রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানে ঝিম মেরে বসে আসে জয়নাল। রং চা খাচ্ছে সে। দীর্ঘ সময় পর পর একটা করে চুমুক দিচ্ছে চায়ে। ইদানিং দুধ চা মুখে রোচে না।
জয়নাল কি এতো ভাবো?
কথাটা জয়নালের মাথার অনেক উপর দিয়ে গেল। সে আরেকবার চায়ে চুমুক দেয়। তাকে দ্বিতীয় বিয়ে করতেই হবে। রাবেয়াকে নিয়ে ভাবছে না। তাকে অনেকবারই বলেছে সে আরেকটা বিয়ে করবে। রাবেয়া ধরা গলায় বলেছে, করবে, কে তোমাকে বাধা দিয়েছে? জয়নাল কয়েকবারই চমকে উঠেছে। দ্বিতীয় বিয়ে একজন নারী এত সহজভাবে মেনে নিবে এটা মাথায় ঠুকল না। নিরিবিলিতে কয়েকবারই সে ভেবেছে। কোন কুল কিনারা পায়নি।
রাবেয়া তুমি আরেকবার ভাবো। ঠান্ডা মাথায় ভাবো। এই সিদ্ধান্ত এত দ্রুত নিলে হয় না। আমিও ভাবতাছি। দেখি কি হয়।
আমি ভাবছি। তোমার ইচ্ছে হইছে বিয়ে করার, বিয়ে করবা। আমার কথায় কিছু আসে যায়?
তা ঠিক, তবে তোমার মতের তো দরকার আছে।
আমি মত দিলাম, তুমি আরেকটা বিয়ে কর।
জয়নাল মনে শান্তি পায় না। কেমন যেন উসখুস লাগে। রাবেয়ার কথাটা কোথায় যেন বিধে আছে। চাইলেই সে কাটাটা খুলতে পারছে না।
ঐ জয়নাল কি এতো ভাবো?
তোমার চায়ের কথা ভাবি। তুমি কি সুন্দর করে চা বানাও রহিম ভাই। শেষ করতেই মন চায় না।
রহিম ভাই একটা হাসি দেয়।
এ আর এমন কি?
জয়নাল আবার ভাবনায় হারিয়ে যায়। দ্বিতীয় বিয়ে তাকে করতেই হবে। রাবেয়ার সাথে আর কিছুতেই খাপ খাচ্ছে না। কোন কিছুতেই জয়নালের কথা শুনে না ও। কথায় কথায় তর্ক করে। মুখের উপর তর্ক। জয়নালের খুব জেদ হয়। কয়েকবার গায়ে হাত তুলেছিল ও। কাজ হয়নি। বরং উল্টো হয়েছে। রাবেয়ার ভয় ভেঙ্গে গেছে। এখন আর ও জয়নালকে ভয় পায় না। গেলবার জয়নাল বেজায় রেগেছিল। কিন্তু রাবেয়া ভাবলেশহীন ছিল। জয়নালের মুখের উপর বলে কি,
কি করবা? মারবা? মার, তোমার মত লোকের তো আছে খালি বউ মারার মুরদ।
জয়নাল হকচকিয়ে যায়। বলে কি রাবেয়া? ভয় পুরো ভেঙ্গে গেছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে জয়নাল অনেকবারই পিছু হটেছে। কিন্তু রাবেয়া বার বেড়েই যাচ্ছে। লাগামহীন।
একদিন রাবেয়া কোমর বেধে ঝগড়ায় নেমেছিল জয়নালের সাথে। জয়নালও হাত মুখ সমানে চালাল। লাভ হলো না। রাবেয়া জয়নালের বাবা মা তুলে গালি দিল। জয়নালকে দু’হাত লাগাতে সেও ভুলল না। জয়নাল খাটের উপর ঝিম মেরে বসে থাকে। তার বউ তার গায়ে হাত তুলতে পারে!
আমি তোমারে তালাক দিলাম।
রাবেয়ার রাগ ততক্ষণে কিছু কমেছে। কিন্তু তালাকের কথায় তার কোন ভাবান্তর হল না। যেন সে এজন্য প্রস্তুত ছিল।
তালাকও দিলে?
