সক্কাল সক্কাল মাইক্রো বাসে করে রওয়ানা দিয়ে দিলাম। গন্তব্য চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গল। লং রুটে আমার গাড়ি ভাল লাগে না। কিন্তু সবার কথা বিশেষ করে বাচ্চাদের কথা ভেবে মাইক্রো বাসই নেয়া হল। এক গাড়িতে ১২ জন। তবে এদের মধ্যে ৩জন বাচ্চা বয়সী হওয়াতে তেমন সমস্যা হয় নি। তাছাড়া তেতুল পাতায় ৯ জন হতে পারলে এক মাইক্রোতে তো ১২ জন কোন সমস্যাই না। হঠাৎ করে পেয়ে যাওয়া দূর্গা পূজা ছুটির দিনের সকাল। কুড়িল ফ্লাইওভারে যখন আমাদের গাড়ি তখন সকাল ৭.৩০টা। ৩০০ ফিট ধরে ধরে এগিয়ে যাওয়া। বসুন্ধরা আ/এ যেতে যেতে কতদূর যে যাচ্ছে তার শেষ নেই। তারপরই শুরু হল পূর্বাচল নাম দিয়ে এক আজব আবাসিক এলাকা। সবই পূর্বাচল সিটি, সাথে শুধু ক খ গ কিছু একটা লাগানো। কাঞ্চন ব্রিজের গোড়াতেই জ্যাম। তবে ভাগ্য ভাল, সাথে সাথেই একটা বাইপাস পেয়ে গেলাম। সেই গ্রামের ভিতরের ঢেউ খেলানো রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাওয়া। একদিকে গ্রামের ঘরবাড়ি, অন্যদিকে বিস্তীর্ন ধানক্ষেত। রাস্তা গিয়ে উঠল নরসিংদিতে। কিন্তু এই ঢেউ খেলানো রাস্তা আমাদের বাচ্চাদের কিছুটা অসুস্থ করে দিল। তাই হালকা একটা বিরতি দিয়ে আবার পথচলা।
আমাদের কারোরই শ্রীমঙ্গলের রাস্তা একেবারেই জানা নেই। ম্যাপ, রাস্তার পাশের ডিরেকশন, রাস্তার পিচ দেখে দেখে মহাসড়কের এন২ ধরে চলছি। ঢাকা-সিলেট রুট ছেড়ে এবার যাওয়া হল শ্রীমঙ্গরের রাস্তায়। কিছুদূর এগুতেই এক চা শ্রমিক মাথায় চায়ের বোঝা নিয়ে রাস্তার পাশে দাড়িয়ে সবাই অভ্যর্থনা করল। তখনই বুঝলাম চায়ের দেশে এসে গেছি।
আমাদের আবাস ঠিক করা ছিল চা বোর্ড রিসোর্টে। আমাদের নেতা (হতেও পারত .......) এই আয়োজন ঠিক করেছেন। চমৎকার বাংলো টাইপ বাড়ি। প্রতি বাংলোতে ২টি করে বেড রুম, সাথে লিভিং, ডাইনিং, কিচেন, বারান্দা। সামনে পিছনে সবুজ লন। আহ, এমন এক বাড়ি থাকলে.....। দুই রাত এখানে কাটিয়ে আমার মনে হল গ্র্যান্ড সুলতান টাইপ কোন লাক্সারিয়াস হোটেলে থাকলেও এত ভাল লাগত না। অনেক আগে থেকে বলে না রাখলে খাবার পাওয়া যায় না বলে আরা দুপুরে আর এখানে খেতে পারলাম না। বাহিরেই সেরে নিতে হল দুপুরের খাবার।
লম্বা জার্নি করে আসায় কিছুটা ক্লান্ত। গোসল করে কিছুটা রেস্ট, তারপর একটু হাটাহাটি। রিসোর্টের সামনের চা বাগান, সাতরং চায়ের দোকান, বাজার ঘুরে ডিনার করে সেদিনের মত ঘুম।
