পারুল আপা আমাদের সকলের একজন প্রিয় আপা। তিনি সকল ছোটদের খুবই স্নেহ আদর ও আবদার পূরণে একধাপ এগিয়ে থাকতেন। অতি নম্র ও ভদ্র তার কারণে বাড়ির গুরুজনদের কাছে এই আপার অবস্থান ছিল উচ্চাসনে। তিনি খুবই নিম্নস্বরে কথা বলতেন এবং কখনো উচ্চস্বরে হাসতেন না। সময় মত পড়াশুনা, ধর্মীয় কাজ এবং গৃহস্থালি কাজে মা'কে সাহায্য করা সহ সবদিক থেকে তিনি ছিলেন পারদর্শী ও বুদ্ধিমতী।
১৯৯৫ সালে এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষ পড়ার সময় উনার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে বিয়ের প্রস্তাব আসে। বলে রাখা ভালো, বরপক্ষ উনাদের পূর্ব পরিচিত এবং দূরসম্পর্কের আত্মীয়। যেদিন বরপক্ষ পারুল আপাকে দেখতে আসেন সেদিনই আকদ বিয়ে হয়। এবং আক্দ বিয়ের পরেই তিনি প্রথম বরকে (সেলিম ভাইকে) দেখেন। আকদ এর রাতেই বর ও বরপক্ষ সকলেই চলে গেলেন কারণ সেলিম ভাইয়ের চাকরিস্থল ঢাকায় উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। এদিকে পারুল আপা সকাল থেকেই নিখোঁজ হয়ে অন্য চাচার বাড়ি গিয়ে উঠলেন কাউকে কোন কিছু না বলে। পারুল আপার এহেন আচরণে সবাই হতভম্ব কারণ উনার অনুমতি নিয়েই বিয়ের আয়োজন হয়েছে।
পারুল আপার বক্তব্য হচ্ছে আকদ এর আগে পারুল আপা পাত্রকে একবারও দেখেন নি, পুরো পরিবারের সবার উপর ভরসা করে মতামত দিয়েছেন। কিন্তু তাই বলে এই ১৮ বছর বয়সের ব্যবধানের লোকের সাথে সারাজীবন কাটাতে হবে! অসম্ভব পারুল আপা এটা কোনোভাবেই মানতে পারছেন না। বিশেষ করে কিশোরী মনে যে প্রভাব পড়েছিল সেই থেকে এতদিনের পারুল আপার এই আচার-আচরণের সাথে একদম বিপরীত একটা পারুল সৃষ্টি হলো।
যেহেতু শুধু কাবিন হয়েছে তাই পারুল আপা তালাক দিতে চান। এই কথা কোনোভাবেই ববা-মাকে মুখোমুখি বলতে পারবেন না এবং বাড়িও আর ফিরে যাবেন না। চাচার বাসায় থেকে চাচা চাচির সাথে এ বিষয়ে কথা বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন। পারুল আপাকে চাচী জিজ্ঞাসা করেন -
-তোমার কি কারো সাথে সম্পর্ক আছে?
-না
-এখন কেন বয়সের অজুহাত দেখাচ্ছো?