হু, দিলাম।
ভালই হইছে।
রাবেয়ার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। জয়নাল আড়চোখে দেখে। বুকটা খচখচ করছে। ভুল হলো না তো? না ঠিকই আছে। ওর মত বউয়ের দরকার নাই। আল্লাহর কাছে হাজার বার পানাহ চাই। দূর হোক। জয়নাল হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রাবেয়া অনেকটা উচ্চস্বরেই কান্না শুরু করে।
জয়নাল শেষ টান দিতে গিয়ে দেখল কাপে চা নেই।
রহিম ভাই তোমার চা’টা এত তাড়াতাড়ি শেষ হইয়া গেল।
এত তাড়াতাড়ি কই?
কতক্ষণ লাগছে খাইতে দেখছ!
জয়নাল সময়ের হিসাব পায় না। মজিদের সাথে দেখা করা দরকার। ও একটা মেয়ের কথা বলছিল। বিধবা মেয়ে। খুব ভাল। দেখতেও খারাপ না। দ্বিতীয় বিয়ের জন্য সালেহাকে জয়নালের মনে ধরেছে। কথা আগে বাড়ানো দরকার। দাম চুকিয়ে বেড়িয়ে পড়ে ও। মজিদকে কোথায় পাওয়া যাবে তাই এখন ভাবছে ।
রাবেয়াকে এক তালাকের পর আরেক তালাকও দিয়েছিল জয়নাল। এক তালাক পেয়ে রাবেয়ার আরও দ্বিগুণ উৎসাহে জয়নালের সাথে বেয়াদবী করতে শুরু করল। জয়নালও কম যায় না। পুরুষ মানুষ সে। কিন্তু রাবেয়াকে বকার পর বুকটার মাঝে খা খা করে। আট বছরের সংসার। কত ভালবাসা, স্বপ্ন জড়িয়ে আছে এই সংসারকে ঘিরে। ইদানিং জয়নাল স্বপ্ন দেখতেও ভয় পায়। রাবেয়াও কেমন জানি হয়ে গেছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নতুন বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করে।
তোমার নতুন বিয়ের খবর কি?
সময় হইলেই জানবে। ঐ পাড়ার সালেহাকে দেখছি। বিধবা মেয়ে। ছেলে মেয়ে নাই। তুমি কি বল?
খারাপ হয় না। আব্বা আম্মারে কিছু জানাইছ?
না, মাথা খারাপ!
জয়নালের সন্দেহ বাড়তে থাকে। যা হবার তাই হবে। কি আর হবে, সবশেষে আরেক তালাক দিতে হবে রাবেয়াকে। কিন্তু সন্তানেরা? রাবেয়া যদি একটু বুঝত। জয়নালের আক্ষেপ বাড়তে থাকে। ইদানিং দ্বিতীয় বিয়ের কথা তুলতেই রাবেয়া যেন অনেক চুপসে গেছে। দ্বিতীয় তালাকের পর থেকে শুরু। মনে হয় ভয় পেয়েছে। শত হলেও স্বামীর সংসার ছেড়ে গেলে আরেক জায়গায় বিয়ে বসতে বহুত ঝামেলা। লোকে নানান কথা বলে। লোকদের মুখতো আর আটকিয়ে রাখা যায় না।
জয়নাল দ্বিতীয় বিয়ের কথা পাকা করে। সালেহার আত্মীয় বলতে তেমন কেউ নেই। বাবা নেই, মা আছে আর এক ভাই। চাচারা, মামারাও গরীব। দিন ক্ষণ ঠিক করে জয়নাল দ্বিতীয় বিয়ে করতে যায়। সাথে রাবেয়াও যায়। ঝামেলা হতে পারে তাই রাবেয়ার যাওয়া। প্রথম স্ত্রী উপস্থিত থাকলে ঝামেলা কম হয়। লোকজনের মুখও বন্ধ থাকে। জয়নাল বেশ অবাক হয়। রাবেয়া এত সহজে মেনে নিল! কি আর করবে, তৃতীয় তালাকের রশি ঝুলছে তার উপর। ছেলেমেয়ের কথা চিন্তা করে হয়ত নরম হয়ে গেছে।