সকাল হল বাকিদের ডাকাডাকিতে। সকালে জগিং, হাটা সবই করল সবাই। আমি শুধু ঘুম। নাস্তা সেরে আজকের গন্তব্য মাধবকুন্ড। সেই ছোটকালে প্রায় ১৯৯০ সালের দিকে একবার মাধবকুন্ড গিয়েছিলাম। আবার সেখানে যাওয়া। তখন আমি তেমন কিছুই বুঝতাম না, এখন তাই দেখে দেখে যাচ্ছি। শমসের নগরে এয়ারপোর্ট আছে আগে জানলেও সেখানে যে এয়ারফোর্সের বেস আছে জানতাম না। আমাদের মাধবকুন্ডের পথ আর শেষ হয় না। শুধু মনে হয় আর ১৫/২০ মিনিট পর হয়ত পৌছে যাব। কিন্তু এই করে করে ৩ঘন্টা পর পেলাম মাধবকুন্ড। এর মাঝে কমলগঞ্জ, শমসের নগর, কুলাউড়া, বড়লেখা পার হয়ে এলাম। এতটা পথে আমার আর আমার বন্ধু ব্লগার সুজন মেহেদীর (Click This Link) দ্বিমত হল। তবুও পথ চলতে চলতে সুজনের কথামত গিয়েই পেলাম পথের দিশা।
যে কোন দর্শনীয় স্থানের মত এই মাধবকুন্ডের অবস্থাও শোচনীয়। এই দুরবস্থার জন্য আমি নিজেও দায়ী। ঝরনায় যাওয়ার রাস্তা সুন্দর করে বাধানো। চারদিকে সবুজের সমারোহ, টয়লেট, চেন্জিং রুম, নিরাপত্তা সবই আছে। ছোট্ট একটা পার্ক করেছে যেখানে অনেক জীবজন্তুর ম্যুরাল করে রাখা। আমার ছেলের আবার এসব হাতি ঘোড়া খুব পছন্দ। সে কিছুক্ষন মেতে থাকল এসব নিয়ে। তারপর গেলাম ঝরনার কাছে। এককালে দূর থেকেই ঝরনার আওয়াজ পাওয়া যেত। সাথে ছিল পাখির কলকাকলি। এখন কেবলই মানুষের কোলাহল। প্রকৃতির কাছে এসে কেন এত মানুষের চিলাচিল্লি। যে কোন জায়গার ছবি তুলে আমরা স্মরনীয় করে রাখতে চাই। কিন্তু সেই ছবি তোলাটা এখন একেবারে সহ্যের সীমা ছেড়ে যাচ্ছে। মানুষের গলার আওয়াজে এই এলাকার মানুষ তো দূরের কথা, ভূতেরও পালানোর কথা। এই ককফোনিতে বেশীক্ষন আর থাকতে পারলাম না। ৩+৩ এই ৬ ঘন্টার জার্নি শেষ হল ১০ মিনিটের অবস্থানে।
এদিন রাতে বারবি কিউ এর আয়োজন করা হয়েছিল। সাথে লাইটের আলোতে টেনিস কোর্টে ক্রিকেট খেলা। খেলার পরে জম্পেশ আড্ডা। যদিও ভোরে উঠার ইচ্ছা আমাদের। তবুও আড্ডা ছেড়ে কিছুতেই উঠি না।
সকাল থেকেই শুরু হল ক্রিকেট খেলা। আজউ আমরা রিসোট ছেড়ে ঢাকায় চলে আসব। ক্রিকেট খেলে, নাস্তা করে, সুইমিং পুলে সাতরিয়ে ১১টার দিকে রুম ছেড়ে দিলাম। দবে রুম ছাড়ার আগে চা রিসোর্টের মিউজিয়ামটা দেখে নিলাম। আহামড়ি কিছু না হলেও দেখতে ভাল লাগে। এবার আমরা যাব লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেস্ট। ছবিতে বনের মাঝ দিয়ে ট্রেন লাইন চলে যাওয়ার অপরুপ ছবি দেখে এখানে যাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল।
