আগের পর্ব
Click This Link
এই প্রথম আকাশপথে বউ-বাচ্চা নিয়ে যাচ্ছি। আমার বউয়ের এই প্রথম প্লেনে করে অন্য দেশ যাওয়া। সবকিছু মিলিয়ে আমার দারুন সুযোগ তার সাথে ভাব মারার। এমন ভাব তার সাথে দেখানো শুরু করলাম যেন আমি খুব ফ্রিকোয়েন্টলি দেশের বাইরে যাই। এয়ারপোর্টের সবকিছু আমি চিনি-বুঝি। আমার মত জ্ঞানী আর নেই। আমার মত জ্ঞানীকে বিয়ে করে তার ধন্য হওয়া উচিৎ . . . . ইত্যাদি ইত্যাদি।
ঢাকা এয়ারপোর্টের টার্মিনাল ১ এ নেমে লাগেজ নামালাম গাড়ী থেকে। কিন্তু ড্রাইভারকে চলে যেতে মানা করলাম। আসলেও যদি ওভার বুকিংয়ের জন্য এয়ারক্রাফটে সিট না পাই তাহলে বাড়ী তো ফিরতে হবে। বেলা ০৪ টার সময় এয়ারপোর্ট পৌছে ডিসপ্লে তে দেখলাম ফ্লাইট বিজি ০৮৬ কুয়ালালামপুর ০৭.১৫ তে যাবে তবে তার চেক ইন এখনও শুরু হয় নি। ভাবলাম এই সময়ে ইমিগ্রেষনের ফরমটা ফিলাপ করে নেই। তখনই বিমানের এক কর্মকর্তা আমাদের দেখে বললেন, আপনারা কুয়ালালামপুর যাবেন না? চলে আসুন। আজকে ওভার বুকড ফ্লাইট, আপনাদের চেক ইন করে নিন।'
আমি তো অপার বিষ্ময়ে বিষ্মিত। সেধে সাহায্য করছে বিমানের কর্মকর্তা! চেক ইন কাউন্টারে যাওয়ার পর বলল, 'মি আহমেদ? আপনাদের সিট আমরা বুক করে রেখেছি। আজকে আমাদের ফ্লাইট ওভার বুকড। যেহেতু আপনারা ফ্যামিলি যাচ্ছেন তাই আপনাদের সিট আমরা আগেই বুক করে রেখেছি।' এবার আমার বিষ্ময় যেন আকাশ ছুয়ে চলে আসল। যারা 'বাবা' হয়েছেন তারা হয়ত বুঝবেন তার ফ্যামিলি বিশেষত বাচ্চাদের কেউ কেয়ার নিলে তারা কেমন কৃতজ্ঞ হয়। আমার মনও কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল। ভদ্রলোক আমাদের চেক ইন সেরে আমার ছেলেকে একটু আদর করে এমনকি তার কাউন্টারে নিয়ে বসাতেও চাইল। বিনিময়ে আমি কেবল শুকনো ধন্যবাদ দিয়ে ফিরে আসলাম। আমি বিশেষ কেউ না, আবার তাদের পরিচিত কেউ না। একজন অপরিচিত যাত্রীর জন্য তারা এই কাজ করেছে মানে এইটা তাদের রুটিন অভ্যাস। আল্লাহ তাদের মঙ্গল করুন। বিমানে আমি যে কয়বারই ভ্রমন করেছি কখনই কোন সমস্যা হয় নি। এমনকি ফ্লাইট দেরীতে ছাড়ার স্বাভাবিক সমস্যাটাও হয় নি কখনও।