সালেহা দেখতে অত সুন্দরী না। রাবেয়ার মত না। রাবেয়ার আর কিছু না থাকলেও রুপ আছে। গুণও আছে। তবে বদগুণই বেশি। দিন গড়ায়। সালেহার ব্যবহারে জয়নাল যারপরনাই মুগ্ধ। মাটির মানুষ। এমন মানুষই হয় না। সারাক্ষণ স্বামীর চিন্তা। বাচ্চাদের সে কি আদর! জয়নাল তৃপ্তির ঢেকুর তুলে। অনেকদিন যাবত সে কি অশান্তিতেই ছিল। ইদানিং রাবেয়াও কেমন জানি নিশ্চুপ। আগের মত বাড়াবাড়ি করে না। ভালই হল।
মজিদের সাথে এ বিষয়ে আলাপও করেছিল ও। কিন্তু মজিদ বলে অন্য কথা।
দোস্ত নতুন বউতো, এখন ভালই পাইবা। দিন গেলে আসল চেহারা দেখবা। নতুন নতুন সবাই এমন করে।
আরে নাহ, সালেহা মেয়ে হিসাবে এমন না। তুই ওকে দেখিসনি, দেখলে এমন বলতি না।
হো হো করে হেসে উঠে মজিদ।
ভাল হইলেই ভাল। দোআ করি ভাল হোক।
জয়নালের বুকটা খচখচ করে। সালেহার ভিতর তেমন কিছুই ও দেখতে পাইনি। কিন্তু দিন বদলাতেই রাবেয়া আবার আগের মত আচরণ শুরু করল। বাড়ির কাজ নিয়ে হিসাব শুরু। সন্তানদের লালন পালন আরও কত হিসাব। জয়নাল যে শান্তিটুকু সালেহার মাঝে খুঁজে পেয়েছিল তা হারাম হয়ে গেল।
তুমি তো আগে এমন ছিলে না। আর বিয়েতে তুমিই তো মত দিলে। তখন না কর নাই কেন?
তুমি আমার শান্তি নষ্ট করছ, আর আমি তোমারে ভাল থাকতে দিব।
মানে! জয়নাল বেশ অবাক হয়। কথা আরও বাড়তে থাকে। ডালপালা ছাড়ায়। চিৎকার চেচামেচিতে জয়নালের বাবা মাও চলে আসে। সালেহা এককোণে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু রাবেয়ার চিৎকার থামে না।
দেখ মা, এমন চিৎকার কইর না। জয়নালের মা রাবেয়ার গায়ে হাত বুলায়। ঝাট মেরে উঠে রাবেয়া।
আপনার ছেলেরে বুঝান। এত শখ কেন দুই বিয়া করার, এক বউতে পোষায় না।
কি সাংঘাতিক কথা! লজ্জায় জয়নালের মাথা হেট হয়ে যায়। বাবা মা সামনে এমন কথা। এক ঝাটকায় রাবেয়ার গালে চড় বসিয়ে দেয় জয়নাল। সাথে গালিও দেয় সে।
মারো কেন? আমারও হাত আছে।
কি করবি? জয়নাল রাগে কাপতে থাকে। কিন্তু জয়নালকে হতভম্ভ করে দিয়ে রাবেয়া জয়নালের গালে চড় বসিয়ে দেয়। জয়নাল চুপ মেরে খাটে বসে থাকে। ততক্ষণে আরেক তালাক পড়ে গেছে। রাজ্যের নিরবতা নেমে আসে জয়নালের ঘরে।
মাঝ রাতে জয়নালের ঘুম ভাঙ্গে দুঃস্বপ্নে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার ।
রাবেয়া এক গ্লাস পানি খাওয়াবে।
পানি হাতে জয়নালের পাশে বসে সালেহা। গ্লাস হাতে নিতে ঘোর ভাঙ্গে জয়নালের। রাবেয়া নেই। চলে গেছে। যাওয়ার সময় বাচ্চাদের নিয়ে গেছে সাথে করে। জয়নাল কিছু বলেনি। জয়নাল পানি হাতে বসে থাকে। বুকটা খা খা করছে। রাবেয়াকে আর ডাকলে আসবে না। এতগুলো বছর... দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে জয়নাল। সালেহা জয়নালের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিজেকে বড় দোষী হয় তার।
....................