ফরেস্টের গেটে টিকেট কেটে ভিতরে গেলাম। আগেই বলেছি আমরাও সেই দলের মানুষ যারা ছবি তোলাটাই ভ্রমনের মূল উদ্দেশ্য মনে করি। গেট থেকে হেটে হেটে ট্রেন লাইন পর্যন্ত গেলাম। কিছু ছবি তুলেই আমাদের লাউয়াছড়া দেখা শেষ। পরে ঢাকায় এসে বউকে জিগ্গেস করলাম সে কি কি গাছ দেখেছে সেখানে। কিছুই বলতে পারল না। আমি নিজেও যে খুব পারব তা না।
এরপর আমার খুব ইচ্ছা ছিল একটা লেবুর বাগানে যাওয়া। কিন্তু বেশীরভাগেরই আর ইচ্ছা নেই। আমিও কোন বাগান চিনি না যে একদমে নিয়ে যেতে পারব। সুজন আমাকে পথের ধারের লেবুর বাগান দেখে নিতে বলল! মন খারাপ করে ঢাকার পথ ধরলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল একটা লেবুর আড়ত। সেখান থেকে প্রচুর লেবু কিনে মন শান্ত করলাম। আরও রাগ ঝেড়ে ফেলে দিলাম সাথের সবাইকে কয়েক হালি করে লেবু ফ্রি দিয়ে।
এরপর একটানে চলে আসছি ঢাকার দিকে। দুপুরের খাওয়া তখনও হয়নি। আমরা ঠিক করে নিলাম ঢাকার দিকে আরও কিছুক্ষন যেতে থাকি যতটা একটানে যাওয়া যায়। আমরা না খেয়ে হয়ত আরও কিছুক্ষন যেতে পাতাম কিন্তু গাড়ি তো আর না খেয়ে চলতে পারবে না। তাই গাড়ির খাদ্যের জন্য থামলাম হবিগন্জ। পাম্পের বিপরীত দিকেই একটা ভাল মানের রেষ্টুরেন্ট পেয়ে গেলাম। তাই ঠিক হল এখানেই খেয়ে নেই। সুজন নামাযী মানুষ তাই নামায পড়তে চলে গেল। আমি পাশে তাকিয়ে খুব সুন্দর একটা মসজিদ পয়ে গেলাম যার নাম 'মসজিদে বেলাল (রা)'। এত সুন্দর গম্বুজসহ মসজিদ যে বেনামাযী এমনকি অমুসলিমও এই মসজিদে যেতে চাইবে। আমি সাথে সাথে সেই মসজিদে নামায পড়তে চলে গেলাম সুজনের সাথে।
বাকি পথ ঢাকা-সিলেটের গাড়ির চাপমুক্ত হাইওয়ে ধরে অবিরাম ছুটে যাওয়ার একঘেয়ে গল্প। নিরাপদে বাড়ি ফিরেছি এই শেষ। আমার কখনও খুব কষ্ট করে, দৌড়ে দৌড়ে কোন বিশেষ এলাকা দেখতে ভাল লাগে না। বরং একটু ছুটি কাটাতে পারলে, একটু রিলাক্স থাকতে পারলেই ভাল লাগে। এই ভাল লাগাটা কাজ করে এই দলের সাথে কোথাও গেলে। এই সেই দল যাদের সাথে সেই ২০০৯ সালে দার্জিলিং যেতে যেতে পরিচয় হয়েছিল আবার যাদের সাথে ২০১০ সালে ভূটান গিয়েছিলাম। সেইসব গল্প এই ব্লগে সেই সময়ে করেছি।
ক্লান্ত নাগরিক জীবনে সবাই সময় পেলেই কোথাও না কোথাও ঘুরে আসতে পারেন। সিলেট এলাকাটা বেশ কাছে বলে এখানে যেতে পারেন। তবে প্রকৃতির দিকে আমরা যদি আরেকটু খেয়াল না রাখি তাহলে বেড়ানো কিন্তু এখানেই শেষ হয়ে যাবে। আমাদের পরের প্রজন্ম এসে দেখবে 'দেখার কিছু নাই'।