গরুগুলো তাকে ডোবালো। এগুলোকে কোরবানির সময় বিক্রি করে দিবে ঠিক করলো।খাওয়া শেষ করে মুন্তালি আড়ালে গিয়ে বিড়ি ধরায়। এবার ভাল লাগছে। বুবু আর পোলাটারে সাধল ভাত খাওয়ার জন্য, তাদের খুদা নাই। কি আজব, তারতো সব সময়ই খেতে ইচ্ছা করে। বড়দের ব্যপার স্যাপারই আলাদা। দূর ফালতু চিন্তা বাদ দিয়ে সে শোয়ার আয়োজন করে। গাড়িটা যদিও একদিকে কাত হয়ে আছে, পরে যায় নি, সে গাড়ির নিচে গিয়ে শুয়ে পরে। নূরীকে বলে বুবু আপনারাও ঘুমান, দুলাভাই আইলে উইঠা পইরেন। বলে সে ঘুমাতে থাকে। কি নিশ্চিন্তের ঘুম, আহা কি শান্তি। নূরী যদি ওরকম ঘুমাতে পারত।
কতক্ষন পরে জানে না, জিপ গাড়ির শব্দে ওরা জেগে উঠল। চারিদিকে মনে হচ্ছে আলোর বন্যা বয়ে যাচ্ছে। জিপের হেডলাইটে এরকম মনে হচ্ছে।কয়েকজন লোক কথা বলছে। জাভেদের গলাও শোনা গেল। সাথে আরে কেউ। এই লিচু উঠ তোর বাবা এসেছে। লিচু উঠে বাইরে তাকিয়ে জমে যায়।
বাবা ইপিআর কেন নিয়ে এসেছে! এদের কোথায় পেল! মাঝরাতে এরা কোথা থেকে এল! হাজারটা প্রশ্ন লিচুর মাথায়। জাভেদের কাছ থেকে জানা গেল, অন্ধকারে সে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিল, সোজা বর্ডারের কাছে চলে গেছিল। যাইহোক ইপিআরের লোকজন তার বিপদের কথা শুনে তাকে সাহায্য করতে এসেছে। তার বউ ছেলেকে বাড়ি পৌছে দিবে। ওরা জিপে চলে গেল। মুন্তালি ওখানেই থাকল। সকালে জাভেদের বাড়ি থেকে লোক এসে তাকে সাহায্য করবে। লিচুরা চলে গেলে মুন্তালি গাড়ির ভিতরে গিয়ে আরাম করে শোয়।
জিপে করে জাভেদের বাড়ি যেতে বেশি সময় লাগে না। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌছে যায়। ওরা ইপিআরদের অনেক ধন্যবাদ জানায়, জাভেদ আবার ক্যাপ্টেন নাসিরকে দুদিন পরে আসার জন্য দাওয়াত দেয়। তার এত বড় উপকার করল,এত বড় বিপদ উদ্ধার করল সে জন্য কৃতজ্ঞতা স্বরূপ খাওয়ার দাওয়াত দেয়। নাসির তার লোকজন সহ খুব খুশি হয়ে দাওয়াত কবুল করে চলে গেল।গাড়িতে আসার সময় জাভেদের সাথে নাসির দেশের রাজনৈতিক পরিস্হিতি নিয়ে আলোচনা করে। সে খুবই আশাবাদী বাঙালিদের স্বাধীকার আদায়ের বেশি দেরি নাই।লিচুর খুব ভাল লাগে, মুহূর্তের মধ্যেই ক্যাপ্টেন নাসিরকে তার আপন মনে হয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০০৮ বিকাল ৫:৪৯