চার বছর পর কোন একদিন জয়নালের সাথে তর্ক বাধে সালেহার। জয়নালকে অকথ্য ভাষায় গালি দেয় সে।
খাওয়ানের মুরদ নাই, তাহলে বিয়ে করছিলে কেন?
তোমার এত লাগে কেন? খরচের হাত এত বড় কেন শুনি। রাবেয়ার তো এত লাগত না।
রাবেয়ার কথা এত বল কেন? শখ থাকলে আবার বিয়া কর তারে।
রাগ উঠে জয়নালের। আরও কিছুক্ষণ চলে ঝগড়া।
রহিম ভাইয়ের চায়ের দোকানে ঝিম মেরে বসে থাকে জয়নাল। ইদানিং কোন চা তার মুখে রোচে না। সময় যেন তার পার হতে চায় না। সালেহা চলে গেছে আজ চারদিন। তৃতীয় তালাকের বোঝা তাকে টলাতে পারেনি। এই চার বছরে জয়নালের কোন ছেলেপুলে হয়নি। রাবেয়াকে বড় মনে পড়ে তার। প্রথম জীবনে হাজারো কষ্টের মাঝে জয়নালকে কি সুন্দর আগলে রাখত সে। একবেলা খেয়ে না খেয়ে তার ছেলেপুলেদের মানুষ করেছে সে। বাড়ির সবাই রাবেয়াকে কত ভালবাসত। জয়নালের দিনগুলো ছিল সুখের। শুরুতে রাবেয়াতো এমন ছিল না। তবে কি জয়নালের ভুল ছিল?রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানে ঝিম মেরে বসে আসে জয়নাল। রং চা খাচ্ছে সে। দীর্ঘ সময় পর পর একটা করে চুমুক দিচ্ছে চায়ে। ইদানিং দুধ চা মুখে রোচে না।
জয়নাল কি এতো ভাবো?
কথাটা জয়নালের মাথার অনেক উপর দিয়ে গেল। সে আরেকবার চায়ে চুমুক দেয়। তাকে দ্বিতীয় বিয়ে করতেই হবে। রাবেয়াকে নিয়ে ভাবছে না। তাকে অনেকবারই বলেছে সে আরেকটা বিয়ে করবে। রাবেয়া ধরা গলায় বলেছে, করবে, কে তোমাকে বাধা দিয়েছে? জয়নাল কয়েকবারই চমকে উঠেছে। দ্বিতীয় বিয়ে একজন নারী এত সহজভাবে মেনে নিবে এটা মাথায় ঠুকল না। নিরিবিলিতে কয়েকবারই সে ভেবেছে। কোন কুল কিনারা পায়নি।
রাবেয়া তুমি আরেকবার ভাবো। ঠান্ডা মাথায় ভাবো। এই সিদ্ধান্ত এত দ্রুত নিলে হয় না। আমিও ভাবতাছি। দেখি কি হয়।
আমি ভাবছি। তোমার ইচ্ছে হইছে বিয়ে করার, বিয়ে করবা। আমার কথায় কিছু আসে যায়?
তা ঠিক, তবে তোমার মতের তো দরকার আছে।
আমি মত দিলাম, তুমি আরেকটা বিয়ে কর।
জয়নাল মনে শান্তি পায় না। কেমন যেন উসখুস লাগে। রাবেয়ার কথাটা কোথায় যেন বিধে আছে। চাইলেই সে কাটাটা খুলতে পারছে না।
ঐ জয়নাল কি এতো ভাবো?
তোমার চায়ের কথা ভাবি। তুমি কি সুন্দর করে চা বানাও রহিম ভাই। শেষ করতেই মন চায় না।
রহিম ভাই একটা হাসি দেয়।
এ আর এমন কি?
