প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘পবিত্র কোরআনে নারী ও পুরুষের সম্পত্তি ভাগাভাগির কথা যেভাবে বলা আছে, আমরা তা মেনেই নারীনীতি করেছি। বাংলাদেশ আজ জঙ্গি আর দুর্নীতির দেশ নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদমুক্ত করব।’ গতকাল রোববার বিকেলে কক্সবাজার শহরের জেলে পার্ক ময়দানে (বিমানবন্দরের দক্ষিণ পাশে) জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক বিশাল জনসভায় প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুফতি আমিনী একজন বুজর্গ মানুষ হয়েও নারীনীতির ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। বিভ্রান্তি ছড়িয়ে জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি নারীদের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করছেন। অথচ মরহুম হাফেজ্জি হুজুরের জামাতা হয়েও তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় এতিম ছেলেদের জায়গা না দিয়ে তিনি নিজেই দখল করে নিয়েছেন। তিনি বলেন, ক্ষমতা দেওয়ার মালিক আল্লাহ। আর ক্ষমতা থেকে নামানোর মালিকও আল্লাহ। অথচ আমিনী বলেন, তিনি ক্ষমতা থেকে টেনে নামাবেন। তাহলে তিনি কি আল্লাহর চেয়েও শক্তিশালী হয়ে গেছেন?
হরতাল প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, হরতালে গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। পিকেটিং করা হয়। আর তাই কোরআন হাতে রাস্তায় নামলে কোরআর অবমাননা হয়। আমিনীরা ধর্মকে ব্যবহার করে দেশে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে চাইছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের মানুষকে বঞ্চিত করে গ্যাস দিতে রাজি হইনি বলে ২০০১ সালে আমাদের ক্ষমতায় যেতে দেওয়া হয়নি। আর খালেদা জিয়া গ্যাস চুক্তির মুচলেকা দিয়েছেন বলেই তাঁকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতায় থাকার পরও তিনি (খালেদা জিয়া) বিদেশিদের গ্যাস দিতে পারেননি। এখন ক্ষমতা হারিয়ে আবলতাবল বকছেন। নানা ষড়যন্ত্র করে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করছেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল ছিল স্বর্ণযুগ। এই সময়ে ১০ টাকা কেজি দামে মানুষকে চাল খাইয়েছি। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে চাল-ডাল-তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশের সম্পদ লুট করে হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। বাংলাদেশকে দুর্নীতি, লুটপাট আর জঙ্গির দেশে পরিণত করেছে।’
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) এ কে আহমদ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় আরও বক্তব্য দেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী আফছারুল আমীন, পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাংসদ আকতারুজ্জামান চৌধুরী, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, কক্সবাজারের সাংসদ আবদুর রহমান বদি, এথিন রাখাইন প্রমুখ।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজ বাংলাদেশ জঙ্গি আর দুর্নীতির দেশ নয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ জঙ্গি ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। আমরা জনগণের উন্নয়নে কাজ করছি। কৃষিতে ভর্তুকি দিয়ে, চাষিদের ঋণসহায়তা দিয়ে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হচ্ছে।’
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেট না থাকায় এখন চাষিরা ২৭ টাকার এক কেজি চালের দাম পাচ্ছেন ৪০ টাকা। ১৩০ টাকার মসুরের ডাল ১৭০ টাকা। এতে তাঁদের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে। তিনি বলেন, গ্রামীণ জনপদের অসহায় গরিব মানুষের অভাব, দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করতে আমরা সারা দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিজিএফ ও ভিজিডি কর্মসূচি চালু রেখেছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘গত দুই বছরে আমরা এক হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছি। আগামী দিনে উৎপাদন আরও বাড়ানো হবে। এ জন্য নতুন করে আরও বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে।’
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের শহর কক্সবাজারকে পরিবেশবান্ধব পর্যটননগর হিসেবে গড়ে তোলার আশ্বাস দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কক্সবাজারের মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট না দিলেও আওয়ামী লীগ কক্সবাজারবাসীকে ভোলে না। কারণ আমরা মানুষের জন্য কাজ করি। আমরা কক্সবাজারের উন্নয়নে বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের করে তৈরি করব। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটারের রেলপথ সম্প্রসারণ করা হবে। ৪০০ কোটি টাকায় আধুনিক মানের একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর, আন্তর্জাতিক মানের একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম, নারীশিক্ষার প্রসারে কক্সবাজার সরকারি মহিলা কলেজে অনার্স কোর্স চালুসহ নানা অবকাঠামো তৈরি, তথ্যপ্রযুক্তিকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিতে সাবমেরিন কেবলের ল্যান্ডিং স্টেশনে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ব্যান্ডউইডথ সম্প্রসারণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়েছে। নারীদের চাকরির জন্য শহরে একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট, মেরিন ড্রাইভ সড়কের উন্নয়ন, পানির সংকট নিরসনে ভূগর্ভস্থ ও প্রাকৃতিক জলাধার তৈরি ও সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হবে।
তরুণ প্রজন্মকে সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত থেকে শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রতিটি গ্রামে আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে। মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করব। আগামী দিনে ডিগ্রি পর্যন্ত মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য কোনো বাবা-মাকে পয়সা খরচ করতে হবে না।’
বিমানবাহিনীর ঘাঁটি উদ্বোধন: সকাল সাড়ে ১১টায় ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারযোগে কক্সবাজারে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সমুদ্রসৈকতসংলগ্ন (বিমানবন্দরের পশ্চিমে) বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি ঘাঁটি উদ্বোধন করেন। এ সময় সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা রক্ষায় বিমানবাহিনীকে আন্তর্জাতিক ও আধুনিক মানের করে গড়ে তোলা হবে। আর এর অংশ হিসেবে এই ঘাঁটির উদ্বোধন করা হচ্ছে।
দুপুর ১২টায় প্রধানমন্ত্রী শহরের ঝিলংজা এলাকায় গিয়ে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন সম্প্র্রসারণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর কক্সবাজার সাবমেরিন কেবলের ল্যান্ডিং স্টেশনে গিয়ে ৪০জি সলিউশন ব্যবহারের ব্যান্ডউইডথ সম্প্রসারণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। তিনি বেলা তিনটায় সার্কিট হাউসের সম্মেলনকক্ষে স্থানীয় প্রশাসন, আইনজীবী ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে বিকেল সাড়ে চারটায় জনসভায় যোগ দেন। ২০ মিনিটের ভাষণ শেষ করে তিনি হেলিকপ্টারযোগে ঢাকার উদ্দেশে কক্সবাজার ত্যাগ করেন।