জনপ্রতিনিধি অর্থাৎ জনগণের প্রতিনিধি। যিনি জনগণের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। জনগণ তাদের পক্ষ থেকে কিছু বলার, কিছুর করার জন্য একজন প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন, সরল ভাষায় তিনি জনপ্রতিনিধি। এ হিসাবে আমাদের দেশে, ওয়ার্ড মেম্বার, চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ সদস্য (এমপি), মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী সবাই জনপ্রতিনিধি। আমরা তাদেরকে নির্বাচিত করি আমাদের জন্য, দেশের জন্য। আমরা অনেকেই প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতাসম্পন্ন নই বিধায় একজন যোগ্য ব্যক্তিকেই আমরা আমাদের পক্ষ থেকে নির্বাচিত করি। আসলেই কি আমাদের মধ্য থেকে একাধিক যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি নেই? এখানেও প্রশ্ন থেকে যায়। মূলত বর্তমান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কিছুটা জটিল এবং ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেক যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তি পূর্ণ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে না। যার ফলে অনেক সময় অনেক অযোগ্য ক্ষমতাধর ব্যক্তিও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে। আর যেহেতু দুুটো থেকে একটি বেছে নিতেই হবে, তাই বাধ্য হয়েই আমরা অনেক ক্ষেত্রে এই অযোগ্য লোকদের নির্বাচিত করি। এক্ষেত্রে আমাদের তেমন কিছুই করার থাকে না। রাজনৈতিক দলগুলো এই প্রতিনিধিগুলো নির্ধারন করে দেয়। আর আমাদের এদের গ্রহণ করা ছাড়া কোন উপায় নেই।
নির্বাচিত হওয়ার পরেই এই সাধারণ ব্যক্তিরা ধীরে ধীরে অসাধারণ হয়ে উঠে। হ্যা এটা সত্য যে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তারা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। কিন্তু জনগণের সাথে তাদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। জনগণ তাদের কথা, তাদের ব্যাথা, অভিযোগ, অনুযোগ জানানোর জন্য জনপ্রতিনিধির সাক্ষাত পাননা। অনেকের ক্ষেত্রে দূরত্ব আগেই সৃষ্টি হয়। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জনপ্রতিনিধিত্বকারীরা ধনী ব্যক্তি হন। আর স্বাভাবিকভাবেই ধনীদের দরজা অধিকাংশ গরীবদের জন্য বন্ধ থাকে। আরেকটি বিষয় জনপ্রতিনিধিরা নিজ নির্বাচনী এলাকায় বসবাস না করে রাজধানী ঢাকায় বসবাস করে।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি উল্লেখ করার মত, তা হল নিরাপত্তা। এই বিষয়টি মুখ্য হয়ে উঠে সব সময়। নিরাপত্তার ধুলো উড়িয়ে এরা সাধারণ নাগরিকদের সাথে দূরত্ব তৈরী করে। বিষয়টি ফেলে দেয়ার মত নয়। কিন্তু যে লোকটি এতদিন জনসাধারনের সাথে একসাথে উঠল বসল, একই চায়ের দোকানে চা খেল, প্রতিনিধি হওয়ার পর সেই জনগণের সাথেই দূরত্ব সৃষ্টি করল নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে। কিসের ভয়? কেন এই নিরাপত্তা? জনগণের ভালবাসা নিয়েইতো সে নির্বাচিত। তাই হয়ত কিছু দিন পূর্বে আমাদের মাননীয় রাষ্ট্রপতি এ নিয়ে তার দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি স্বাধীনভাবে কোথাও বেড়াতে যেতে পারেন না। কোন খাবার খাওয়ার পূর্বে বিভিন্ন ধাপে পরীক্ষা হওয়ার পর তিনি তা গ্রহণ করেন। তার কাছে এই জীবন বন্দী জীবনের মত মনে হয়। বিষয়টি আসলেই কি সেরকম? আসলেই কি নিরাপত্তার এত প্রয়োজন?