জয়নাল আবার ভাবনায় হারিয়ে যায়। দ্বিতীয় বিয়ে তাকে করতেই হবে। রাবেয়ার সাথে আর কিছুতেই খাপ খাচ্ছে না। কোন কিছুতেই জয়নালের কথা শুনে না ও। কথায় কথায় তর্ক করে। মুখের উপর তর্ক। জয়নালের খুব জেদ হয়। কয়েকবার গায়ে হাত তুলেছিল ও। কাজ হয়নি। বরং উল্টো হয়েছে। রাবেয়ার ভয় ভেঙ্গে গেছে। এখন আর ও জয়নালকে ভয় পায় না। গেলবার জয়নাল বেজায় রেগেছিল। কিন্তু রাবেয়া ভাবলেশহীন ছিল। জয়নালের মুখের উপর বলে কি,
কি করবা? মারবা? মার, তোমার মত লোকের তো আছে খালি বউ মারার মুরদ।
জয়নাল হকচকিয়ে যায়। বলে কি রাবেয়া? ভয় পুরো ভেঙ্গে গেছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে জয়নাল অনেকবারই পিছু হটেছে। কিন্তু রাবেয়া বার বেড়েই যাচ্ছে। লাগামহীন।
একদিন রাবেয়া কোমর বেধে ঝগড়ায় নেমেছিল জয়নালের সাথে। জয়নালও হাত মুখ সমানে চালাল। লাভ হলো না। রাবেয়া জয়নালের বাবা মা তুলে গালি দিল। জয়নালকে দু’হাত লাগাতে সেও ভুলল না। জয়নাল খাটের উপর ঝিম মেরে বসে থাকে। তার বউ তার গায়ে হাত তুলতে পারে!
আমি তোমারে তালাক দিলাম।
রাবেয়ার রাগ ততক্ষণে কিছু কমেছে। কিন্তু তালাকের কথায় তার কোন ভাবান্তর হল না। যেন সে এজন্য প্রস্তুত ছিল।
তালাকও দিলে?
হু, দিলাম।
ভালই হইছে।
রাবেয়ার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। জয়নাল আড়চোখে দেখে। বুকটা খচখচ করছে। ভুল হলো না তো? না ঠিকই আছে। ওর মত বউয়ের দরকার নাই। আল্লাহর কাছে হাজার বার পানাহ চাই। দূর হোক। জয়নাল হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রাবেয়া অনেকটা উচ্চস্বরেই কান্না শুরু করে।
জয়নাল শেষ টান দিতে গিয়ে দেখল কাপে চা নেই।
রহিম ভাই তোমার চা’টা এত তাড়াতাড়ি শেষ হইয়া গেল।
এত তাড়াতাড়ি কই?
কতক্ষণ লাগছে খাইতে দেখছ!
জয়নাল সময়ের হিসাব পায় না। মজিদের সাথে দেখা করা দরকার। ও একটা মেয়ের কথা বলছিল। বিধবা মেয়ে। খুব ভাল। দেখতেও খারাপ না। দ্বিতীয় বিয়ের জন্য সালেহাকে জয়নালের মনে ধরেছে। কথা আগে বাড়ানো দরকার। দাম চুকিয়ে বেড়িয়ে পড়ে ও। মজিদকে কোথায় পাওয়া যাবে তাই এখন ভাবছে ।
রাবেয়াকে এক তালাকের পর আরেক তালাকও দিয়েছিল জয়নাল। এক তালাক পেয়ে রাবেয়ার আরও দ্বিগুণ উৎসাহে জয়নালের সাথে বেয়াদবী করতে শুরু করল। জয়নালও কম যায় না। পুরুষ মানুষ সে। কিন্তু রাবেয়াকে বকার পর বুকটার মাঝে খা খা করে। আট বছরের সংসার। কত ভালবাসা, স্বপ্ন জড়িয়ে আছে এই সংসারকে ঘিরে। ইদানিং জয়নাল স্বপ্ন দেখতেও ভয় পায়। রাবেয়াও কেমন জানি হয়ে গেছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নতুন বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করে।
তোমার নতুন বিয়ের খবর কি?