ইমিগ্রেষনের ফরম আমি কোনকালে একটা করে সারতে পারি নি। কেন যেন সবসময়ই আশপাশের আরও কয়েকজনের ফরম ফিলাপ করতে হয়েছে। এমনকি আমার আব্বা-আম্মাকে হজ্বের সময় ইমিগ্রেষন পর্যন্ত এগিয়ে দেয়ার সুযোগ হয়েছিল। তখনও এই কাজ করে এসেছি। এবারও করতে হল। এদের মধ্যে ২/৩বার মালয়েশিয়া থেকে ওয়ার্ক ভিসায় কাজ করে আসা যাত্রীও আছে। তারা আবারও কয়েক বছরের ভিসা নিয়ে যাচ্ছে। খুব খারাপ লাগল এই ভেবে যে তারা যদি এখনও এই ফরম ফিলাপ না করতে পারে তাহলে ঐ দেশে কি করে কাজ করে নিজের উন্নতি করবে? তাদের এক কাজেই তো সারা জীবন পার করে দিতে হবে। এই খেসারতের কিছু কিছু নমুনা দেখা হয়েছে আমার এই ট্যুরে যা পরবর্তীতে লেখার চেষ্টা করব। ফরম ফিলাপ করে গেলাম ইমিগ্রষনের লাইনে। আমার সামনে যাদের ফরম ফিলাপ করেছি তাদেরই কয়েকজন। আমার ছেলে তখন শুরু করল কান্নাকাটি। আমার মনে হচ্ছে দ্রুত ইমিগ্রেষন শেষ করে চলে যাওয়া উচিৎ। কিন্তু লাইন ভেঙ্গে তো আর যাওয়া যায় না। আর লাইনে আগে যাওয়ার অনুরোধ করাও আমার কাছে আরেকটি অপরাধ মনে হয়। তাই লীমাকে লাইনে দাড় করিয়ে আমি ছেলেকে কোলে নিয়ে একটু হাটতে লাগলাম আর তাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকলাম। এর মধ্যে আরেক ইমিগ্রেষন পুলিশ এসে বলল ফ্যামিলি হলে লাইন ধরতে হবে না। আপনার আগে চলে যান। তবুও আমি একটু ইতস্তত করছি। এই দেখে তিনি নিজেই আমাদের লাইনের সামনে দাড় করিয়ে দিলেন। অথচ কেউ কেউ আমাকে প্রয়োজনে ইমিগ্রেষনে ২/৪টি ইংলিশে ঝাড়ি দেয়ার প্রস্তুতি রাখতে বলেছিল। বিষ্ময়ে আর কত বিষ্মিত হব? ইমিগ্রেষন শেষ করে ভিতরের লাউন্জে অপেক্ষা করছি। আমার এমেরিকান এক্সপ্রেস কার্ড নেই তাই বিনা পয়সায় কোন লাউন্জে যেন বসে খাওয়া যায় তা আর খেতে পারলাম না। ফ্রি খাওয়ার অ্যভাসটা এখনও গেল না। তারপর ডাক পড়ল বিমান যে গেটে এসেছে সেই ১এক্স গেটে যাওয়ার। এখানেও সেই খাতির। কারন একটাই - 'আমরা ফ্যামিলি'। বউ-বাচ্চা নিয়ে যাওয়াটা যে ঝামেলার মনে হয়েছিল এখন দেখছি তারা থাকায় ঝামেলা আরও কমে যাচ্ছে। আমরা টিকেট কেটেছিলাম ইকনোমি ক্লাসের। এমনকি টুল/মোড়ায় বসে যেতেও রাজি ছিলাম। সেখানে আমাদের দেয়া হয়েছে বিমানের সামনের প্রসস্ত সিট। আল্লাহ তাদের মঙ্গল করুন। বিমানের খাবার আমার কাছে তেমন কখনও ভাল মানের মনে হয় নি। অথচ আজকের খাবার খুব টেস্টি আর গরম-গরম। সাথে জুস/চা/কফি তো আছেই। এমনকি আমার বাচ্চার জন্য এয়ার হোস্টেজরা কয়েকবার এসে জানতে চেয়েছে ওর কিছু লাগবে কিনা। আমরা বাসা থেকে তার খাবার নিয়ে যাওয়ায় প্রতিবারই মানা করছিলাম। তবুও তারা কিছু ফ্রুটস রেখে গেল।
