কাশি সারিতেছিলো না। দিনরাত খকর খকর করিতেছিলাম।
কাশির জন্য আশেপাশের দূষিত বায়ুকে দায়ী করিতে মন চাহে, তবে ডাক্তার বন্ধুরা দোষ চাপাইতে চায় আমার নিরীহ ফুসফুসের স্কন্ধে।
জনৈক ডাক্তার বন্ধু দীর্ঘ নয় বছর যাবৎ আমার চিকিৎসা করিয়াছে, তাহার চিকিৎসার পদ্ধতিতে আমার আগাগোড়াই আপত্তি জারি ছিলো, কিন্তু তাহার স্বভাবটি বড়ই স্বৈর, রোগীর প্রতিবাদ কানে নিতে চাহে না, তাহার অ্যালোপ্যাথি ওষুধ খাইতে খাইতে খাইতে খাইতে একদিন হঠাৎ রুষিয়া উঠিয়া কহিলাম, তোমার কাছে আবার যদি এই কাশি লইয়া দেখাইতে আসি তো আমার মুখে জুতা!
বলিয়া উঠিয়া আসিলাম। বন্ধু হাঁ হাঁ করিয়া উঠিয়া আসিলো, পাত্তা দিলাম না।
তাহার পর পনেরো বছর কাটাইয়া দিলাম এই কাশি লইয়া। ইহার মধ্যে প্রথম পাঁচ বছর দেখাইলাম পাড়ার কবিরাজকে, তিনি খালি কোকিলের ডিমের সহিত মাড়িয়া মকরধ্বজ খাইতে বলিতেন, বলিতেন যে ইহা নাকি জনৈক শহীদ কবিরাজের স্বপ্নে প্রাপ্ত মহৌষধ, খাইলেই কাশি দূর হইবে, গলা তথা ফুসফুসের উন্নয়ন ঘটিবে। বহুমূল্য মকরধ্বজ যোগাড় করিয়াছিলাম বহুকষ্টে, কিন্তু কোকিলের ডিম যোগাড়ের টেন্ডার যাহাদিগের স্কন্ধে অর্পিত করিয়াছিলাম, তাহার বড়ই জুয়াচোর। প্রথম জন যে এক হালি আন্ডা ঠোঙায় করিয়া আনিয়া দিলো, উহাদের দেখিয়া নিতান্ত বোকা*োদাও বুঝিবে, উহারা কোকিলের নহে, বরং মুরগির আন্ডা। কোন হংসীর গর্ভচু্যত রত্নও হইতে পারে। দালালটিকে চোখ রাঙাইয়া কহিলাম, এয়ার্কি পাইয়াছো? কোকিলের ডিম অত বৃহৎ হয় নাকি? সে হাসিয়া কহিলো, এ তো রামকোকিলের ডিম কর্তা। একটু বড়সড় হবেই। মকরধ্বজ দিয়া মাড়িয়া ঢক করিয়া গিলিয়া ফেলুন। আর বিলটা কি এখন দেবেন না দশ মিনিট বসিবো?
রাগে তালু জ্বলিয়া গেলো, কিন্তু ভদ্রলোকের সন্তান হইয়া এই বাটপারটির সহিত কলহে জড়াইতে মন সায় দিলো না।
পয়সা লইয়া সে ফুটিতে না ফুটিতেই আরেক দালাল আসিয়া হাজির, হাতে একটি সরু হোমিওপ্যাথির শিশি। তাহাতে কয়েকটি সাদা ক্ষুদ্রাকৃতির বস্তু।
সংশয় প্রকাশ করিতে না করিতে জ্ঞাত হইলাম, ইহা দুষ্প্রাপ্য পোনাকোকিলের ডিম। অবিলম্বে যাহাতে মকরধ্বজ দিয়া মাড়িয়া খাইয়া কাশিদূর করি, আর টাকা চুকাইয়া দিয়া তাহাকে দূর হওয়ার অনুমতি প্রদান করি।
বিনাবাক্যে তাহাই করিলাম। তবে প্রথম চারটি ডিম ধানুকে দিয়া বলিলাম অমলেট আঁটিতে, আর শিশিটি ফেলিয়া দিলাম। টিকটিকির ডিম আমি বিলক্ষণ চিনি।
তবে কাশি সারিলো না, জাতীয় পক্ষীর ডিমের সন্ধানে পাগলপারা হইয়া ঘুরিতেছি, এমন সময় একদিন আমার আরেক হোমিওপ্যাথ বন্ধু আসিয়া কহিলো সহাস্যে, শুনিলাম শিয়ালের তেল সন্ধান করিতেছো?
গুজবের কাঁটা সজারুস্য অপেক্ষা শক্ত, ছাড়াইবার চেষ্টায় গলদঘর্ম হইয়া অবশেষে সব খুলিয়া কহিলাম। বন্ধুটি ক্ষিপ্ত হইয়া কহিলো, বাটপারটা এদানি ং এই ব্যবসা ধরিয়াছে? কোকিলের ডিম দিয়া মাড়িয়া মকরধ্বজ? তুমি পরশুরামের কচি সংসদ পড় নাই? ঐখানে লালিমা পাল পুং ইহা সেবন করিতো! বাটপারটা তোমাকে ধোঁকা দিয়া মকরধ্বজ বেচিতেছে। আর খোঁজ নিলে দেখিবে ঐ ডিমের দালাল সব উহার শালাসম্বুন্ধী।
খোঁজ নিয়া দেখিলাম, বাস্তবিক তা-ই!