পুরো বিষয়টিকে এভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে সম্প্রতি সময়ে ভারতে দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচিত হওয়া আদ আদমি পার্টির প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেয়ার পরের দিন তিনি স্বস্ত্রীক প্রাতঃভ্রমনে বেড়িয়েছেন। দৈনিক যেভাবে তিনি বের হন সেই একই রূপেই তিনি বের হয়েছে একজন সাধারন নাগরিক হিসাবে। কোন রকমের নিরাপত্তা ছাড়াই মাথায় মাফলার পেচিয়ে সাধারণ পোষাকে সকালে বেড়িয়েছেন হাটতে। সাধারন সেলোয়ার কামিজ সাথে কার্ডিগেন পরিহিত তার স্ত্রী হয়েছেন তার সঙ্গী। দৈনন্দিন রুটিন। হাটছেন, উৎসুক জনগণও তাদের কৌতুহল চেপে রাখতে পারেনি। করমর্দন থেকে শুরু করে সেলফিও তুলেছেন অনেকে। এতে তার রুটিনে ব্যাঘাত ঘটলেও পুরো বিষয়টি উপভোগ করেছেন দু’পক্ষই। যদিও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসাবে তার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করা হয়েছিল বারবার। কিন্তু তিনি তার সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল। তার দাবী, তিনি একজন সাধারণ নাগরিক আর সেভাবেই তিনি বাঁচতে চান। এতে যদি তার মৃত্যুও হয় তবুও কিছু যায় আসে না। এর পূর্বেও তিনি কয়েক রাত্রি খোলা আকাশের নিচে রাস্তা ঘুমিয়েছেন। অনেক আশার স্বপ্ন দেখিয়েছেন দিল্লীবাসীকে। কতটুকু পূরণ করতে পারবেন সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু তিনি জনগণের ভালবাসা নিয়েই নির্বাচিত হয়েছে বিপুল ভোটে। শুরুর ইতিহাস হয়ত অনেকেরই জানা। নির্বাচিত হওয়ার পরেও তিনি তাদের সাথেই আছেন।
কেজরিওয়ালকে ব্যতিক্রম বলে এড়িয়ে যাওয়ার জো নেই। এরকম হাজারো উদাহরণ বর্তমান বিশ্বে রয়েছে। এর বিপরীতও রয়েছে। কেজরিওয়াল একজন মুখ্যমন্ত্রী, কিন্তু রাষ্ট্রপতিরাও পর্যন্ত এমন নিরাপত্তাবিহীন জনগণের সাথে মিশে থাকে। লাতিন আমেরিকা মধ্যম আয়ের দেশ উরুগুয়ে। এদেশে প্রেসিডেন্ট হোসে মুহিকাকে ধরা হয় বিশ্বের সবচেয়ে গরীব প্রেসিডেন্ট হিসাবে। শহর থেকে দূরে এক জরাজীর্ণ খামারবাড়িতে বাস করে ১৪ বছর জেলখাটা এই বাম নেতা। কর্দমাক্ত রাস্তা পায়ে হেটে নিজ বাড়িতে যান তিনি। তার নিরাপত্তা হিসাবে আছে দুজন পুলিশ আর এক তিন পা ওয়ালা খোড়া কুকুর। অবসরে নিজ স্ত্রীকে নিয়ে কৃষিকাজ করেন।
বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা ইরানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আহমেদিনেজাদ। সরকারী বাসভবনে বসবাস না করে তিন নিজ বাড়িতে বসবাস করতেন। তিনি সাধারণ বিমানের ইকোনোমি ক্লাসে চলাফেরা করতেন রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার জন্য। প্রায় সময়ই তিনি তার লিভিং রুমে ঘুমিয়ে পড়তেন কোন রকম নিরাপত্তা প্রহরী ছাড়াই। অনেক সময় রাস্তার পাশে তিনি নামাযে দাড়িয়ে যেতেন।
ফ্রাঁসোয়া ওলান্দ ফ্রান্সের বর্তমান প্রেসিডেন্ট। প্রভাবশালী এই নেতা পূর্বের সকল নিয়ম ভেঙ্গে ইউরোপোর দেশগুলোতে ভ্রমন করেন ট্রেনে, নিরপত্তাকর্মী ব্যতীত। এমনকি তিনি স্পেনের প্রধানমন্ত্রীকেও ম্যানেজ করেছিলেন তার সাথে ট্রেনে চলার জন্য। বিগত ৬০ বছরের নিয়ম ছিল প্রেসিডেন্ট যাওয়ার পথে পথে পুলিশ কর্মকর্তা থাকবে। তিনি এ নিয়ম ভেঙ্গে দিয়েছেন। আর এভাবেই যাতায়াত করছেন সাধারন মানুষের সাথে মিলেমিশে।
এরকম হাজারো উদাহরণ রয়েছে বর্তমান বিশ্বে। এগুলোকে আপনি হয়ত ব্যতিক্রম বলতে পারেন। কারণ এ বিপক্ষের রয়েছে অনেক উদাহরণ। কিন্তু কেজরিওয়াল যখন ক্ষমতায় তখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বললেন, নির্বাচনের পূর্বে অনেকেই এমন অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন নির্বাচনে জেতার জন্য। কথাটা হিংসাত্মক। যেখানে কেজরিওয়ালকে সার্বিক সহায়তা করবে তা নয় বরং উল্টো কথা। এভাবেই চলছে আমাদের দেশ। প্রচলিত হিংসাত্মক রাজনীতি নিজ থেকে নিজের শত্রু সৃষ্টি করছে। যদি কেজরিওয়াল তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেন, তবে অনেক শত্রুই গজিয়ে উঠবে দ্রুত, যারা বিগত দিনে পারেননি। এভাবেই প্রতিহিংসার স্বীকার হচ্ছে আমাদের দেশ। হিংসার আগুনে জ্বলছে মানুষ, গাড়ি। পুড়ছে মন, ভালোবাসা। দুরত্ব আগেই ছিল আর সেই দুরত্ব আরও প্রলম্বিত হচ্ছে। আমরা সাধারণ জনগণ কার কাছে যাব?