বিমানের টেক অফ আর ল্যান্ডিংয়ের সময় সবারই কিছু না কিছু প্রবলেম হয়। আমরা বড়রা ঢোক গিলে বা চকলেট চিবিয়ে নিজেদের কনট্রোল করি। কিন্তু বাচ্চারা তো আর অত বুঝে না। তারা একটু কান্নাকাটি করতে পারে। কানের উপর এই চাপ তো তারা আর অভ্যস্ত না। যারা বাচ্চা নিয়ে যাবেন তারা ব্যাপারটা একটু খেয়াল রাখবেন।
কুয়ালালামপুর আকাশ থেকে দেখে মনে হল এই শহড় রাতে জেগে থাকে। অদ্ভূত আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়ে যেন আমাদের অপেক্ষা করছে। আমরা যথাসময়ে নামলাম কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে। রাত তখন ১টা। এই রাতে এয়ারপোর্ট থেকে যেতে সবাই মানা করে রেখেছে। তাই অযথা আর তাড়াহুড়ো না করে ধীরে সুস্থে বিমান থেকে নামছি। নেমেই পেলাম ফ্রি ইন্টারনেট। প্রথমেই বাসায় জানিয়ে দিলাম আমরা যে কেএল পৌছেছি তা। বাচ্চা নিয়ে আসায় বাসায় সবারই কিছু টেনশন ছিল। বাসায় খবর দিয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখি পুরো এয়ারপোর্ট খালি্। আমাদের সাথের লোকজন কে কোথায় চলে গিয়েছে তার কোন খবর আর নেই। হঠাৎ করে নিজেকে খুব বোকা বোকা লাগল। আমি একা পারব না তা না কিন্তু দলের সাথে থাকাটা সব সময়ই ভাল। বিদেশেও ভাল আবার কক্সবাজারের সৈকতেও ভাল। তবুও এয়ারপোর্টের নির্দেশিত সাইন দেখে দেখে উঠলাম একটি ট্রেনে। এই ট্রেন আমাদের টার্মিনাল থেকে ইমিগ্রেষন কাউন্টার পর্যন্ত নিয়ে যাবে। বাপরে.... কত বড় এয়ারপোর্ট! যাদের ব্যাক্তিগত গাড়ী নেই বা যারা একটু সাবধানী তারা কেউ আর এই রাতে বাড়ি ফিরে নি। বরং ভোর হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছে। মালয়েশিয়ার এয়ারপোর্ট মূল শহড় থেকে বেশ দূরে। আর পথে মাঝে মাঝে ছিনতাই হয়। যদিও রাত ০২ টায় একটি বাস কেএল যায়। এই তথ্য অনেকেই জানত না। জানলে হয়ত আমরাও আরেকটু তাড়াহুড়ো করে কাজ সারতাম। সকাল ৬টা পর্যন্ত এয়ারপোর্ট মসজিদ যা তারা সূরাহ বলে ডাকে সেখানে বসে/ঘুমিয়ে পার করলাম। আমি অবশ্য মসজিদে বসি নি। বরং এয়ারপোর্টে ঘুরে ঘুরে অনেকের সাথে গল্প করছিলাম। বাংলাদেশীদের সাথে গল্প শুনছিলাম কেমন করে থাকে তারা এই দেশে। এয়ারপোর্টে ওয়াই-ফাই আছে।
সকাল ৬টায় বাসে করে আমরা ঢুকে গেলাম কেএল সেন্ট্রালে। সেখান থেকে ট্যাক্সি করে আমাদের সাময়িক আবাস 'বীরজায়া টাইমস স্তোয়ার'। ৪৮তলা এই ভবনের ৩১তলায় ছিল আমাদের রুম। সেখান থেকে টুইন টাওয়ার আর কেএল টাওয়ারসহ অনেক উচু উচু ভবনই দেখা যায়। এখন একটা শান্তির ঘুম দরকার। দিলাম ঘুম . . . . . .