সময় হইলেই জানবে। ঐ পাড়ার সালেহাকে দেখছি। বিধবা মেয়ে। ছেলে মেয়ে নাই। তুমি কি বল?
খারাপ হয় না। আব্বা আম্মারে কিছু জানাইছ?
না, মাথা খারাপ!
জয়নালের সন্দেহ বাড়তে থাকে। যা হবার তাই হবে। কি আর হবে, সবশেষে আরেক তালাক দিতে হবে রাবেয়াকে। কিন্তু সন্তানেরা? রাবেয়া যদি একটু বুঝত। জয়নালের আক্ষেপ বাড়তে থাকে। ইদানিং দ্বিতীয় বিয়ের কথা তুলতেই রাবেয়া যেন অনেক চুপসে গেছে। দ্বিতীয় তালাকের পর থেকে শুরু। মনে হয় ভয় পেয়েছে। শত হলেও স্বামীর সংসার ছেড়ে গেলে আরেক জায়গায় বিয়ে বসতে বহুত ঝামেলা। লোকে নানান কথা বলে। লোকদের মুখতো আর আটকিয়ে রাখা যায় না।
জয়নাল দ্বিতীয় বিয়ের কথা পাকা করে। সালেহার আত্মীয় বলতে তেমন কেউ নেই। বাবা নেই, মা আছে আর এক ভাই। চাচারা, মামারাও গরীব। দিন ক্ষণ ঠিক করে জয়নাল দ্বিতীয় বিয়ে করতে যায়। সাথে রাবেয়াও যায়। ঝামেলা হতে পারে তাই রাবেয়ার যাওয়া। প্রথম স্ত্রী উপস্থিত থাকলে ঝামেলা কম হয়। লোকজনের মুখও বন্ধ থাকে। জয়নাল বেশ অবাক হয়। রাবেয়া এত সহজে মেনে নিল! কি আর করবে, তৃতীয় তালাকের রশি ঝুলছে তার উপর। ছেলেমেয়ের কথা চিন্তা করে হয়ত নরম হয়ে গেছে।
সালেহা দেখতে অত সুন্দরী না। রাবেয়ার মত না। রাবেয়ার আর কিছু না থাকলেও রুপ আছে। গুণও আছে। তবে বদগুণই বেশি। দিন গড়ায়। সালেহার ব্যবহারে জয়নাল যারপরনাই মুগ্ধ। মাটির মানুষ। এমন মানুষই হয় না। সারাক্ষণ স্বামীর চিন্তা। বাচ্চাদের সে কি আদর! জয়নাল তৃপ্তির ঢেকুর তুলে। অনেকদিন যাবত সে কি অশান্তিতেই ছিল। ইদানিং রাবেয়াও কেমন জানি নিশ্চুপ। আগের মত বাড়াবাড়ি করে না। ভালই হল।
মজিদের সাথে এ বিষয়ে আলাপও করেছিল ও। কিন্তু মজিদ বলে অন্য কথা।
দোস্ত নতুন বউতো, এখন ভালই পাইবা। দিন গেলে আসল চেহারা দেখবা। নতুন নতুন সবাই এমন করে।
আরে নাহ, সালেহা মেয়ে হিসাবে এমন না। তুই ওকে দেখিসনি, দেখলে এমন বলতি না।
হো হো করে হেসে উঠে মজিদ।
ভাল হইলেই ভাল। দোআ করি ভাল হোক।
জয়নালের বুকটা খচখচ করে। সালেহার ভিতর তেমন কিছুই ও দেখতে পাইনি। কিন্তু দিন বদলাতেই রাবেয়া আবার আগের মত আচরণ শুরু করল। বাড়ির কাজ নিয়ে হিসাব শুরু। সন্তানদের লালন পালন আরও কত হিসাব। জয়নাল যে শান্তিটুকু সালেহার মাঝে খুঁজে পেয়েছিল তা হারাম হয়ে গেল।
তুমি তো আগে এমন ছিলে না। আর বিয়েতে তুমিই তো মত দিলে। তখন না কর নাই কেন?