-শুনেছিলাম ১৫ বছরের বড় কিন্তু দেখতে তো ২০ বছরেরও বেশি লাগছে
-ঠিক আছে পারুল, তুমি সেলিমের সার্টিফিকেট দেখে নিও
-সার্টিফিকেট দেখে কি হবে, আমি উনাকে আর গ্রহণ করতে পারবোনা
- দেখো পারুল , বিয়েটা তো ছেলেখেলা নয় আজ গ্রহণ করলাম, কাল বর্জন করলাম এটা সারা জীবনের বন্ধন। পারস্পরিক বোঝাপড়া থাকলে দাম্পত্য জীবনে বয়স কোনো বড় কথা নয়। বয়স ব্যবধান অনেক কিন্তু দাম্পত্য জীবন সুখের - এমন উদাহরণও কম নেই। স্বামীর সার্বক্ষণিক সহযোগিতা অনুপ্রেরণা আধুনিকতা বা উদারতা এসব গুণ বয়স দিয়ে বিচার করা যায় না।
পারুল আপনাকে যথেষ্ট বোঝানো হলো কিন্তু পারুল আপা নাছোড়বান্দা হয় পারুল আপা মরবে অথবা তালাক দিবে। সাত দিনের মধ্যেই পারুল আপার বর সেলিম ভাইয়ের কাছে খবরটা জানানো হল। মজার ব্যাপার হলো সেলিম ভাই বলছেন “আমাকে শুধু একবার পারুলের মুখোমুখি কথা বলার ব্যবস্থা করে দিন। সেলিম ভাই খোঁজ নিয়ে জেনেছেন এই মেয়ের কারো সাথে কোন সম্পর্ক নেই, তাহলে কেন এমন করছে? সেলিম ভাইয়ের কথা হল পারুল অন্তত একবার মুখোমুখি বসে সেলিম ভাইকে সরাসরি সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিক যে “এই বিয়ে পারুল আপা স্বীকার করেন না, তাহলে সব সম্পর্ক শেষ করতে আর বাধা থাকবে না।
পারুল আপাও সরাসরি জানিয়ে দিলেন সেলিম ভাইয়ের সাথে যেখানে সংসারই করবেন না সেখানে কথা বাড়িয়ে আর কি হবে। তিনি নিজের সমস্ত দোষ স্বীকার করেন কিন্তু একই কথা তিনি এত বয়স্ক স্বামীর সাথে মরে গেলেও সংসার করবেন না। এদিকে পারুল আপা দেড় মাস যাবৎ বড় চাচার বাসায় আছেন কারণ উনার আব্বা বলেছেন এই বিয়ে না মানলে তিনি উনাকে আর বাসায় জায়গা দিবেন না। উনার আম্মা লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়ের সাথে দেখা করে আসেন। হঠাৎ একদিন সেলিম ভাই আপার চাচার বাসায় গিয়েছেন মুখোমুখি দেখা করার জন্য কিন্তু সেদিনও আপা অন্যরুমে লুকিয়ে চাচিকে দিয়ে আপ্যায়ন করে সেলিম ভাইকে বিদায় করে দেন।
অনেক নাটকীয় ঘটনার পর এবার এলো সিদ্ধান্তের পালা। সেলিম ভাই স্পষ্ট জানালো উনি নিজেও এই সম্পর্কের বিষয়ে আর আগ্রহী নন। তালাকের দিন তারিখ ধার্য হলো । আপাকে তালাক নামায় স্বাক্ষর করার পূর্বে আপার হাত ধরে উনার আব্বা আব্বা কাঁদতে কাঁদতে বললেন "তুমি আমার অতি আদরের ছোট মেয়ে। সেলিম সম্পর্কে অনেক খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পেরেছি ওর স্বভাব ও চরিত্র ভালো ধার্মিক ধুমপান করেনা। সেলিমের বাবা মারা যাওয়ার পর সেলিমের ভাই বোনের ও মায়ের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পূর্ণরূপে পালন করে আসছে। সংসারে কিছুটা অভাব থাকলেও সেলিমের যে যোগ্যতা আছে তাতে করে সে একদিন নিজেকে ভালো অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করবে। তোমাকে হয়তো আরো সুদর্শন কম বয়সী পাত্র দেখে আবার বিয়ে দিতে পারবো কিন্তু তুমি সুখী হবে তো? কারও অভিশাপ নিয়ে কখনোই ভালো থাকা যায় না - - - -
পারুল আপা হঠাৎ করে সেদিন আর তালাকনামায় সই করলেন না। পারুল আপা বাবা মায়ের কথা মেনে নিয়ে সেলিম ভাইয়ের কাছে কাছে ক্ষমা চাইলেন।
আজ দীর্ঘ ২৬ বছর একই সাথে পারুল আপা ও সেলিম ভাই একে অপরের পথ চলার সাথী, সুখ দুঃখের সাথী। পারুল আপা ও সেলিম ভাই দম্পত্তির এক মেয়ে এক ছেলে। মেয়ে এমবিবিএস ডাক্তার আর ছেলে ইউনিভার্সিটিত পড়ছে।
গল্প: পারুল আপা ও সেলিম ভাই আমার অতি নিকট আত্মীয়। গল্পের প্রয়োজনে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।
ছবি: গুগল হতে সংগ্রহ করা।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৩৬