সারা জীবন ইনজেকশন নামক জিনিসটিকে প্রচন্ড ভয় পেয়ে এসেছি। সিরিন্জ-সুই দেখলেই কলজের পানি শুকিয়ে ভুমিকম্প শুরু হত। এখনও যে হয়না তা না। বিভিন্ন কারনে ব্লাড টেস্ট করাতে হলে ভয় পেয়ে কান্না-কাটি করেও কাজ হত না তবে একটা সময় আবিষ্কার করলাম যতটা ব্যাথা পাই তার চেয়ে পঞ্চাশ গুন বেশী পাই ভয়।
ছোটবেলায় বাত জ্বরের কারনে প্রথমে ইনজেকশন দিতে হত। একবার বড় ফুপু ইনজেকশনের সময় আমার অবস্থা দেখে বলেছিলেন, "হায়াত না থাকলে মরে যাবে তার পরেও এই অবস্থা করে ইনজেকশন না দিতে" পরবর্তীতে ইনজেকশন বাদ দিয়ে ঔষধ খেতে হয়েছে।
যাক ইনজেকশন কাহিনী অনেক হল, আসল কাহিনী ই বলছি। ব্লগে/বিভিন্ন জায়গায় মানুষকে রক্ত দিতে দেখে ভয় পেলেও আমার মনে হয় ভয় পেলেও, একটু ব্যাথা লাগলেও এর বিনিময়ে যদি একটি প্রান বেঁচে যায় তাহলে কেন রক্ত দিবো না! এই ভেবে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি সুযোগ পেলে অবশ্যই দিবো। একজন ব্লগার সব ব্লগারদের রক্তের গ্রুপ নিয়ে একটি পোষ্ট দিয়েছিলেন সেখানে আমার গ্রুপটা বলেও দিয়ে এসেছিলাম।
কিছুদিন আগে এক ব্লগার জরুরী ভিত্তিতে AB+ রক্ত চেয়ে একটা পোষ্ট দিয়েছিলেন। পোষ্ট টি দেখে কেমন যেনো একটা অনুভূতি আসলো। একটু ভয় ভয় করছিলো। নিজেই নিজেকে বললাম এতদিন তো আফসোস করতে এবার তোমার সময় এসেছে মনে সাহস জোগার করে ফোন দিলাম। ব্লাড ক্যান্সারের রোগী। চার ব্যাগ রক্ত একত্রে করে তার শ্বেত কনিকা নিয়ে একব্যাগ করে পরে দিতে হয়। রোগীর ভাই জানালেন উনাদের রক্ত জোগাড় হয়ে গিয়েছে তবে পরে লাগলে আমি দিবো কিনা। মনে মনে ভাবলাম যাক এইবার বেঁচে গেলাম(আমি যে কতটা ভীতু পরে বুঝেছি)মুখে বলেদিলাম যে কোন সময় ফোন করতে। গত ৬ তারিখ গ্রামের বাড়ী গেলে সেদিন ই ফোন করেন রোগীর ভাই। বলেন উনাদের প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছেন। হাতে আর ডোনারও তেমন নেই। আমার অবস্থা বলে ঢাকায় ফিরলে জানানোর কথা বলে দিই। ১০ তারিখ ঢাকায় ফিরলে ফোন দিলে ১১ তারিখ লাগবে বলে জানান। যেতে হবে মোহাম্মদপুর রেড ক্রিসেন্ট অফিসে। কথামত ভাইয়াকে সাথে করে যাই। কাছাকাছি যেয়ে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম ব্যাথা পাবো কিনা। ভাইয়া বলে আমি কি জানি। হাত দিয়ে মেপে দেখায় এত্ত বড় সুই দিয়ে রক্ত নেয়। যাক আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে গেলাম।
ফর্মালিটি শেষ করে যেয়ে শুয়ে পড়লাম বেডে। প্রথমে বামহাতে খুজে ভেন খুব চিকন বলে ডান হাতে দেখে। দুইহাতে একই অবস্থা। পরে ডান হাত থেকেই নেয়। সুইটা ঢোকানোর আগমুহূর্তে ভেতরে সিডর বয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ঢোকানো হয়ে গেলে একটু হতাশ ই হয়ে ছিলাম। ভেবেছিলাম না জানি কি হবে, কত ব্যাথা পাবো অথচ কিছুই না।
এমনিতেই শীত তার ওপর ভেন চিকন। খুব ধীরে ধীরে রক্ত যাচ্ছিল। তার মাঝে মনে সুইয়ের পাশ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। মহিলাকে টের পেলাম তুলা দিয়ে মুছে দিল। ভাইয়া তো আমার অবস্থা আগেই জানত তা দেখে রেগে গিয়ে বলে টেপ মেরে দিতে কিন্তু আনাড়ী মহিলা তা করে নাই। অর্ধেক ভরার পরে মনে হয় রক্ত আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল পরে সুই হালকা টেনে-টুনে কায়দা করে দেয়। এভাবেই শেষ হয় আমার রক্তদান কাহিনী। পরে ভাইয়া বলে যেখানে ওর ৭-৮ মিনিট লাগে সেখানে আমার নাকি ২০ মিনিট লেগেছে ব্যাগ ভরতে! ভেবেছিলাম রক্তের ব্যাগটা দেখবো। নিজের এত্তগুলো রক্ত দেখবো, কিন্তু এত কাহিনীতে ভূলেই গিয়েছিলাম।
আসলেই এখানে যদি শেষ হত তাহলে কথা ছিল না। কিন্ত রক্ত দিয়ে কলেজে আসলে কিছুক্ষন পরে ফোন আসে রোগীর ভাইয়ের কাছ থেকে। আমাকে বলে "আপু আপনার ব্লাড গ্রুপ তোAB+ না। আপনার টা A+!!! শুনে প্রথমে ভাষা হারিয়ে ফেললাম। ধাক্কা কাটিয়ে বললাম আমি একবার টেস্ট করেছিলাম তখন এটাই বলা হয়েছিল! খুব দুঃখ প্রকাশ করলে উনি আমাকে স্বান্তনা দিয়ে ফোন রেখে দেন। পরে শুনি ভাইয়াকে ফোন করেছিলেন এবং ভাইয়া ভার্সিটি থেকে জোগাড় করে দেয়।
খুব খারাপ লাগছিল জীবনের প্রথম দেয়া রক্তটা কাজে লাগল না।
মনে হচ্ছে আমি এমন একটি মানুষ যার দ্বারা কারো কোন উপকার হবার না....
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:২৮