তুমি আমার শান্তি নষ্ট করছ, আর আমি তোমারে ভাল থাকতে দিব।
মানে! জয়নাল বেশ অবাক হয়। কথা আরও বাড়তে থাকে। ডালপালা ছাড়ায়। চিৎকার চেচামেচিতে জয়নালের বাবা মাও চলে আসে। সালেহা এককোণে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু রাবেয়ার চিৎকার থামে না।
দেখ মা, এমন চিৎকার কইর না। জয়নালের মা রাবেয়ার গায়ে হাত বুলায়। ঝাট মেরে উঠে রাবেয়া।
আপনার ছেলেরে বুঝান। এত শখ কেন দুই বিয়া করার, এক বউতে পোষায় না।
কি সাংঘাতিক কথা! লজ্জায় জয়নালের মাথা হেট হয়ে যায়। বাবা মা সামনে এমন কথা। এক ঝাটকায় রাবেয়ার গালে চড় বসিয়ে দেয় জয়নাল। সাথে গালিও দেয় সে।
মারো কেন? আমারও হাত আছে।
কি করবি? জয়নাল রাগে কাপতে থাকে। কিন্তু জয়নালকে হতভম্ভ করে দিয়ে রাবেয়া জয়নালের গালে চড় বসিয়ে দেয়। জয়নাল চুপ মেরে খাটে বসে থাকে। ততক্ষণে আরেক তালাক পড়ে গেছে। রাজ্যের নিরবতা নেমে আসে জয়নালের ঘরে।
মাঝ রাতে জয়নালের ঘুম ভাঙ্গে দুঃস্বপ্নে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার ।
রাবেয়া এক গ্লাস পানি খাওয়াবে।
পানি হাতে জয়নালের পাশে বসে সালেহা। গ্লাস হাতে নিতে ঘোর ভাঙ্গে জয়নালের। রাবেয়া নেই। চলে গেছে। যাওয়ার সময় বাচ্চাদের নিয়ে গেছে সাথে করে। জয়নাল কিছু বলেনি। জয়নাল পানি হাতে বসে থাকে। বুকটা খা খা করছে। রাবেয়াকে আর ডাকলে আসবে না। এতগুলো বছর... দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে জয়নাল। সালেহা জয়নালের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিজেকে বড় দোষী হয় তার।
....................
চার বছর পর কোন একদিন জয়নালের সাথে তর্ক বাধে সালেহার। জয়নালকে অকথ্য ভাষায় গালি দেয় সে।
খাওয়ানের মুরদ নাই, তাহলে বিয়ে করছিলে কেন?
তোমার এত লাগে কেন? খরচের হাত এত বড় কেন শুনি। রাবেয়ার তো এত লাগত না।
রাবেয়ার কথা এত বল কেন? শখ থাকলে আবার বিয়া কর তারে।
রাগ উঠে জয়নালের। আরও কিছুক্ষণ চলে ঝগড়া।
রহিম ভাইয়ের চায়ের দোকানে ঝিম মেরে বসে থাকে জয়নাল। ইদানিং কোন চা তার মুখে রোচে না। সময় যেন তার পার হতে চায় না। সালেহা চলে গেছে আজ চারদিন। তৃতীয় তালাকের বোঝা তাকে টলাতে পারেনি। এই চার বছরে জয়নালের কোন ছেলেপুলে হয়নি। রাবেয়াকে বড় মনে পড়ে তার। প্রথম জীবনে হাজারো কষ্টের মাঝে জয়নালকে কি সুন্দর আগলে রাখত সে। একবেলা খেয়ে না খেয়ে তার ছেলেপুলেদের মানুষ করেছে সে। বাড়ির সবাই রাবেয়াকে কত ভালবাসত। জয়নালের দিনগুলো ছিল সুখের। শুরুতে রাবেয়াতো এমন ছিল না। তবে কি জয়নালের ভুল ছিল?
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ২:৫৯