মন বিষাইয়া গেলো, কাশি লাঘবের ভার অর্পণ করিলাম হোমিওপ্যাথটির উপর।
সে আমাকে নাক্স ভমিকা আর আর্নিকা থার্টি গছাইয়া দিয়া নানা আব্দার চালাইতে লাগিলো। হোমিওপ্যাথি ওষুধ নাকি মারাত্মক আচারবিধি পালন করিয়া খাইতে হয়। নাহলে কাজ দেয় না। আচার বিধির বেশিরভাগই খরচিয়া, আর দেখিলাম তাহার মধ্যে সেই বন্ধুটিকে ঘন ঘন দাওয়াত করিয়া খাওয়াইবার আচারটিই মুখ্য। একরত্তি ওষুধ খাইবার নিমিত্তে হাজারটাকা বাহির হইতে লাগিলো।
পাঁচটি বছর এইরূপে কাটিলো।
আমার কবিরাজ বন্ধুটি আমাকে হোমিওপ্যাথির কবল হইতে রক্ষা করিলেন। আসিয়া কহিলেন, কোকিলের উপর রাগ করিয়া ওষুধ বন্ধ করিলে কি চলিবে? কোন কোকিলের রন্ধ্র যদি অনেক বড় বা অনেক ছোট হইয়া থাকে, তোমার আমার কি কিছু করিবার আছে? রন্ধ্র বড় হইলে ডিমও বড় হইবে। রন্ধ্র ছোট হইলে ডিমও ছোট হইবে। তাই বলিয়া তুমি তাহাকে মুরগি বলিবে? টিকটিকি বলিবে? তাহা হইলে তো শ্রীদেবীকে গাভী বলিতে হয়। এইসব রাখিয়া বরং ফুসফুসের কিছু উন্নয়ন করো। উন্নয়নের জোয়ার।
লজ্জা পাইলাম। কাশিয়া কহিলাম, হোমিওপ্যাথ বেটা বড় নচ্ছাড়। তুমিই অন্য কোন ওষুধটষুধ দাও। তবে পুনশ্চে যোগ করিলাম বিশেষ শ্রাব্য হিসাবে, কোকিলের ডিম আর নয়।
বন্ধুটি বড়ই উদার, এইবার প্রেসক্রাইব করিলেন পদ্মমধু দিয়া মাড়িয়া ডুমুরের ফুল।
আমার তো কালঘাম ছুটিয়া গেলো পদ্মমধু যোগাড় করিতে গিয়া। মৌমাছিরা সরিষা ফেলিয়া পদ্ম হইতে কেন মধু সংগ্রহ কওে কে জানে। তবে দেশেও পদ্মের আকাল। জনৈক কুবের মাঝির নিকট হইতে মধু যোগাড় করিয়া বয়ামে ভরিয়া ফ্রিজে রাখিয়া দিলাম বটে, কিন্তু ডুমুরের ফুল খুঁজিতে গিয়া পরনের গামছা বিকাইয়া যাওয়ার যোগাড় হইলো। পূর্বপরিচিত দালালেরা আগাম পয়সা লইয়া নানারকম ফুল আনিয়া দিলো। সেগুলির মধ্যে কুমড়ার ফুল আর গোলাপ শনাক্ত করিতে পারিলাম, বাকিগুলি ধানু ভাসে সাজাইয়া রাখিলো।
এইরূপে পাঁচ বছর গুজরান হইতে না হইতে হোমিওপ্যাথ বন্ধুটি আসিয়া কহিলেন, তুমি তো আচ্ছা সাহিত্যমূর্খ হে। পরশুরামের কচি সংসদে পদ্মমধু বোসের কথা পড় নাই? কবিরাজ ব্যাটা ভোগা দিয়া তোমাকে লুটিয়া ল্যাংটা করিলো!
কী আর কহিবো। বিষণ্ন বদনে বসিয়া কাশিতে লাগিলাম।
আমাকে তখন উদ্ধার করিতে আসিলো ভোদাই।
ঘাতে একটি বয়াম লইয়া আসিয়া হাসিয়া কহিলো, এই লও। ইউনুনি ওষুধ। খাইলেই কাশি দূর। দেহে থাকবে লাবণ্য। মনে থাকবে আনন্দ।
বয়ামটি হাতে লইয়া নাম দেখিলাম। ওষুধের নাম শক্তি, প্রস্তুত কারক বিউটেনুস।
নাক সিঁটকাইয়া কহিলাম, বিউটেনুস! ইহা কেমন নাম? লাতিন নাকি?
ভোদাই হাসিয়া কহিলো, কী জানি বাপু। বলিয়া পকেট হইতে একটি ক্ষুদ্র ঠোঙা বাহির করিয়া কহিলো, অনুপান আছে। শুধু শুধু খাইলে কাশি সারিবে না। অনুপান সাথে খাইতে হইবে।
ঠোঙা খুলিয়া দেখি ভিতরে গোটা কতক জলপাই।
মূল্যের কথা শুধাইতে ভোদাই হাসিয়া কহিলো,আহা অত তাড়াহুড়ার কী আছে? মূল্য ধীরেসুস্থে সারাটি জীবন ধরিয়া দিও!