মঙ্গলদীপ প্রজ্বলন, যা এখন বাঙালী সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাড়িয়েছে। আধুনিক বাঙলা সমাজ এটাকে খুবই সাদরে গ্রহণ করেছে। এর তীব্রতা এত প্রবল হয়ে দাড়িয়েছে যে, তা এখন বাঙলা সংস্কৃতি নয় যে কোন আচার অনুষ্ঠানের জন্য অনেকটা মূল প্রতিপাদ্য বলে ধরা হয়। কি এই মঙ্গলদীপ?
মানবজাতি ও পৃথিবীর মঙ্গল কামনায় সহস প্রদীপ জ্বেলে দীপাবলির মধ্য দিয়ে পালিত হয় শ্যামাপূজা বা কালীপূজা। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন মন্দির, শ্মশান ও তাদের নিজ নিজ গৃহে প্রদীপ জ্বেলে এ দীপাবলি উৎসব উদযাপন করেন। পরে মধ্যরাতে মাতৃজ্ঞানরূপে অনুষ্ঠিত হয় শ্যামাপূজা। শ্যামাপূজার অন্যতম অংশ হলো দীপাবলি পালন। একই পরিবারের ও আত্মীয় স্বজনের মৃত ব্যক্তির নামে শ্মশান ঘাটে প্রদীপ প্রজ্বলন করা হয়। এর ফলে মৃত ব্যক্তিদের আত্মা স্বর্গীয় অবস্থান লাভ করে- এ ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে দীপাবলি অনুষ্ঠান পালিত হয়ে আসছে। গ্রামবাংলার হিন্দু সম্প্রদায় শত বছর ধরে ছোট ছোট মাটির সরায় মঙ্গল প্রদীপ জ্বেলে দীপাবলি পালন করে। শহুরে জীবনেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। মাটির সরার জোগাড় অনেকের না হলেও মোমবাতি জ্বেলে মঙ্গল কামনায় ইট-পাথরের এ শহরকে আলোকিত করে দীপাবলি উৎসব উদযাপন করেন।
ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির প্রাঙ্গণে সর্বজনীন পূজা কমিটির উদ্যোগে প্রদীপ প্রজ্বলন করা হয়। গোপীবাগের রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠ, রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম, সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির, জয়কালী রোডের রামসীতা মন্দিরসহ বিভিন্ন স্থানে দীপাবলির মধ্য দিয়ে শ্যামাপূজা উদযাপিত হয়। রমনার কালীমন্দির সংলগ্ন পুকুরে দশ হাজারের মত প্রদীপ জালানো হয়।
যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ধর্মের সংস্কৃতির এক সংমিশ্রিত রূপ হলো আমাদের বাঙালী সংস্কৃতি। কিন্তু আজ এই বাঙালী সংস্কৃতি থেকে খুব দ্র“ত মুসলিম সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে বললে ভুল হবে, জোড় করে তাড়িয়ে দেয়া হচেছ। মৃত ব্যক্তির মঙ্গলার্থে এইরূপ প্রদীপ জ্বালানো সম্পূর্ণরূপে হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতি। আজ আমরা কোন শোক সভা হলে শহীদ মিনার প্রাঙ্গন বা অন্য কোথায় শত শত মোমবাতি বা প্রদীপ প্রজ্বলন করি। এইতো কিছুদিন আগেও শাহবাগে লাখ লাখ মোমবাতি প্রজ্বলন করা হল। আবার তার সাথে সাথে ধর্ম নিরপেক্ষতার বুলি আওড়ানো হল। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কিংবা দেশের অন্যান্য বিশিষ্ট জনের বেলায় যখন কোন জন্মজয়ন্তী বা কোন সেমিনারের আয়োজন করা হয় তখন দেখা যায় কবির প্রতিকৃতিতে পুস্পার্ঘ অর্পন, মঙ্গলদ্বীপ প্রজ্বলন করা হয়। তাহলে কেন এইসব আচার অনুষ্ঠানে ধর্ম নিরপেক্ষতার ধুলি উড়ানো হয়? আর তা মুসলিম সংস্কৃতিকে সরাসরি আঘাত করা হয়। তবে কি এই সমীকরণ দাড়ায়, মুসলিম সংস্কৃতি তাদের জন্য বাধা স্বরূপ। অন্য একটি ধর্মের আচার অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ রূপে অনুকরণ করার পরেও কিরূপে একটি অনুষ্ঠান কিংবা সভা সেমিনার ধর্ম নিরপেক্ষ থাকল?
আজ বিভিন্ন সময়ে মৃত ব্যক্তি স্বরণে তার আত্মার শান্তির জন্য আমরা এই প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করি। যদি বলা হয় যে এই সব সভা সেমিনার বা অনুষ্ঠান কোরআন তেলওয়াত বা দোআ মাহফিল দ্বারা পরিচালিত হবে তবে অনেকেই বাকা চোখে তাকায়। সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা দ্বারা এগুলো তখন প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। ধর্মের দোহাই দিয়ে বলা হয় আমি বাঙালী। তারপর মুসলামান বা হিন্দু। তাহলে কেন মৃত ব্যক্তির স্বরণে সংস্কৃতি হিসেবে কোরআন তেলওয়াত বা দোআ মাহফিল গৃহীত হল না।
জন্মাষ্টমী উপলক্ষ্যে যে সকল অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয় তার মধ্যে রয়েছে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব স্মরণে প্রতিটি দেবস্থলীতৈ ও সনাতন গৃহে শ্রীকৃষ্ণের আসন স্থাপন ও প্রতিটি দেবস্থালী থেকে মঙ্গলদ্বীপ এনে শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের মন্দিরে স্থাপিত উৎসবদ্বীপ প্রজ্জলন, শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ সহকারে সংকীর্তন শোভাযাত্রা।
খুব সুক্ষ্মভাবে খেয়াল করলে দেখা যায়, পহেলা বৈশাখ, নজরুল জয়ন্তী, শোকসভা ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমরা প্রদীপ প্রজ্জলন থেকে শুরু করে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করি। আর এগুলো সম্পূর্ণরূপে হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতি। বাধা নেই এগুলো করতে। তবে বাধা হল, যখন মুসলমান কিছু বলে বা করে তখন তা হয়ে যায় সাম্প্রদায়িকতা।
মুল বিষয় হলো ইসলাম বাদে যেকোন ধর্মের সংস্কৃতি গ্রহণ করতে আমাদের বাধা নেই। আর তা হয়ে যায় বাঙালী সংস্কৃতি। বর্তমানেতো খ্রীষ্টানদের সংস্কৃতি আমাদের রন্দ্রে রন্দ্রে প্রবেশ করেছে। কেউ কিছু বলতে চাইলে তখন তাকে ধর্মের দোহাই দিয়ে বসিয়ে দেয়া হয়। আজ তো অনেক লোক তৈরী হয়ে গেছে যারা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালী বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু মুসলিম সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হওয়া এদের জন্য গলার কাঁটা হয়ে গছে।
আপত্তি নেই, যে কেউ যেকোন সংস্কৃতি গ্রহন করুক। তার স্বাধীনতা আছে। তার মানে এই নয় যে, মুসলিম সংস্কৃতিকে আঘাত করা। বিভিন্ন অবান্তর প্রশ্ন দ্বারা এগুলোকে সমাজ তথা মানুষের চোখে ছোট করা।
এখানেতো শুধু মাত্র মঙ্গলদ্বীপ এর কথা বলা হয়েছে। যা এখন একটা বাঙলা সংস্কৃতির ঐতিহ্য হয়ে দাড়িয়েছে। এছাড়াও হাজারো সংস্কৃতি রয়েছে যা বিভিন্ন ধর্ম থেকে বিশেষ করে হিন্দু ধর্ম থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। আর এর অন্তরালে আমরা কিছু নামধারী মুসলাম সবার আগে ধর্ম নিরপেক্ষতার শ্লোগান তুলে মুসলিম সংস্কৃতিকে হটিয়ে দিচ্ছি খুব দাপটের সঙ্গে। আর তাই প্রায়ই মনে হয় কার দীপ কে জ্বালে?